গত পাঁচ বছরে বিচার শেষ হয়েছে ১৩ জন শীর্ষ যুদ্ধাপরাধীর। এদের মধ্যে রাজাকার-আলবদর বাহিনীর ১২ জন যুদ্ধাপরাধীর মধ্যে ৯ জনকে দেয়া হয়েছে মৃত্যুদণ্ড সেই সঙ্গে তিন জনকে দেয়া হয়েছে আমৃত্যু কারাদণ্ড। রায় কার্যকর করা হয়েছে কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের।
ফাঁসির রায় হওয়া অপর দণ্ড প্রাপ্তদের রায় কার্যকর ঝুলে আছে আপিল বিভাগে। কিন্তু কে কোথায় আছেন তারা। আর এদের বাইরে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে অন্য যাদের বিচার হচ্ছে তাদেরই বা কি অবস্থা।
আলী আহসান মুজাহিদ: মানবতা বিরোধী অপরাধের ৭টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন ও হত্যার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ১১ আগস্ট আপিল দায়ের করেন আসামীপক্ষ। মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পরপরেই আলী আহসান মুজাহিদকে কয়েদি পোষাক পরিয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। যেহেতু তিনি ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী এ কারণে কোন কাজ কর্ম ছাড়াই শুধুমাত্র ধর্মীয় বই পড়ে কনডেম সেলেই কাটছে তার দিন।
সাকা চৌধুরী: মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে ২০১৩ সালের ১ অক্টোবর মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। তার বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, জোর করে ধর্মান্তরিত করাসহ ২৩টি অভিযোগ আনা হয় ।এরমধ্যে ৯টি অভিযোগ প্রমাণিত হলে মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করেন আদালত। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ২৯ অক্টোবর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেন সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীরা। ফাঁসির আদেশের রায় ঘোষণার পর কয়েদী সেল থেকে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে নিয়ে যাওয়া হয় কাশীমপুর-১ কারাগারের কনডেম সেলে। সেখানে বই পড়েই সময় কাটছে তার। কারা সূত্র জানিয়েছে, সেলের ভেতরে তিন বেলা তাকে খাবার দেয়া হয়। এছাড়া তার পড়ার জন্য ৮টি বই বরাদ্দ করা হয়েছে। এগুলো বেশির ভাগই ধর্মীয় বই।
মতিউর রহমান নিজামী: একাত্তরে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ২০১৪ সালের ২৯ অক্টোবর ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুন্যাল-১। তার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীল নকশা বাস্তবায়ন, হত্যা, ধর্ষণ,লুন্ঠনসহ ১৬টি অভিযোগে বিচার শুরু হয়। পরে ৮টি অভিযোগ প্রমাণিত হলে ৪টিতে মৃত্যুদণ্ডের রায় দেন আদালত। এছাড়া বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক এই শিল্পমন্ত্রীকে ১০ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলায় মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন চট্টগ্রামের একটি আদালত। মানবতা বিরোধী অপরাধে ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৩ সালের ২৩ নভেম্বর আপিল দায়ের করেন মতিউর রহমান নিজামীর আইনজীবীরা। কারা সূত্র জানিয়েছেন, কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগারের হাইসিকিউরিটি জেলের কনডেম সেলে মতিউর রহমান নিজামীকে রাখা হয়েছে। সারাদিন নামাজ,বই পড়ে শুয়ে বসে থেকেই তার সময় কাটছে।
মীর কাশেম আলী: জামায়াত নেতা মীর কাশেম আলী ছিলেন একাত্তরে আলবদর বাহিনীর তৃতীয় শীর্ষ নেতা তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সাধারণ সম্পাদক। তার বিরুদ্ধে হত্যা,অপহরন ও নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২০১৪ সালের ২ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। মানবতা বিরোধী অপরাধ মামলায় দায়ের করা ১৪টি অভিযোগের মধ্যে ১০ অভিযোগ আদালতে প্রমাণিত হয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে ২০১৪ সালের ৩০ নভেম্বর আপিল দায়ের কারেন মীর কাশেম আলীর আইনজীবীরা। কারা সূত্র জানিয়েছে, কাশিমপুর ২ কারাগারের কনডেম সেলে মীর কাশেম আলীকে রাখা হয়েছে। ফাঁসির রায় ঘোষণার আগ পর্যন্ত তিনি ভিআইপি বন্দিদের সঙ্গে একই কারাগারে থাকতেন।
মোবারক হোসেন : জামায়াতে ইসলামীর সাবেক রোকন আওয়ামীলীগ থেকে বহিস্কৃত মোঃ মোবারক হোসেন ছিলেন ছিলেন একাত্তরে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এলাকার রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার। মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার দায়ে ২০১৪ সালের ২৪ নভেম্বর মোবারক রাজাকারকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন মোবারক হোসেন। বর্তমানে কাশিমপুর ১ কারাগারের কনডেম সেলে তাকে রাখা হয়েছে।
এটিএম আজাহারুল ইসলাম: একাত্তরে আল বদর কমান্ডার ছিলেন জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলাম। তার বিরুদ্ধে হত্যা,ধর্ষণ,নির্যাতন,অগ্নিসংযোগ ও লুন্ঠনের ৬টি অভিযোগের মধ্যে ৫টি অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। এরমধ্যে ৩টি অভিযোগে ফাঁসির রায় দিয়েছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। এ রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল দায়ের করেছেন এটিএম আজাহারুল ইসলাম। বর্তমানে কাশিমপুর-২ কারাগারের কনডেম সেলে কাটছে তার দিন।
মাওলানা আব্দুস সুবহান: জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা আব্দুস সোবহান ছিলেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী সংগঠক। ২০১৫ সালের ৪ ডিসেম্বর মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আদালত-২। ফাঁসির রায় ঘোষণার পরপরেই তাকে সাধারণ সেল থেকে সরিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কনডেম সেলে রাখা হয়েছে। সেখানে বই পড়েই সময় কাটছে তার।
সৈয়দ মোঃ কায়সার : জাতীয় পার্টির সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোঃ কায়সার ছিলেন একাত্তরে রাজাকার কায়সার বাহিনীর প্রধান। তার বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধের ১৬ টি অভিযোগে বিচার শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ আদালত। অপরাধ প্রমানিত হওয়ায় ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর তাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় প্রদান করেন আদালত। সৈয়দ মোঃ কায়সারকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির সেলে রাখা হয়েছে।
দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী : মুক্তিযুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় জামায়াত নেতা মাওলানা দেলোয়ার হোসেন সাঈদীকে মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইবুন্যাল। পরে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল দায়ের করলে মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে তাকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেন আপিল বিভাগ। এ রায়ের পর পরেই কনডেম সেল থেকে সাঈদীকে নিয়ে রাখা কাশিমপুর -১ কারাগারের সাধারণ সেলে। বর্তমানে কারাগারে তাকে মালির কাজ দেয়া হয়েছে। মাঝে মাঝে জেল সেবক হিসাবেও কাজ করেন তিনি।
কারাসূত্র জানিয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আছেন জামায়াত নেতা ফোরকান মল্লিক। তার মামলা এখনো বিচারাধীন। আরেক জামায়াত নেতা আব্দুর রশিদ, আফসার হোসেন টুটু এবং মহিদুর রহমান আছেন একই কারাগারে। তাদের বিচার এখনো চলছে। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি জেল আছেন জামালপুরের জামায়াত নেতা এডভোকেট শামসুল হক,মাওলানা ইউসুফ,হবিগঞ্জের জামায়াত নেতা মহিবুর রহমান , মজিবুর রহমান,বাগেরহাটের সিরাজুল ইসলা,মহেশখালীর আব্দুর রশিদ। । তাদের মামলা বিচারাধীন। কাশিমপুর ২ কারাগারে আছেন জামায়াত নেতা আতাউর রহমান ননী এবং লতিফ তালুকদার। তাদের মামলাও এখনো বিচারাধীন।