কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিপীড়ন-হয়রানি বন্ধ, গ্রেপ্তারকৃত শিক্ষার্থীদের মুক্তি এবং হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
রোববার সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার পর্যন্ত পদযাত্রা করেন ‘নিপীড়নবিরোধী শিক্ষকবৃন্দ’। পরে শহীদ মিনারের পাদদেশে এক সমাবেশ থেকে ৫ দফা দাবি জানান শিক্ষকরা।
শিক্ষকদের পক্ষ থেকে দাবি উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গনযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরীন।
দাবিগুলো হচ্ছে-
১. সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সকল হামলাকারীর বিচার
২. আক্রান্ত শিক্ষার্থীদের নামে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার
৩. সরকারিভাবে আক্রান্তদের চিকিৎসার ব্যবস্থা
৪. নারী আন্দোলনকারীদের শারীরিক ও সাইবার যৌন নিপীড়নের বিচার
৫. দ্রুত কোটা সংস্কারের প্রতিশ্রুত প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে দেয়া।
শিক্ষকদের এই কর্মসূচিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয় ও ইন্ডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩০-৩৫ জন শিক্ষক অংশ নেন। সাথে ছিলেন প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীও।
সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরেটাস অধ্যাপক ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘যে ঘটনার জন্য আমরা এখানে দাঁড়িয়েছি তা দুঃখজনক তো বটেই লজ্জাজনক এবং অবিশ্বাস্য। বাংলাদেশে এমন ঘটনা ঘটবে তা আমরা কখনো ভাবিনি। এটা পাকিস্তান আমলে ঘটেনি, ব্রিটিশ আমলেও ঘটেনি।’
কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন তা ‘যৌক্তিক এবং ন্যায়সঙ্গত’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘আন্দোলন যখন চলছিল তখন সমাজের সকল অংশ যেভাবে তাদের সমর্থন দিয়েছিল তাতেই বোঝা যায় শতকরা ৫৬ ভাগ কোটা অসন্তোষজনক। সরকারও সেটা স্বীকার করেছে। সরকার সেটা স্বীকার করে কমিটি গঠন করবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কমিটি গঠনে বিলম্ব করেছে, বিলম্ব করার কারণে আবার আন্দোলন হয়েছে। এই আন্দোলন যদি তারা অব্যাহত না করতো তাহলে কমিটি গঠন হতো না।’
শিক্ষকদের ৫ দফা দাবির সাথে সমর্থন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর নিপীড়ন করা হয়েছে, অভিভাবক ও শিক্ষকরা যখন তাদের জন্য দাড়ালো তাদের ওপরও নিপীড়ন চালানো হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হাতুড়ি দিয়ে যে নৃশংসতা চালানো হয়েছে, এধরনের নৃশংসতা আমরা আগে কখনো দেখিনি। যারা আহত হয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই মামলা দেয়া হয়েছে, রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। যে দাবি উপস্থাপন করা হয়েছে তার সাথে আমার পূর্ণ সমর্থন আছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. গীতি আরা নাসরিন বলেন, ‘বাংলাদেশ যে তৈরী হয়েছে এবং বাংলাদেশ তৈরী হবার সূচনা হয়েছিলো ১৯৪৮ সালে তখন তখন যে ‘না না না’ উচ্চারিত হয়েছে তা কিন্তু হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এই যে না বলার শক্তি, এই না বলা থেকেই বিভিন্ন আন্দোলন হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা বের হয়ে এসেছিলেন, গড়ে তুলেছিলেন এই শহীদ মিনার, ১৯৭১ সালে ভেঙ্গে ফেলা হয়েছিল, তা আবার গড়া হয়েছে সেই শহীদ মিনারের সামনে আমরা দেখেছি প্রতিবাদরত একজন শিক্ষার্থীকে কিভাবে নির্যাতন করা হয়েছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের সাথে ছিলেন, আরো বেশী থাকবেন।’
ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক তাসনিম সিরাজ বলেন, ‘ভিন্ন মতাবলম্বীদের গলা চেপে ধরার প্রবণতা আমরা এর প্রতিবাদ জানাতে চাই৷ শিক্ষকরা ছাত্রদের পক্ষে দাঁড়ানো উচিত ছিলো যারা তাদের ন্যায্য দাবির পক্ষে আন্দোলন করছে। কিন্তু আমরা অনেকেই দলীয় স্বার্থের উঠতে পারিনি। কিন্তু কোন একটা গোষ্ঠীর জন্য আমরা সেখানে ছাত্রদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছি। আমরা কি স্বাধীন দেশে আছি? যদি স্বাধীন দেশেই থাকতে তাহলে ছাত্রদের বা শিক্ষকদের যারা এটার পক্ষে অংশগ্রহন করছে তাদেরকে হুমকি বা ধমকি পেতে হতো না।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সম্প্রতি অবসর নেয়া অধ্যাপক আখতার হোসেন বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের যে আন্দোলন করছে, তাকে চিত্রিত করা হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা বিরোধী হিসেবে। তাদেরকে বলা হচ্ছে বিএনপি-শিবির দ্বারা প্ররোচিত। বাংলাদেশ ফ্যাসিস্ট ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে চলছে। আজকে ছাত্ররা যে ন্যায় সঙ্গত দাবি করছে এর বিরুদ্ধে যারা অবস্থান করছে, শিক্ষক, প্রশাসনের কর্তা এবং রাজনৈতিক নেতারা যারা আছেন, তাদের প্রত্যাখ্যানের ভাষা নিন্দনীয়। একটি তরুণকে যখন চিকিৎসা নিতে গেলে সরকারী, বেসরকারী হাসপাতাল থেকে বের করে দেয়া হয় তাহলে আমরা বুঝি বাংলাদেশে গণতন্ত্র কোন পর্যায়ে আছে।’
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. তানজীম উদ্দীন খান বলেন, ‘কোটা সংস্কার আন্দোলনের শিক্ষার্থীদের ওপর যেভাবে নিপীড়ন করা হয়, আমাদের উচিত ছিল আগেই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ানো। আমরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখলাম কিভাবে ছাত্রদের পিঠে হাতুড়ি মারা হচ্ছে। এই হাতুড়ি আসলে পিঠে মারা হয়নি বাংলাদেশের মেরুদণ্ডে মারা হয়েছে।’
ইউল্যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর কাজী আফসার হোসেন বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের তিনটি ঘোষিত নীতি ছিলো। সাম্য, মানবিক মর্যাদা এবং ন্যায়বিচার। কোথায় সাম্য যখন বাংলাদেশের মানচিত্রের ওপর হাতুড়ি পড়েছে, সংবিধানের ওপর হাতুড়ি পড়েছে এবং জনগণের অধিকারের ওপর হাতুড়ি পড়েছে। কোথায় সাম্য, কোথায় ন্যায়বিচার?’