হালকা শীতের পরশ। ধুলিমাখা চরাচর। বিষন্ন আলো, ম্লান রাত্রিদিন-চারদিকে একটা বিষন্নতার ছায়া। এই পরিবেশে কোলাহল, রাজনীতি, পুলিশি জিঘাংসা, সমুদ্রপথে নৌকায় ভেসে আসা মানবতার আর্তকান্না, ক্রিকেটের ধুমধাড়াক্কা-কোনো কিছুই যেন ভালো লাগে না। এই সব উপাচার যেন একঘেয়ে জীবনের অনিবার্য ‘অভিশাপ’। এসব নিয়ে ভাবতে আর ভালো লাগে না। কেবলই বিষণ্ণতা, নির্জনতা, একাকীত্ব চায় মন!
আসলে একটু নির্জনে, একটু আলাদা করে খেয়াল করলেই বোঝা যায় প্রকৃতিতে এখন আলাদা একটু কাল বিরাজ করছে। গাঁয়ের লাজুক বধূর মত নত মুখে সামনে দাঁড়িয়েছে। অথচ আমরা আত্মভোলা ক্ষয়িষ্ণু দৃষ্টির প্রবীণের মত তার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছি না!
তাকাবোই বা কেমন করে? এ যে বড় প্রচার বিমুখ মুখচোরা ঋতু। হেমন্ত আসলে বুক চাপা অভিমানের কাল! পূর্ব রাগের বসন্ত, তৃষ্ণার গ্রীষ্ম, অপেক্ষার বর্ষা, শীতল শীত, উচ্ছ্বাসভরা শরৎ এসব তো আমরা কম-বেশি বুঝি। অনেক, অনেক কথা বলা যায় তাদের নিয়ে। গোপনতা নেই তেমন। স্বভাবেই মনের ভাব পরিষ্কার। কিন্তু এতগুলো দামাল ঋতুর পরে কখন যে হেমন্তর আলতো প্রবেশ বোঝাই যায় না যেন! প্রবেশে আড়ম্বর নেই, প্রকাশে ভাষা নেই। হিমেল বিষন্ন সন্ধ্যায় একটা জড়োসড়ো আঁশ আঁশ কম্বলের আকুতিই কি হেমন্ত?
এ ঋতুতে ক্লান্তি এলেও তার জন্য ক্ষমা চাইতে ইচ্ছে হয় না। বরং পুরোপুরি অলস হয়ে একটা দেবদারু কিংবা ইউক্যালিপটাস পাতার কাছে মৃত্যুভয় জয় করতে শেখার ইচ্ছে হয়, ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কের মায়া কাটিয়ে কিভাবে বিজয়ীর মতো বেরিয়ে যেতে হয়, তা শিখতে ইচ্ছা হয়!
হেমন্তকে আমরা চিনি সেই সকালবেলার খবর কাগজ প্রদানকারী হকারটি মত করে, যে দরজার ফাঁক দিয়ে খবরের কাগজটি গলিয়ে দিয়ে সাতসকালে চলে যায়। আমাদের নাগরিক জীবনে হেমন্ত ঋতুও তেমনি নিঃসাড়ে কখন যেন এসে চলে যায়। উৎসবময় উজ্বল শরতের ফিকে হয়ে আসা রেশ আর পৌষের মিঠে রোদে শরীর শুকাবার অপেক্ষায় থাকা দিনগুলোর মাঝে হেমন্ত কখন যেন তার কাজটি সেরে চলে যায়। তার কাজটি যেন শীতের জন্যে ঘর-দোর গুছিয়ে রেখে, দরজা খুলে অপেক্ষা করা আর শীত এলে ঘরের চাবিটি হাতে তুলে দিয়ে চুপিসাড়ে বিদায় নেওয়া।
হেমন্তের আসা-যাওয়ায় বিশেষ হাঁক ডাক নেই। সে আসে ধীরে যায় লাজে ফিরে। বিশেষ করে এই প্রাণহীন শহরে। তাই তেমন করে তার দিকে কেউ নজর করে না। হ্যাঁ, নজর করেছিলেন একজন। তার নাম জীবনানন্দ দাশ। হেমন্ত ঋতুকে, গৌড় বাঙ্গলার কার্তিক-অগ্রহায়ণকে প্রকৃত ভালোবেসে তিনিই চিনিয়েছেন। সে হেমন্ত মলিন পাড়া গাঁয়ের মেয়েটির ব্যাথাতুর চোখের মত সুন্দর, সে হেমন্ত সুপক্ক ধানের গন্ধে মম করা আলপথের মত রমণীয়, সে হেমন্ত ধান কাটা সারা হওয়া শুন্য মাঠে হিমানী মাখা শব্দহীন সন্ধ্যার মত বিষণ্ণ।
জীবনানন্দের ‘রণ-রক্ত-সফলতা’ যেন সব হেমন্ত ঋতুকে ঘিরেই। তার শর্তহীন প্রেম যেন আবর্তিত হয় হেমন্তকে ঘিরে। কার্তিকের পাকা ধানের নবান্ন আর অগ্রহায়ণের ধান কাটা শুন্য মাঠের মধ্যেই যেন লুকিয়ে আছে জীবনের সব চাওয়া-পাওয়ার প্রতীকী রূপ। বাংলার প্রকৃতিতে প্রাচুর্যময়ী হেমন্ত যেন কল্যাণময়ী নারীর অকৃত্রিম শুভশ্রীর নিরাভরণ উপস্থিতি, আত্মমগ্ন কবি চিত্তের অনুধ্যানের অনুষঙ্গ।
হেমন্তের রূপ লাবণ্যে নিমগ্ন কবি জীবনানন্দ দাশের অজস্র কবিতায় ধূমল কুয়াশাচ্ছন্ন হেমন্ত প্রকৃতি অন্তরঙ্গ অনুভবের সংশ্লিষ্টতায় অপূর্ব বাণীমূর্তি রূপে উদ্ভাসিত হয়েছে। হেমন্ত তার প্রিয় ঋতু। অপূর্ব কাব্যিক সুষমায় হেমন্ত তাঁর তুলির আঁচড়ে বাঙময় রূপে ধরা দিয়েছে।
হেমন্ত তার চোখে কেবল রূপসজ্জা ও সৌন্দর্যের জৌলুস মাত্র নয়; হেমন্ত তাঁর কাছে প্রেম বিরহ মিলন ও সৃষ্টির এক অপার বিস্ময়। কবি হেমন্তকে ভালোবাসেন, ভালোবাসেন বিকেলের নরম হলুদ রঙের বর্ণবৈভবহীনতা এবং বিরাণ শূন্য প্রান্তরের বিবর্ণতা। হেমন্তকে কবি দেখেছেন ফসলের মাঠে ……‘অঘ্রাণ রাতে ভরা ক্ষেত হয়েছে হলুদ’ দেখেছেন গোধুলি সন্ধির নৃত্যের মাঝে….দর দালানের ভিড় পৃথিবীর শেষে/যেইখানে পড়ে আছে শব্দহীন ভাঙা/সেইখানে উঁচু উঁচু হরিতকী গাছের পিছনে/ হেমন্তের বিকেলের সূর্য গোল রাঙা/চুপে চুপে ডুবে যায় জ্যোৎস্নায়। সোনার বলের মতো সূর্য আর রূপোর ডিবের মতো চাঁদের বিখ্যাত মুখ দেখা।’ (গাধুলি সন্ধির নৃত্য)।
লাবণ্যময়ী ঋতুকন্যা হেমন্ত ধরা দেয় এক আলাদা বৈশিষ্ট্য নিয়ে। শিশিরসিক্ত স্নিগ্ধ শীতল ভোরে সবুজ ঘাসের আগায় হীরের কুঁচি, মায়াবী নীল আকাশে নরম সোনা রোদ, মৃদুমন্দ হিমেল সমীরণে শিহরিত প্রাণ। মোহিনী প্রকৃতির রহস্যময়ী সৌন্দর্যে প্রেমমুগ্ধতার আকুল আহ্বান।
সত্যি বলছি, এই হেমন্তে বিচিত্র ‘ফেস্ট’-এর কোলাহল মাখা এ শহরে সুখী সুখী ভাব নিয়ে নাগরিক পরিবেশে থাকতে ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে শুধুই সবুজের সমারোহ-ঘেড়া কোনো নির্জন স্থানে ছুটে যেতে, দেখতে ইচ্ছে করে পাহাড়ি রাস্তার গলায় জড়ানো হেমন্তের রঙিন স্কার্ফ জড়ানো দৃশ্য উপভোগ করতে। কঙ্কালসার রূপ নেওয়ার আগে আর একবার তাদের ‘কালার সেলিব্রেশন অফ লাইফ’ দেখতে! ইচ্ছে করে কোনো এক পায়ে চলা মেঠো পথ ধরে ফড়িং আর প্রজাপতির ওড়াওড়ি দেখতে।
এই হেমন্তে একটু নিজের মতো একা থাকতে খুব ইচ্ছে হয়। ইচ্ছে করে জানালার ধারে বসে দূর মাঠের দিকে তাকিয়ে থাকতে। নদী কিংবা সমুদ্রের ধারে অথবা প্রকৃতির কোলে বসে আনমনা ভাবনার জাল বুলতে। দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেন্ডারের দিক তাকিয়ে একটা একটা করে ঝরে যাওয়া পাতার মতো একা একা কবিতার টুকরো শব্দ মনে আসে, আবার হারিয়ে যায়। উড়ে যায়, উড়িয়ে দিই। হেমন্তে বাঁধন ভালো লাগে না, অন্তমিল ভালো লাগে না!
বড় বেশি উৎসব আর কোলাহল আজকাল। মধ্যবিত্ত হুজুগে গা ভেসে যায়। মন সায় দেয় না। এক উৎসব থেকে আর এক উৎসবে যেতে মনের গভীর আরো যেন সময় চায়, আর একটু অপেক্ষা চায়। কিন্তু সেই সময় মেলে না! এলোমেলো ভাবনা আর বিষণ্ণতায় মগ্ন হয়ে পড়ে মন। যে বিষণ্নতা বড়ই ব্যক্তিগত, হয়তো তেমন কারণ নেই। অথবা কারণ আছে বা কারণের আশ্রয় খুঁজছে। যে বিষন্নতা গাছ, সমুদ্র, আকাশ ছাড়া কারোর সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া যায় না, সে ইচ্ছেও হয় না।
হেমন্তে পুরোনো দুঃখ, জমা অভিমান শিরশির করে। আকুল করে ব্যাকুল করে। প্রাত্যহিক জীবনের ধারাপাত ছাপিয়ে শুধু মনে জাগে রবি ঠাকুরের সুর-“সন্ধ্যাপ্রদীপ তোমার হাতে মলিন হেরি কুয়াশাতে, কন্ঠে তোমার বাণী যেন করুণ বাষ্পে মাখা!”..
হিম থেকে এসেছে হেমন্ত। তাই হেমন্তকে বলা হয় শীতের পূর্বাভাস। হ্যাঁ নীরবে এসে নিভৃতেই হেমন্ত বিদায় নিতে চলেছে। এই হেমন্তকে চিনেছে যেন শহরের পার্কের কোণার বেঞ্চটা। যে বেঞ্চটা পেছনে পড়ে থাকে একা! আর তাতে গড়াগড়ি দেয় কিছু ঝরে পড়া পাতা! হেমন্তকে ওদের মতো ঘনিষ্ঠভাবে আর কে বুঝেছে কবে!