নেপালের কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত পাইলট আবিদ সুলতানকে ভুলতে পারছেন না তার সহকর্মীরা। প্লেনের ককপিটে উঠে এখনও তারা ভাবতে চান কিছুক্ষণ পরই হয়তো ককপিটে আসবেন ক্যাপ্টেন আবিদ। স্বভাব সুলভ হাসি দিয়ে কুশল বিনিময় করবেন। নেবেন উড্ডয়নের প্রস্তুতি।
পাইলট আবিদকে হারিয়ে শোকাতুর তার সহকর্মীরা। আবিদ সুলতানের সহকর্মীদের নানা তথ্যে জানা যায় তিনি ছিলেন একজন দক্ষ পাইলট। প্লেন চালনায় তার দক্ষতার বিষয়টি ছিল সর্বজনবিদিত। সেই দক্ষ পাইলটের এমন করুণ পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না তাকে খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা অন্যান্য পাইলটরা। তার বন্ধুসুলভ ও বিনয়ী আচরণে মুগ্ধ ছিলেন তারা। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তারা স্মরণ করেছেন পাইলট আবিদকে।
তারা স্মৃতিচারণ করেছেন অতীতে ভয়াবহ বজ্র ঝড়ের কবল থেকে কীভাবে তিনি ইউএস বাংলার একটি প্লেন ও প্লেনের আরোহীদের রক্ষা করে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন, সে গল্পই চ্যানেল আই অনলাইনকে শুনিয়েছেন সে সময়ে ক্যাপ্টেন আবিদের সাথে থাকা ফার্স্ট অফিসার রুপল নাদিম রসি।
সময়টা ছিল ২০১৬ সালের গ্রীষ্মকাল। কাল-বৈশাখি ঝড় হানা দেয় যখন তখন। এমন এক দিনে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশে উড্ডয়ন করে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের একটি উড়েজাহাজ। সেদিন আকাশ পথে ঝড়ের আনাগোনা দেখতে পান পাইলটরা। (পাইলটদের ভাষায় যাকে বলা হয় সিবি ক্লাউড)। এর মাঝে চট্টগ্রাম যাবার পথে একটা ফাঁকা জায়গা ছিলো। সে পথ ধরেই এগোনোর পরিকল্পনা করেন ক্যাপ্টেন আবিদ ও ফার্স্ট অফিসার রসি।
পাইলটরা আকাশে উঠে দেখতে পান আবহাওয়া খুব চ্যালেঞ্জিং। কৌশলে প্লেন নিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকেন তারা। সেদিন আকাশে অদ্ভূত ধরনের মেঘের আনাগোনা দেখতে পান রসি।
ফার্স্ট অফিসার রসির ভাষ্যমতে, সেদিন মেঘগুলো ছিলো ঠিক ফুলের পাঁপড়ির মতো। আর সেই ফুলের পাঁপড়ির মাঝেই দেখা যাচ্ছিল চট্টগ্রাম এয়ারপোর্ট। এয়ারপোর্টের আবহাওয়া ভালো ছিলো তবে কিছুটা বৃষ্টি ছিলো। কুমিল্লার দক্ষিণ দিক ও ফেনী দিয়ে চট্টগ্রামের দিকে এগোতে থাকে প্লেন। কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির পর দেখতে পাওয়া যায় চট্টগ্রামের পূর্ব দিকে কিছুটা ফাঁকা জায়গা, সেখানে মেঘ নেই। ততক্ষণে ৩৫ মিনিটের ফ্লাইট প্রায় ১ ঘণ্টা ছুঁয়ে গেছে। আবহাওয়াকে মোকাবিলার জন্য প্লেনে যথেষ্ট জ্বালনি ছিল এবং ক্যাপ্টেন আবিদ সেই পরিস্থিতি সামাল দিতে ছিলেন দক্ষ।
সে অবস্থায় ক্যাপ্টেন আবিদ প্লেনটিকে কক্সবাজার, রাঙামাটি ও বান্দরবানের উপর দিয়ে ঘুরিয়ে চট্টগ্রামে ঢোকার চেষ্টা করতে থাকেন। পূর্বের দিকে যেতে যেতে একটা সেমি সারকুলার পথ অনুসরণ করে চট্টগ্রামে ঢোকার চেষ্টা করা হচ্ছিল। কিন্তু সেই পথ অনুসরণ করে যেতে যেতে ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়। ওই পথে ফাঁকা জায়গাটি যে মেঘ দিয়ে পূর্ণ হচ্ছিল তা জানা ছিল না পাইলটেদের। কারণ প্লেন সেসময় অন্যমুখী। অার রাডারেও সে ভয়াবহ পরিস্থিতি ধরা পড়ছিল না।
কিন্তু দক্ষ পাইলট আবিদ তার পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে ফার্স্ট অফিসার রসিকে বলেছিলেন, এমনটা হতে পারে, এবং আমাদের হাতে যথেষ্ট সময় নাই।
এরপর প্লেনটি সেই মেঘশূন্য ফাঁকা জায়গাটির দিকে যেতেই দেখা যায় সেই ফাঁকা স্থানটিও প্রায় কালো মেঘে পূর্ণ হয়ে গেছে। পাইলট আবিদ সুলতান সেসময় ফার্স্ট অফিসার রসির সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেন পরবর্তী পদক্ষেপের। সেদিকে ৪০০০ ফিট উঁচু কোন পাহাড় না থাকায় সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্লেনটি ৪০০০ ফিট উচ্চতায় অবতরণ করে উড়তে থাকে।
ক্যাপ্টেন আবিদ সে সময় রসিকে জানান। কক্সবাজারের আবহাওয়া আরও খারাপ। আমরা সেদিকে যেতে পারবো না। কাজেই চট্টগ্রামে যেতে না পারলে ঢাকায় ফিরতে হবে তাদের। সেক্ষেত্রে জ্বালানি একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে দেখা দিয়েছিল। প্লেনে জ্বালানি ছিল ঠিক যতটা প্রয়োজন ততোটা। কারণ সে সময় বঙ্গপোসাগরের উপর দিয়ে ঘুরে বরিশালের কোল ঘেঁষে ঢুকতে হবে ঢাকায়। সেজন্য জ্বালানি সংক্রান্ত ঝুঁকিসহ নানাবিধ বিষয় বিবেচনা করে ক্যাপ্টেন আবিদের সামনে পথ খোলা ছিল একটিই। সেটি হলো বজ্র ঝড়ের মধ্য দিয়ে প্লেন চালিয়ে চট্টগ্রামে অবতরণ করা।
পাইলটদের মতে বজ্র ঝড় অতিক্রম করা অনেক হিসাবের বিষয়। পরিস্থিতি মোকাবিলায় রসিকে তার পরবর্তী কার্যাবলীর নির্দেশনা দিয়ে অাবিদ সিদ্ধান্ত নেন বজ্র ঝড় ভেদ করে ঢোকার। ফার্স্ট অফিসার রসিকে সাহস যোগান ভয় না পেতে। আবিদের চোখে-মুখে সেসময় ভয়ের লেশমাত্রও দেখতে পাননি নবীন অফিসার রসি। আর আবিদের সে নির্ভয়, শান্ত, স্থির ব্যক্তিত্ব অন্যরকম এক সাহস যুগিয়েছিলো রসিকে।
যাত্রীরা ক্রু’দের নির্দেশনা মোতাবেক প্রস্তুতি নেন ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলার।
ফাস্ট অফিসার রসির ভাষ্যে, ‘ঝড় কবলিত সে স্থানে প্লেন চালিয়ে দেন ক্যাপ্টেন আবিদ। শুরু হয় প্রচণ্ড ঝাঁকুনি। সেই ঝাঁকুনির মধ্যে সিটে বসে থাকাই দায় ছিল। তার মধ্যে শক্ত হাতে আবিদ কন্ট্রোল করছিলেন প্লেন। সে অবস্থাটি ছিলো পুরোপুরি শ্বাসরুদ্ধকর। ঝড়ের তীব্রতা ছিলো প্রচণ্ড। সে অবস্থায় প্লেন কন্ট্রোল করা ছিলো খুবই কঠিন। কিন্তু ক্যাপ্টেন আবিদ দক্ষতার সাথে সক্ষম হয়েছিলেন পরিস্থিতি মোকাবিলায়।’
প্রায় ৪০ সেকেণ্ডের সেই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি শেষে স্বাভাবিক অবস্থায় আসে প্লেন। সে সময় চট্টগ্রামের কন্ট্রোল টাওয়ার থেকে বলা হয় ‘বাংলা স্টার রিপোর্ট ইওর ইনটেনশন’।
রসির দিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন আবিদ মৃদু হাসলেন, রসি তখন উত্তর দেন ‘উই ইনটেন্ড টু ল্যান্ড স্যার’।
শত প্রতিকূলতা ও ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলা শেষে নিরাপদে অবতরণ করে প্লেনটি।
সেদিন প্লেনে আর্মি, বিজিবি, ইন্ডিয়ান বিএসএফের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন। চট্টগ্রামে একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে অংশ নিতে গিয়েছিলেন তারা। নিরপদ অবতরণের পর যাত্রীরা যখন বুঝতে পেরেছিলেনে পাইলটের দক্ষতায় নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছেন তারা, তখন প্রচণ্ড উল্লাসে হাততালি দিয়ে হর্ষধ্বনির সাথে উদযাপন করেন সে মুহূর্ত ।
সবাই এসে পাইলট আবিদ ও তরুণ ফার্স্ট অফিসার রসিকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন সেদিন।
৩৫ মিনিটের ফ্লাইট সেদিন শেষ করতে সময় লেগেছিলো ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট।
আবতরণের পর পাইলট আবিদ রসিকে তার প্রিয় ডায়ালগটি বলেছিলেন: ‘গুড জব ম্যান’ এবং রসির প্রশংসা করেছিলেন ভয়াবহ সেই পরিস্থিতিতিতে শান্ত থাকার জন্য।
বাংলাদেশে যে কয়জন অনুকরণীয় ও অনুসরণীয় পাইলট রয়েছেন তাদের মধ্যে ক্যাপ্টেন আবিদ অন্যতম।
আবিদ সুলতান ১৯৮২ সালে ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ থেকে এসএসসি এবং ১৯৮৪ সালে একই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। এরপর বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে জিডিপি শাখায় কমিশন লাভ করেন।
তিনি স্কোয়াড্রন লিডার হিসেবে অবসর নিয়ে পরবর্তীতে ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সে এ পাইলট হিসেবে যোগ দেন।