কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীদের সাথে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় না এসে তাদের ক্ষোভকে আরও বাড়িয়ে দেয়া খুবই আত্মঘাতী হয়েছে। দেশব্যাপী শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিল। সড়ক ও রেলপথ অবরোধ করেছে তারা। রাজধানীর শাহবাগ ছাড়িয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল কোটা সংস্কারের এই আন্দোলন।
বর্তমানে চাকরির জন্য সংরক্ষিত কোটার পরিমাণ শতকরা ৫৬ ভাগ। বাকি ৪৪ ভাগ নেয়া হয় মেধার ভিত্তিতে।বিসিএসে নিয়োগের ক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধা কোটায় শতকরা ৩০ ভাগ, জেলা কোটা ১০ ভাগ, নারী কোটা ১০ ভাগ ও উপজাতি কোটায় ৫ ভাগ ভাগ সংরক্ষণ করা রয়েছে। এই ৫৫ শতাংশ কোটায় পূরণযোগ্য না হলে প্রতিবন্ধীদের ১ ভাগ দিয়ে তা পূরণের রীতি চালু রয়েছে। একাত্তরে স্বাধীনতা অর্জনের পর অনগ্রসর ও অগ্রসর শ্রেণির বৈষম্য অবসানের উদ্দেশ্যে এই কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। ১৯৭২ সালে ২০ শতাংশ মেধা, ৪০ শতাংশ জেলা, ৩০ শতাংশ মুক্তিযোদ্ধা ও ১০ শতাংশ যুদ্ধাহত নারী কোটা ছিল।১৯৭৬ সালে তা পরিবর্তন করে মেধা কোটা ৪০ ও জেলা কোটা ২০ করা হয়। ১৯৮৫ সালে মেধা ৪৫, নারী ১০ ও উপজাতি ৫ শতাংশ করা হয়।
কোটা সংস্কার নিয়ে বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড.জাফর ইকবাল বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার জন্য কোটা সংস্কার প্রয়োজন। তিনি বলেন,আমাদের দেশে বিভিন্ন ক্ষেত্রে কোটার অনুপাত ঠিক নেই। মানুষের মধ্যে বড় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়ে। ঘুরেফিরে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর,তাদের সন্তানের ওপর,তাদের পরিবারের ওপর অসম্মান করা হচ্ছে। আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে মুক্তিযোদ্ধাদের কেউ যেন অসম্মান না করে। তিনি আরও বলেন, অনগ্রসর কোন গোষ্ঠী যদি অবহেলিত হয়, তাদের সামনে নিয়ে আসার জন্য কোটা দেয়া হয়। কোন জায়গায় যদি কোটার সংখ্যা বেশী হয়, তবে তা মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। কোটার অনুপাত অবশ্যই সামঞ্জস্যপূর্ণ ও যুক্তিযুক্ত হতে হবে।তিনি কোটা সংস্কার আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশের হামলার ব্যাপারে বলেন, শিক্ষার্থীদের উপর পুলিশের হামলা বাড়াবাড়ি পর্যায়ের হয়ে গেছে।এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় ব্যাপার। কোটা সংস্কারের খবরে সংবাদপত্র ছেয়ে যাচ্ছে। দলমত নির্বিশেষে এই দাবীতে সংগঠিত হচ্ছে সারাদেশের শিক্ষার্থী।
যেখানে প্রয়োজন এই ক্ষুব্ধতা প্রশমন। তা না করে সংবাদপত্রে শিরোনাম হচ্ছে,ক্যাম্পাস যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র/উপাচার্যের বাসভবনে তাণ্ডব/সংস্কার দাবীতে অবস্থান কর্মসূচি,শাহবাগে কোটাবিরোধীরা/আন্দোলনকারীদের উপর লাঠিচার্জ টিয়ারশেল/সড়ক অবরোধ,সংঘর্ষে আহত অর্ধশত/ কোটার আন্দোলনে ছাত্রলীগ,পদত্যাগ তিন নেতার প্রভৃতি।
এমনই একটি উত্তপ্ত সময়কে আরও উত্তপ্ত করলো কৃষি মন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্য। তিনি শিক্ষামন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী কিংবা এ দাবী বাস্তবায়নের দায়িত্বপ্রাপ্তও কেউ নন। আন্দোলনকারীরা উনার উপরে নির্ভরও করছে না। উদ্ভূত পরিস্থিতি হতে উত্তরণের জন্য তিনি মতামত দিতে পারেন। তা না করে তিনি কটাক্ষ করলেন আন্দোলনকারীদের। তার বক্তব্যে কোটা সংস্কারকারীরা আরও বেগবান হলো।সব জায়গায় রাজাকার ও বিএনপি জামাত বলে সংশ্লিষ্টদের সেদিকে ঠেলে দেয়া কি ঠিক?
কোটা সংস্কারের দাবীতে আন্দোলনকারীদের আরও উস্কে দিল এক ছাত্রলীগ নেত্রী। সংবাদ পত্রে খবর হয়েছে এই নেত্রী এক আন্দোলনকারী ছাত্রীর পায়ের রগ কেটে দিয়েছে। এসব কি দেশব্যাপী ছাত্র বিক্ষোভ ও এই বিক্ষোভের প্রতি সমর্থন সৃষ্টিতে সহায়ক নয়? বেগম মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্য প্রত্যাহারের দাবীতে রাজপথে কর্মসূচী দিল আন্দোলনকারীরা। এর জবাবে কি বলবেন তিনি?
এখন শেষ কথা, কোটা বাতিল হচ্ছে। বাতিল হলে বাতিলে পতিত হওয়া আরেকটি মহল কি তখন রাজপথে উঠবে না? এভাবে বিভাজন সৃষ্টিতে কি কোন উপকার হবে দেশের? নিকট অতীতে মানুষ দেখেছে গণজাগরণ মঞ্চের রাজপথ কাঁপানো ও বিভক্তিতে নিজেদের মধ্যে কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি ও মাথাফাটাফাটি করে রাজপথ হতে বিতাড়িত হতে। শিক্ষকদের আন্দোলনও বিভক্তিতে বুমেরাং হয়ে গেল। কোটা সংস্কারের আন্দোলন কোটা বাতিল হলে এমন পরিণতির মুখোমুখিই কি হতে চলছে না? এছাড়াও তো বিভাজন দৃশ্যমান হল এক পক্ষের কর্মসূচি স্থগিত ও অপর পক্ষের কর্মসূচি অব্যাহত রাখার ঘোষণার মধ্য দিয়ে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন কোটা বাতিল নয় কোটা সংস্কারের।তাহলে বাতিলের চিন্তা কেন? শিক্ষার্থীদের উচিত কোটা বাতিল নয় কোটা সংস্কারের দাবীতে অটল থাকা। নতুবা বাতিলের ঘোষণা হয়তো পুরনো প্রথাকেই স্বাগত জানাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)