ছোটবেলায় দাদির মুখে অনেক শ্লোক শুনতাম। তন্মধ্যে একটা ছিল এমন: ‘একবারে দুঃখী, দুইবারে সুখী, তিনবারে রুগী।’ তখন এর মর্মার্থ না বুঝলেও বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুঝতে শুরু করলাম। এখানে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেয়ার কথা বলা হয়েছে। দিনে একবার উহা সম্পাদন করলে আপনি হবেন দুঃখী, আর দুইবার সম্পাদন করলে আপনি হবেন সুখী আর তিনবার প্রসাধন কক্ষে যেতে হলে বুঝতে হবে আপনাকে অতি সত্তর কবিরাজের শরণাপন্ন হতে হবে। এটা বহুদিন ধরে চলে আসা গ্রাম বাংলার অতি পরিচিত শ্লোক। ডাক্তারি বিদ্যাতেও এর ব্যাখ্যা পাওয়া যায় এবং তারাও এর বিষয়বস্তুর সাথে সহমত পোষণ করেছেন।
তবে আজ আমরা প্রথম দলের লোকদের নিয়ে একটু হাস্যরসাত্মক বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করবো। আপনি যদি দিনে একবার সাড়া দেন তাহলে আপনি থাকবেন দুঃখী। মনে হবে কি যেন একটা আজ করা হয় নাই। মনের মধ্যে সারাক্ষণ একটা অস্বস্তি কাজ করবে। এবং দ্বিতীয়বার কাজটা করতে না পারার কারণে আপনার মনে সবসময়ই একটা দুঃখ দুঃখ ভাব কাজ করবে। আপনি কোন কাজেই মনোনিবেশ করতে পারবেন না। এই ভাবনা থেকে আপনার কপালে ভাঁজ পড়বে। বাইরের কেউ আপনার কপালের এই ভাঁজ দেখেই বুঝে ফেলবে আজ আপনার প্রাকৃতিক কর্ম সঠিকভাবে সম্পাদন হয় নায়। আপনার আচরণে রুক্ষতা পরিলক্ষিত হবে। আপনার স্বভাব হয়ে যাবে দিনে দিনে রগচটা। আপনি দ্রুতই কোন কিছুতে রেগে যাবেন। পরিবার পরিজনের সাথে আপনার ব্যবহার হয়ে যাবে কাঠ খোট্টা। আপনার মুখে হাসির পরিবর্তে লেগে থাকবে এক ধরণের আলগা গাম্ভীর্য।
প্রকৃতির ডাকের কথা যেহেতু অবধারিতভাবে চলেই আসলো তাহলে উহার তাড়না বিষয়ে কিঞ্চিৎ আলোকপাত করার প্রয়োজন বোধ করছি। উহার আবেগ (আসলে হবে বেগ) প্রতিরোধ করে এমন পদ্ধতি এখন পর্যন্ত মানবকুল আবিষ্কার করতে সমর্থ হয় নাই। গ্রামে আমরা এই বেগ আসলেই দৌড় দিয়ে বাড়ির পিছনের কাশবনে চলে যেতাম তারপর শান্তি আর শান্তি। দিনের বেলায় কাশবনে যাওয়া নিয়ে তেমন একটা ভয় কাজ করতো না তবুও আমরা যারা একসাথে খেলাধুলা করতাম তারা একজন অন্যজনকে সঙ্গ দেয়ার জন্য একসাথে সবাই মাইল কাশবনে ঢুকে পড়তাম। এরপর সবাই মিলে বৃত্তাকারে বসে প্রাকৃতিক কর্ম সম্পাদন।
ব্যাপারটা এমন না যে সবারই একসাথে চাপ এসেছিল। কিন্তু যাদের আসে নাই তারাও একই ভঙ্গি করে বসে পড়তাম যদি ইতোমধ্যে চাপ চলে আসে। তারপর ঠিক করা হত কর্ম সম্পাদনের পর কি কি করা হবে। কর্ম সম্পাদনের পর পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা নিয়ে ভাবার অবকাশ ছিল না। যেহেতু চারিদিকে শুধু বালি আর বালি আমরা আমাদের পশ্চাৎদেশটা শুধু বালির সাথে ঠেকিয়ে কয়েক সেন্টিমিটার টেনে নিয়ে যেতাম বাকি কাজটা বালিই সেরে দিত। কিন্তু আমাদের মধ্যে যাদের কোষ্ঠকাঠিন্য ছিল তারা বিশেষ ভঙ্গিতে বসে বিভিন্নভাবে চাপ নিয়ে আসার চেষ্টা করতাম। মুখ বাকিয়ে, চোখ পাকিয়ে হাত দিয়ে উদরে চাপ দিয়ে চাপ আনার চেষ্টা করতাম তখন তাকে দেখতে হাল জমানার মিস্টার বিনের মত দেখাতো। আমরা তখন মনেমনে আমাদের সেই বন্ধুটার জন্য দুঃখ বোধ করতাম।
তবে যদি কাহারো কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতো সেটা আবার আমরা অভিভাবকদের বলতাম না। কারণ এর চিকিৎসার ফলাফলটা একটু মারাত্মক ছিল। চিকিৎসা পদ্ধতিও খুবই সোজা ছিল আর ফলাফলও ছিল অবধারিত। কিছুই না খাবারের সাথে আমাদের মায়েরা একেবারেই যৎসামান্য “জামাল কোঠা” নামে পরিচিত গাছের রস মিশিয়ে দিতেন। এরপরের ঘটনা ছিল ভয়াবহ। অনেকদিনের চাপ আমাদের কিশোর স্লুইস গেট নিতে পারতো না। তাই একটু পর পর চাপ আসতো। আর আমরা সারাদিন সেই চাপ মুক্ত করে বেড়াতাম। কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই কাশবনে যাবার আগেই স্লুইস গেটে ছিদ্র দেখা দিত। তখন বাড়ির উঠোনকেই কাশবন কল্পনা করে চাপমুক্ত হতাম। আর আমরা চোখ বন্ধ করে রাখতাম যাতেকরে আমাদেরকে কেউ দেখে না ফেলে। আর একেবারে ছোটদের জন্য ছিল একটা মজার চিকিৎসা। পানের বোটাতে তেল মাখিয়ে সেটা দিয়ে চাপ কমানোর চেষ্টা করা হত। গ্রামদেশে মনেহয় বাচ্চাদের কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসা হিসেবে এখনও এই পদ্ধতিটা ব্যবহৃত হয়।
এতো গেল শিশু কিশোরদের চাপের কথা এইবার একটু বড়দের চাপের কথা বলি। আমরা যখন বাড়ির পিছনের কাশের বনে চাপ মুক্ত হতে যেতাম তখন আমাদের একজন খালু যিনি পাশের বাড়িতেই থাকেন উনার দেখা পেতাম। আমরা খেতে ঢোকার সময় দেখতাম খালুজান বা হাতে লুঙ্গির গিট্টু ধরে আছেন আর ডান হাতে কাঁসার বদনা। পুরো শরীরটার মধ্যে কোন নড়াচড়া নাই। নড়ছে শুধু পা দুটো। দেখতে অবিকল একটা চলমান মূর্তির মত দেখাতো। তারপর এক সময় উনি বনের মধ্যে ঢুকে পড়তেন আর আমরা বাইরে থেকে উনার চাপ অবমুক্ত হওয়ার আওয়াজ পেতাম। উনাকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল বাড়িতে পাকা প্রসাধন কক্ষ থাকা স্বত্বেও উনি কেন বোনের মধ্যে চাপ অবমুক্ত করেন? উনি বলেছিলেন প্রসাধন কক্ষে গেলে উনার চাপ না কি উবে যায়। কেমন জানি দমবন্ধ লাগে। তাই উনি অনেকবার চেষ্টা করার পর না পেরে আগের মতই বনে চাপ অবমুক্ত করেন।
ভোরবেলা পদব্রজে ভ্রমণ করা আমাদের অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল একসময়। গন্তব্য ছিল বাড়ির পিছনের বিশাল সবুজ প্রান্তর। তার মধ্যে দিয়ে দুটো রাস্তা সাপের মত যেয়ে একটা জায়গায় মিলিত হয়ে একটা হয়ে সামনের দিয়ে এগিয়ে গেছে। প্রতিদিনই আমরা রাস্তার পাশে এক বড় ভাইকে দেখতাম উনার পশ্চাৎদেশ অবমুক্ত করে উদাস দৃষ্টিতে বাতাসের দিকে চেয়ে আছেন। আমরা পাশ দিয়ে হেটে যাচ্ছি উনার সেদিকে কোন খেয়াল নেই। উনি চাপ অবমুক্ত করায় ব্যস্ত। উনার চাহনির মধ্যে এমন একটা ভাব ছিল যেন উনি আর তখন এই ভূমণ্ডলে নেই। উনাকে দেখাতো অনেকটা গভীর ধ্যানমগ্ন ঋষিদের মত। কিন্তু আমাদের খুবই লজ্জা লাগতো। তাই একদিন উনাকে আমরা কজন বেশ শক্ত করে ধরে বসলাম ফেরার পথে ততক্ষণে উনার চাপ মুক্ত হয়ে গেছে। উনি আমাদের বললেন শোন এই যে আমি খোলা ময়দানে চাপ অবমুক্ত করছি এটা কিন্তু কোন প্রকার গন্ধ ছড়াচ্ছে না। আমি এটাকে ছাড়ার সাথে সাথে সেটা উদ্বায়ী পদার্থের গতিতে আকাশে চলে যাচ্ছে সেখানে যেয়ে গন্ধ ছড়াচ্ছে। আমরা উনার উত্তর শুনে বাকরুদ্ধ হয়ে উনাকে ছেড়ে দিলাম এবং বুঝলাম উনাকে খোলা ময়দানে চাপ অবমুক্ত করা থেকে ঠেকানো সম্ভব নয়।
লেখা বড় হয়ে যাচ্ছে আর আমিও ভাইয়ার গন্ধ ছড়ানোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মত আসল বিষয়বস্তু থেকে অনেক দুরে সরে এসেছি। পৃথিবীর বুকে শুধু শিশু এবং পাগলরাই অকারণে হাসতে পারে তাই তাদের কোন দুঃখ থাকে না। আসলে অকারণে হাসতে পারা অনেক বড় গুণ। কিন্তু আমরা যতই বড় হতে থাকি জাগতিক বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের জড়িয়ে ফেলে সুন্দর করে হাসতে ভুলে যায় তখন আমাদের দেখায় কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা রুগীর মত। জীবনে সবারই কম বেশি ঝামেলা থাকবেই কিন্তু তার মধ্যে থেকেই আমাদের আনন্দ খুঁজে নিতে হবে। নিজের যে সমস্যাগুলো সমাধানযোগ্য সেগুলোর দ্রুত সমাধান করে ফেললে আপনি চাপমুক্ত হয়ে আবার প্রাণখুলে হাসতে পারবেন। আর যে সমস্যাগুলোর সমাধান আপনার হাতে নেই সেগুলো নিয়ে ভেবে সময় নষ্ট করার কোনই মানে হয় না বরং সেগুলোর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারলে জীবনটাকে মধুর মনে হবে। দোয়াকরি পৃথিবীর সকল মানুষ কোষ্ঠকাঠিন্যের চাপ থেকে মুক্ত হয়ে শিশুদের মত হাসতে শিখুক।