কোটা ব্যবস্থার সংস্কার না হলে বাংলাদেশ মেধাহীনদের হাতে চলে যাবে- এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে কোটার বাইরে থাকা চাকরিপ্রার্থীরা বলছেন, এই ব্যবস্থা মেধাবীদের জন্য আজ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোটার কারণে বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় প্রতিনিয়ত পিছিয়ে পড়ছেন তারা।
এমন প্রেক্ষাপটে চাকরিতে পিছিয়ে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীরা এখনই কোটা পদ্ধতির সংস্কার জরুরি বলে মনে করছেন।
কোটার জাল থেকে মুক্তি পেতে বিশেষজ্ঞদের পাশাপাশি সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি) বিভিন্ন সময় সুপারিশ করে এলেও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই সরকারের।
খোদ পিএসসি এই পদ্ধতিকে সরলীকরণের তাগাদা দিয়ে বলেছে, এটি অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও সময় সাপেক্ষ। শতভাগ নিখুঁতভাবে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন এর মাধ্যমে প্রায় অসম্ভব।
দেশব্যাপী কোটা বিরোধী আন্দোলনের মুখে কোটার ভিত্তিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে সম্প্রতি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাতে বলা হয়, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় কোটাভুক্ত উপযুক্ত প্রার্থী পাওয়া গেলে সেইসব পদ খালি না রেখে মেধার ভিত্তিতে পূরণ করতে হবে।
তবে সেখানে সামগ্রিকভাবে পিএসসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইনের নেতৃত্বে যেসব সংস্কারের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছিল সেগুলো আমলে নেয়া হয়নি।
ওই প্রজ্ঞাপনকে কেউ কেউ মন্দের ভালো হিসেবে মন্তব্য করলেও আদৌ তা বাস্তবায়ন হবে কী না- তা নিয়ে সন্দিহান সাধারণ শিক্ষার্থীরা। বরং কোটা ব্যবস্থার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার চেয়েছেন তারা।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকাদের একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমবিএ ব্যাংকিং এন্ড ইন্স্যুরেন্স শেষবর্ষের শিক্ষার্থী মুহাম্মদ রাশেদ খাঁন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, মেধাহীন, অযোগ্য, অদক্ষ লোক দিয়ে কখনো দেশ চলতে পারে না। ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা দিনের পর দিন বেড়েই চলেছে। তাদের ছেলে-মেয়েসহ নাতি-নাতনীরাও বিভিন্ন নিয়োগের ক্ষেত্রে সুবিধা নিচ্ছে।
‘এছাড়া তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকুরিতে নিয়েগের ক্ষেত্রে পুরোপুরি কোটায় অথবা দুর্নীতির মাধ্যমে নিয়োগ দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে পুরোপুরি অবমূল্যায়ন করা হয় মেধাকে যা খুবই দু:খজনক।’
সম্প্রতি কয়েকটি নিয়োগ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, হাউজ বিল্ডিং করপোরেশনে নিয়োগে ৫০টি পদের মধ্যে কোটার কারণে শূন্য রয়ে গেছে ১১টি পদ। একইভাবে ২০১৬ সালের সোনালী ব্যাংকে নিয়োগ পরীক্ষায় আইটি অফিসার ৭০০টি পদের মধ্যে ২০৫টি পদে কোনো যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি।
এছাড়াও ২০১৭ সালের সাব-রেজিস্ট্রার পরীক্ষায় ৪৯টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ১২টি পদ। উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা-এটিইও’র ১৭২টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ৪৭টি পদ।
কোটা সংস্কারের দাবিতে ৫ দফা:
কোটা ব্যবস্থা সংস্কার করে বর্তমানে সংরক্ষিত ৫৬ শতাংশ কোটাকে ১০ শতাংশে নিয়ে আসতে হবে, কোটায় কোনো ধরনের বিশেষ নিয়োগ পরীক্ষা নেয়া যাবে না, চাকরী নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না, সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে সবার জন্য অভিন্ন কাট মার্কস ও বয়সসীমা নির্ধারণ করতে হবে এবং কোটায় যোগ্যপ্রার্থী পাওয়া না গেলে শূন্য থাকা পদগুলো মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ দিতে হবে।
বর্তমান ব্যবস্থায় চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও নাতি-নাতনীদের জন্য। নারী ও জেলা কোটা ১০ শতাংশ। প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ, ৫ শতাংশ কোটা রাখা হয়েছে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য।
বাকি ৪৪ শতাংশ বিপুল সংখ্যক প্রার্থীর জন্য বরাদ্দ। যা দু:খজনক বলে মন্তব্য করছেন চাকরি প্রত্যাশীরা।
কিছুদিন আগে পিএসসি জানায়, নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ইংরেজিতে দক্ষতা দেখে নিয়োগ দেয়া হবে। তা না হলে দক্ষ ও যোগ্য আমলা পাওয়া যাচ্ছে না।
সেই সুরে সুর মিলিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘কোটা থেকে বেশিরভাগ প্রার্থী নিয়োগের কারণেই পাওয়া যাচ্ছে না যোগ্য প্রার্থী। এমন চলতে থাকলে একসময় মেধাশূন্য হয়ে পড়বে দেশ।’
বর্তমানে প্রশাসনে কর্মরত উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বেশিরভাগই মুক্তিযোদ্ধা হওয়ায় কোটা সংস্কারের বিষয়ে তারা আগ্রহী নন বলে অভিযোগ সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের।
কোটা ব্যবস্থার তীব্র বিরোধীতা করে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান চ্যানেল অাই অনলাইনকে বলেন: ‘কোটা পৃথিবীর কোথাও কোনো চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়। সময়ের প্রয়োজনে এটা অবশ্যই পরিবর্তনশীল। শুধু বাংলাদেশে এর ব্যতিক্রম।’
১৯৭২ সালে চালু হওয়া কোটা ব্যবস্থা ৪৬ বছর ধরে চলছে উল্লেখ করে এ শিক্ষাবিদ বলেন: ‘এত বছর ধরে কোটা ব্যবস্থা চালু রেখে কী লাভ হয়েছে বা কী ক্ষতি হয়েছে তার কোনো হিসাব-নিকাশ রাখা হয়নি।’
সংবিধানে কোটা ব্যবস্থা দেয়া হয়েছিল মূলত অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জন্য। বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অগ্রসর ও অনগ্রসর দু’ধরণের যোদ্ধাই রয়েছেন। যারা যু্দ্ধাহত, ভাতার উপর নির্ভরশীল, অসুস্থ, দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা তারা অনগ্রসর হিসেবে বিবেচ্য।
এ বিষয়ে আকবর আলি খান বলেন: ‘অনগ্রসর, সুবিধাবঞ্চিত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কোটা প্রযোজ্য হতে পারে। কিন্তু আমি মুক্তিযোদ্ধা। আমার সন্তানরা যদি কোটা ব্যবহার করে তাহলে তা হবে অগ্রসর জনগোষ্ঠীর ব্যবহার। যা সংবিধানের কোথাও উল্লেখ নেই।’
অনির্দিষ্টকাল কোটা পদ্ধতি চলতে পারে না উল্লেখ করে তিনি বলেন: ‘বঙ্গবন্ধু যে কোটা পদ্ধতি চালু করেন তখনকার প্রেক্ষাপটে তা বাস্তবায়নযোগ্য এবং সেটি ১৭টি জেলার জন্য সুনির্দিষ্ট ছিল।’
কিন্তু বর্তমানে সেই ১৭টি জেলার কোটা ৬৪ জেলায় বিস্তৃত করা হয়েছে। এবং বাংলাদেশে বর্ত মানে ২৫৮ ধরণের কোটা চালু রয়েছে যা ভীষণ জটিল ও নিয়েগের ক্ষেত্রে সময়ক্ষেপনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষাবিদরা মনে করেন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর জনগণ অগ্রসর হবার পর কোটা ব্যবস্থার আর প্রয়োজন নেই। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর কোটার মূল্যায়নের বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন তারা। আদৌ কোটা প্রয়োজন কী না।
তবে সাধারণ চাকরি প্রার্থীদের দাবি কোটা ব্যবস্থা বাতিল নয়, এর সংস্কার। তাদের বক্তব্য কোটা ব্যবস্থার সংস্কার না হলে লাখ লাখ মেধাবী ছেলে-মেয়ে তাদের কাঙ্খিত লক্ষ্যে পৌঁছতে না পেরে হতাশ হয়ে পড়ছে। তাতে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে দেশ। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে জাতি।