চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কেন বলছি, নারী দিবসের দরকার নেই?

নারী দিবস পালন উপলক্ষে আয়োজিত একটি সেমিনারে উপস্থিত ছিলাম গত ৭ মার্চ। সেখানে দেশের স্বনামধন্য এবং নিজ নিজ জায়গায় প্রতিষ্ঠিত সফল নারীদের বক্তব্য শোনার সুযোগ হয়েছিল। বক্তব্যে পুরুষতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইয়ের এবং এই লড়াইয়ে জয়ী হবার গল্পগুলো আমাদের সাথে শেয়ার করছিলেন।

তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন নারী বলছিলেন, নারীরা এখন অনেক এগিয়ে গেছে। ফলে নারী দিবসের আর কোনো দরকার নেই। বরং এখন পুরুষ দিবস পালন করা দরকার। যারা এই কথা বলেন এবং এই কথার সাথে যারা সহমত প্রকাশ করেন তাদের উদ্দেশে আমার এই লেখা। তাদের কাছে আমার কয়েকটি প্রশ্ন।

১. আমাদের দেশের ছেলে-মেয়েদের ক্লাসে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে ‘তোমার মা কি করে?’ বেশিরভাগেরই উত্তর হবে ‘মা কিছু করে না, জাস্ট হাউজওয়াইফ’ এমন উত্তর কি আসে না? অর্থাৎ ঘরে নারীর কাজকে অদৃশ্য করে দেয়া বন্ধ হয়েছে কি?নারীর

২. একজন পুরুষের জন্য কেবল পুরুষ হবার জন্য যতটুকু সুযোগ-সুবিধা তৈরি করা থাকে তা একজন নারীর জন্য কি থাকে?

৩. এখানে শুধু নারী হবার কারণে তাদের প্রতি বৈষম্য, সহিংসতা, নির্যাতন বন্ধ হয়েছে কি?

৪. নারী এবং পুরুষ মানুষ হিসেবে সমমর্যাদা পায় কি এখনও?

৫. পুরুষ যেরকম সবদিক থেকে স্বাধীন, নারীরা সেভাবে স্বাধীনতা পাচ্ছে কি?

৬. যে নারীরা স্বাধীন সত্তা হিসেবে সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে টিকে থাকতে চায় তাদের নিয়ে সমাজের মনোভাব পুরুষদের ক্ষেত্রে যেরকম স্বাভাবিক নারীদের ক্ষেত্রেও কি তেমনটা স্বাভাবিক?

৭. একটা ছেলের কাছ থেকে বাবা মায়ের যেরকম প্রত্যাশা যে ছেলের সাথে শেষ বয়সে একত্রে থাকবে, বা ছেলের আয়ের উপর নির্ভর করবে শেষ বয়সে, মেয়ের কাছ থেকেও কি একই রকম প্রত্যাশা করে?

৮. আমাদের আইনগুলো কি (যেমন উত্তরাধিকার আইন, কাবিনে মেয়েকে নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিয়ে বিয়ে করা) এখনও ধর্মীয় প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পেরেছে কি?

৯. ঘরের কাজগুলোকে (যেমন রান্না করা, ঘর মোছা-বাসন মাজা-কাপড় ধোয়া, শিশু এবং বয়স্কদের যত্ন) কি নারী-পুরুষ উভয়ের দায়িত্ব বলে মনে করা হচ্ছে নাকি এখনও এগুলোকে নারীর কাজ বলে ধরা হচ্ছে?

১০. নারীকে নারীর প্রতি ঘটে যাওয়া নির্যাতনগুলোর (ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ইভ-টিজিং ইত্যাদি) জন্য কি এখনও দায়ী করা বন্ধ হয়েছে?

১১. পুরুষদেরও যে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বিষয় আছে তা কি এখনও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে? ১২) যৌতুক প্রথা, বাল্যবিবাহ, ধর্মীয় কুসংস্কার এখনও কি নেই সমাজে?

১৩. মিডিয়াতে কি এখনও নারীদেরকে যৌনসর্বস্ব পণ্য হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না?

সর্বোপরি
১৪. আমাদের এই সমাজটাকে কি আমরা পুরুষতন্ত্রের শিকল থেকে এখনও বের করতে পেরেছি?

যদি উত্তরটা যদি ‘না’ হয়, তবে কেনো আমরা বলছি নারী দিবসের দরকার নেই? কাজের অনেকখানি অংশ এখনও বাকি রয়ে গেছে। কোনো একটা বিষয় নিয়ে দিবস ঘোষণা এমনি এমনি তো আর আসে না। ওই বিষয়ে সকলের বিশেষ গুরুত্ব এবং নজর আনা, তাদের সচেতন করা এবং তাদের মনমানসিকতা পরিবর্তন করার জন্যই দিবসটিকে আলাদা করে ঘোষণার দরকার হয়। নারী দিবসের ব্যাপারটিও তেমন।

নারীদের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়, মানুষ হিসেবে সমমর্যাদার স্বীকৃতি ও সকল ক্ষেত্রে তার সমঅংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ এবং নারীর প্রতি সকল জেন্ডারভিত্তিক বৈষম্য ও নির্যাতন বন্ধ করার জন্য দিবসটির ঘোষণা এসেছিলো এবং এই সকল বিষয়ে অগ্রগতি অর্জনের জন্য দিবসটির ভূমিকা অপরিসীম। বিশেষ করে নারীদের গণতান্ত্রিক অধিকার যেমন ভোটাধিকার, শিক্ষার অধিকার, পার্লামেন্ট নির্বাচনের অধিকার, ইচ্ছা অনুযায়ী কর্মসংস্থান নির্বাচন, অর্থ উপার্জন এবং সম্পত্তির অধিকার, নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী পোশাক পরা, বিয়ে করা, ডিভোর্স দেয়া এবং জন্ম নিয়ন্ত্রণের অধিকার এসব অর্জনে দিবসটির ভূমিকা অপরিসীম।

ফলে এগুলো রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছুটা অর্জিত হয়ে গেছে বলেই ধরে নিয়েছি নারীরা জয়ী হয়ে গেছে এবং আর আন্দোলনের দরকার নেই, আর এই দিবসটির দরকার নেই ব্যাপারটি আসলে তেমন না। কারণ আমাদের সমাজে এখনও নারীরা পরিবার এবং কর্মস্থলে জেন্ডার বৈষম্যের শিকার হচ্ছে, পারিবারিক সহিংসতা, ভিকটিম ব্লেমিং, যৌন হয়রানি, ইভ টিজিং ইত্যাদির শিকার হচ্ছে, এখনও তারা রাস্তা-ঘাট-বাস-ট্রেনে-ঘরে ধর্ষিত হচ্ছে, এখন তারা পরিবার, সমাজ, বাবা, মা, সঙ্গী, সন্তানের জন্য নিজের সত্তা বিলিয়ে দিচ্ছে। এখনও তারা নানাভাবে বঞ্চিত। শুধু আজকের পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত রিপোর্টগুলোতে তুলে ধরা তথ্যগুলোরে দিকে চোখ বুলিয়ে দেখলে দেখা যাবে বিশ্বে নারীর অবস্থা এখনও কতটা অনিরাপদ।

দৈনিক প্রথম আলোর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত ‘স্মরণকালের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ এবং…’ শিরোনামের মতামত কলামে মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম তথ্য দিয়েছেন শুধু পুলিশ পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে ২০১৯ সালে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ৪০০টি। একই পত্রিকায় গত ৬ মার্চ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘নারীর প্রতি বিশ্বের ৯০ শতাংশ নারী-পুরুষই নেতিবাচক।’ সেখানে আরো বলা হয়েছে বিশ্বব্যাপী ৫০ শতাংশ পুরুষের মতামত চাকরির ক্ষেত্রে নারীর চেয়ে তাঁদের অধিকার বেশি। প্রথম আলোর আরেকটি কলাম ‘নারীর সমতা ও গণতন্ত্রের উল্টো যাত্রা’য় কামাল আহমেদ জানিয়েছেন, বিশ্বে যত মানব পাচার ঘটছে, তার ৭০ শতাংশই নারী, ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী মেয়েদের প্রতি ২০ জনের একজন ধর্ষণের শিকার এবং প্রতিবছর ১ কোটি ২০ লাখ নাবালিকার বিয়ে হয়ে যায়।

তাই নারীর বিশ্বব্যাপী এই যখন অবস্থা, তখন আমরা কীভাবে বলতে পারি নারী দিবসের প্রয়োজন নেই? প্রকৃতপক্ষে, পথ মসৃণ হতে আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। আর দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে পরিবর্তন আসাটা আরো জরুরি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।