ভাষার মাস, ফেব্রুয়ারি। এই মাস আমাদের অহংকারের মাস। আমাদের চেতনার মাস। বাংলায় কথা বলার জন্য রাজপথে নেমে আন্দোলনের মাস। বুকের তাজা রক্ত ঢেলে অধিকার আদায়ের মাস।
অনেক প্রাণের বিনিময়ে আমরা একটা ভাষা পেয়েছিলাম এই মাসে। পেয়েছিলাম মাকে মা বলার অধিকার। আমাদের সেই ভাষার নাম বাংলা।
জাতিসংঘ আমাদের সেই অর্জনকে স্বীকৃতি দিয়েছে, তাইতো জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোতে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
আমাদের ভালোবাসায় জড়িয়ে আছে অনেক নাম। রফিক, সালাম, জব্বার, বরকতসহ নাম না জানা কত সেই প্রাণ। তাঁদেরকে আমরা স্মরণ করি হৃদয় দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, চেতনা দিয়ে। কোনো রকমের কৃত্রিমতা নেই সেই ভালোবাসায়। সত্যিকারের ভালোবাসায় কৃত্রিমতার জায়গা নেই।
তা হলে আমাদের লোক দেখানো ভালোবাসা কেন? আমরা দেখি এই ফেব্রুয়ারি মাস এলেই-বাংলা ভাষায় এই করতে হবে, এই বাংলাকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিতে হবে, সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালুর তোড়জোড় শুরু হয়ে যায় কোথাও কোথাও। বাংলার প্রতি কারো কারো যেন দরদ একেবারে উছলে পড়ে। আবার ফেব্রুয়ারি চলে গেলে আগের মত হয়ে যায় এই দরদিয়ারা।
তেমনি পত্রিকার একটি ছোট খবর দেখে চোখ আটকে গেল- ‘বাংলায় সাইনবোর্ড না লেখায় জরিমানা।’ খবরটি এরকম-বাংলায় সাইনবোর্ড না লেখায় আসাদগেট এলাকায় সাতটি প্রতিষ্ঠানকে ৪৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমান আদালত এ জরিমানা করে।
খুব ভাল খবর। জরিমানার পরে এসব সাইনবোর্ড তাৎক্ষণিকভাবে সরিয়ে ফেলা হয়। আমরা আনন্দ অনুভব করি, বাংলার প্রতি ভালোবাসা দেখে।
কিন্তু সারা বছর কি আমরা এসব ইংরেজি সাইনবোর্ড দেখি না? নাকি এই ভাষার মাসে এ রকম কাজ করে গণমাধ্যমের সংবাদ হওয়ার সুযোগ নেয়াই এসব ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযানের লক্ষ্য।
আমাদের চোখের সামনে কত কোচিং সেন্টার, ফাস্টফুডের দোকান, শপিং মল, পোশাক প্রতিষ্ঠানসহ নানা ধরনের ব্যবসাবাণিজ্যের দোকানপাটের নাম রয়েছে ইংরেজিতে। কই সেগুলোর দিকে আমরা কেন বছরের অন্য সময়টায় চোখ রাখি না?
শুধু ভাষার ক্ষেত্রে আমাদের এই দরদের বিষয় না, আরো অনেক ক্ষেত্রেই আমাদের লোক দেখানো কাজ চোখে পড়ে। আমরা সবকিছুতেই কৃত্রিম সামাজিকতা দেখাতে পছন্দ করি। এটা একটা ফ্যাশনও বলা যায়। যেমন হঠাৎ বাঙালিয়ানায় মেতে উঠি পয়লা বৈশাখে। এই আমরাই আবার থার্টি ফাস্টের রাত্রে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠি বিদেশী সংস্কৃতির নেশায়। আবার এই আমরাই প্রিয়জনের কোনো অনুষ্ঠানে ডি-জে পার্টির আয়োজন করে পাশের বাড়ির লোকজনদের সমস্যার কথা তোয়াক্কা করি না। কোনো প্রতিবেশি শব্দ কমানোর কথা বললে তেড়ে যাই মারার জন্য। আমরা মেতে উঠি প্রতিযোগিতায় যেন। পাশের বাড়ির অমুকের গায়ে হলুদের ডি-জে পার্টিতে অমুক শিল্পীকে এনেছিল এত টাকা দিয়ে, আমরা আনবো তারচেয়ে দ্বিগুন টাকা দিয়ে হালের ক্রেজ তমুক শিল্পীকে। এই হচ্ছে আমাদের মানসিকতা।
সবকিছুতে অর্থের গরম দেখানো যেন একটা সহজাত প্রবৃত্তি হয়ে গেছে, তেমনি সারা বছর এলাকার শহীদ মিনারের পাশে গরু বেধে রাখলেও কিছু বলি না। কিন্তু ফেব্রুয়ারি এলেই ২০ তারিখ রাতে তাড়াহুড়ো করে শহীদ মিনারকে ধুয়ে মুছে সাফ করি, পরদিন সকালে ফুল দিয়ে নিজেকে সংস্কৃতিবান ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত করতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠি। কিংবা এলাকার নেতৃস্থানীয়দের কাছে নিজেকে মূল্যবান মানুষ হিসেবে পরিচিত করে রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের ধান্দা খুঁজি।
আমরা আমাদের বাংলা ভাষাকে যথাযথ মূল্য দেব সারা বছর। শুধু একটি মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সবসময় শুদ্ধ বাংলা ভাষায় কথা বলার চেষ্টা করব। শুধু সাইনবোর্ড না, অযথাই কোনো প্রতিষ্ঠানের নাম চটকদার ইংরেজিতে না রেখে বাংলায় রাখার কথা ভাবব। তার মানে ইংরেজিকে বর্জন নয়, যেহেতু ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা, ওটা শিখব অবশ্যই। কিন্তু সবার আগে নিজের মাতৃভাষাকে জানব এবং সেটা শুদ্ধভাবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)