যাত্রা, উত্তরের খেপ, দলিল, পিঙ্গল আকাশ এবং ভালোবাসা কারে কয়-এর মতো অসংখ্য উপন্যাস লিখেছেন কথাসাহিত্যিক, সাংবাদিক ও শিক্ষক শওকত আলী। তবে তার লেখা ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ উপন্যাসটি ছাপিয়ে গেছে তার অন্য লেখাগুলোকেও। এমনকি বাংলা সাহিত্যের বহুল আলোচিত ও প্রশংসিত উপন্যাসগুলোর মধ্যে তাঁর লেখা বইটি ঠাঁই করে নিয়েছে। বাংলা ভাষাভাষি পাঠক মাত্রই জানেন ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’-এর মূল্য!
সদ্য প্রয়াত শক্তিমান এই কথা সাহিত্যিকের লেখা উপন্যাস ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ নিয়েই সোশাল সাইটে কথা বলছেন অনেকেই। তারমধ্যে ছাত্র ইউনিয়নের সাবেক নেতা মনোয়ার মোস্তফা শওকত আলীর ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন। জানিয়েছেন, বঙ্কিমের কোনো লেখার পরে বাংলা সাহিত্যে সবচেয়ে বেশিবার পড়া বইয়ের নাম ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’। শুধু তাই নয়, সাবেক এই ছাত্রনেতা শওকত আলীর জবানীতেই ফেসবুকে কোড করেছেন যে তাড়নায় ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ লিখেছিলেন শওকত আলী। পাঠকদের জন্য মনোয়ার মোস্তফার ফেসবুক স্ট্যাটাসটি হুবুহু তুলে ধরা হলো:
‘‘আমাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, শুধু উপন্যাস নয়, সব মিলিয়ে ১০ বইয়ের নাম বলো, যেগুলো তোমার চিন্তায় কোন না কোনভাবে রেখাপাত করেছে- আমি চোখ বুঝে ‘প্রদোষে প্রকৃতজন’র নামটা বলে দেব।
বঙ্কিমের পরে উপন্যাসের মধ্যে এইটাই সম্ভবত আমি সবচেয়ে বেশি বার পড়েছি। ১৯৮৮ সালের পর থেকে এই বইটাই সবচেয়ে বেশি কিনেছি, বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বন্ধু-বান্ধবদের উপহার দেবার জন্য।
১৯৮৪ সালে ইউপিএল এই বইটা বের করেছিল। ৮৩ সালে বিচিত্রায় ধারাবাহিকভাবে ছাপা হচ্ছিল। এর আগে কখনো ইউপিএল সম্ভবত কোন উপন্যাস প্রকাশ করেনি। ইউপিএল কর্মকর্তা নাজির ভাইয়ের কাছ থেকে এই উপন্যাস প্রকাশের পেছনের কাহিনী শুনেছি, বহুপরে।
যে প্রশ্ন শওকত আলীকে এ উপন্যাস লিখতে তাড়িত করেছিল, সেটা তার জবানিতেই শুনুন:
“উপন্যাসটি লেখার চিন্তাটা এ কারণেই এসেছিল যে দক্ষিণ এশিয়ার এই প্রান্তে মুসলমানের সংখ্যা এত বেশি হওয়ার কারণ কী? এটা ছিল আমার একটা প্রশ্ন। মুসলমান যারা দিগ্বিজয় করতে এসেছে তারা তো ওইদিক দিয়ে এসেছে। তারপর মোগল-পাঠানরাও ওইদিক দিয়ে এসেছে। এটা কিন্তু অবাস্তব কৌতূহলের কিছু নয়। একসময় মুসলমানরা এখানে আধিপত্য করছে, তারা শাসন করেছে ৪০০ বছর। তারা ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও ওইসব অঞ্চলে মুসলমানের সংখ্যা বাড়েনি। এখানে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। এ সম্পর্কে আমি অনেককে জিজ্ঞেস করেছি, বইপত্র পড়েছি।…….. একসময় শেখ শুভদয়া নামে একটি সংস্কৃত বই হাতে আসে। কেউ বলেছে সেন রাজত্বের পরপরই ওটা লেখা হয়েছিল। শেখের শুভ উদয়_এই অর্থে। শেখ মানে মুসলমান। ওই বইয়ের মধ্যে কিছু কিছু গল্পের মতো পেয়েছি। যেমন একটা দৃশ্য ওখানে পেয়েছি যে অশ্ব বিক্রেতারা নৌকায় চড়ে অশ্ব বিক্রি করতে এসেছে। অশ্ব বিক্রি হয়ে গেছে। সন্ধ্যা সমাগত। তখন ছয়-সাতজনের মধ্যে বয়োজ্যেষ্ঠ যিনি, তিনি উন্মুক্ত প্রান্তরে দাঁড়িয়ে পশ্চিম দিকে মানে সূর্য অস্তের দিকে তাকিয়ে কানে হাত দিয়ে উচ্চৈঃস্বরে কাকে যেন ডাকছেন। তারপর এক জায়গায় গোল হয়ে বসে প্রভু-ভৃত্য সবাই আহার গ্রহণ করছেন এক পাত্র থেকে। আহার শেষে একজন সামনে দাঁড়িয়ে মন্ত্র পাঠ করছেন, তারপর উবু হয়ে থাকছেন, অবশেষে প্রণাম করছেন, তিনি যা যা করছেন পেছনের সবাই তাঁকে অনুসরণ করছে। সামনে যিনি ছিলেন তিনি কিন্তু প্রভু নন; ভৃত্য। তবু সবাই তাঁকে অনুসরণ করছে। আমি এই দৃশ্যটা আমার প্রদোষে প্রাকৃতজন’র মধ্যে ইচ্ছে করেই দিয়েছি। এ ঘটনাগুলো পড়ে আমার মনে হয়েছিল এ উপাদানগুলো নিয়ে একটা উপন্যাস লিখলে কেমন হয়। এ রকম একটা দৃশ্য যদি দেখে সাধারণ মানুষ, যে মন্দিরের ছায়ায় অচ্ছুত নিম্নবর্গের সাধারণ মানুষের পা যেন না পড়ে সে জন্য সকালে মন্দিরের পশ্চিম পাশের এবং বিকালে মন্দিরের পূর্ব দিকের রাস্তা দিয়ে নিম্নবর্গীয় মানুষের চলাচল বন্ধ, তাহলে তাদের মনে প্রতিক্রিয়া কী হবে? এ রকম একটা অবস্থা সেখানে ছিল। এরপর যখন যবনরা এল, তারা একসঙ্গে বসে, একসঙ্গে ওঠে, একসঙ্গে খায়, প্রভুর উপাসনা করে। আমার নিজের মনের থেকে ধারণা হলো এ অঞ্চলে নিম্নবর্গের মানুষ সবচেয়ে বেশি ছিল এবং এখানে সবাই যবন ধর্ম গ্রহণ করেছিল। এর কিন্তু কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ আমি দিতে পারব না। এটা আমার অনুমান। এই ভিত্তিতে আমি উপন্যাসে এই উপাদানগুলো ব্যবহার করেছি।”
শওকত আলীর মনে যখন বাংলায় মুসলমানদের আগমন নিয়ে এসব প্রশ্নের উদয় হচ্ছিল, তখনো এ সংক্রান্ত উচ্চমানের কোন গবেষণা প্রকাশিত হয়নি। বিশেষ করে সুরজিৎ সিং কিংবা ইটনের বই উনার হাতের কাছে ছিল না। কল্পনা দিয়ে এগিয়ে নিয়েছেন উপন্যাসের কাহিনী। ইতিহাসকে বেধে ফেলেছেন, কল্পনার জালে। এই না হলে উপন্যাসিক !!
‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’র মতো শওকত আলীও আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন।’’