গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করা রাজধানীর ড্যাফোডিল ইউনিভার্সির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থী সুমন কুমার পাল আশঙ্কাজনক অবস্থায় এখন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি রয়েছেন। শনিবার সন্ধ্যায় তিনি সোবহানবাগে নিজের গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগানোর পর তাকে বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়।
তার চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা বার্ন ইউনিটের আবাসিক সার্জন ডাঃ পার্থ শংকর পাল চ্যানেল আই অনলাইনকে জানিয়েছেন, সুমনের শরীরের ৩৭ শতাংশ পুড়ে গেছে। সাধারণত ১৫ শতাংশের ওপর পুড়লেই অবস্থা আশঙ্কাজনক হয়ে যায়।
পরিবারের বড় সন্তান সুমনের খবর পেয়ে গ্রামের বাড়ি যশোর থেকে ছুটে এসেছেন তার ব্যাংক কর্মকর্তা বাবা এবং গৃহিনী মা। সন্তানের এমন কাণ্ডে তারা এতটাই ভেঙে পড়েছেন যে কথা বলার মত অবস্থায়ও নেই। বার্ন ইউনিটের দ্বিতীয় তলায় অপেক্ষারত তার বাবাকে হতবিহ্বল দেখালো। মা ভেতরে সন্তানের পাশে।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রাজুয়েটের কেন এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত? সুমনের বন্ধু, সহপাঠী এবং মনোবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে চ্যানেল আই অনলাইন।
বার্ন ইউনিটে সুমনের পরিচর্যায় থাকা তার এক সহপাঠী বলেন: মিডিয়ায় যেভাবে নিউজ এসেছে যে, সুমন প্রেমিকার সঙ্গে ঝগড়া করে গায়ে আগুন দিয়েছে ব্যাপারটা আসলে তা নয়।
‘অনেকদিন ধরেই সে খুব ফ্রাসট্রেটেড (হতাশ) ছিল। কিন্তু তার হতাশার কারণ সে কাউকে শেয়ার করেনি। আমরা নানাভাবে জানার চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।’
ওই শিক্ষার্থী বলেন: আপনার কি মনে হয় গ্রাজুয়েশন শেষ করা একটি ছেলের এমন আবেগ থাকার কথা যে সে কেবল তার প্রেমিকার সঙ্গে ঝগড়া করেই গায়ে আগুন দিতে পারে? এর পেছনে আরও অনেক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আমাদের সঙ্গে তা কখনও শেয়ার না করায় আমরাও বলতে পারছি না কেন সে এমন আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিল।
যশোরের নওয়াপাড়া কলেজে সুমনের এক সহপাঠী এবং বাল্যবন্ধু চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘কলেজে পড়া অবস্থায় ও বেশ চঞ্চল প্রকৃতির ছিল। যা কিছুই ঘটতো কারও কাছে শেয়ার না করলেও আমার কাছে করতো। কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবত ও বেশ চাপা স্বভাবের হয়ে উঠেছে। স্বেচ্ছায়তো কিছু বলেই না, জিজ্ঞেস করলেও বলে না।’
বাবা ব্যাংক কর্মকর্তা হওয়ায় এক ছোট বোনসহ চার সদস্যের পারিবারে আর্থিক অস্বচ্ছলতা নেই। পাশ করার সঙ্গে সঙ্গে একটি বেসরকারি ব্যাংকে তার চাকরিও ঠিক হয়েছিল বলে জানালেন বন্ধুরা। সেদিক থেকেও তারা হতাশা না থাকার কথা জানালেন।
তাহলে হতাশার কারণটি আসলে কী?
সুমনের এই হতাশার একটা মনত্ত্বাতিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারপার্সন অধ্যাপক নাসরীন ওয়াদুদ। চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন: দীর্ঘদিন মনের ছোট ছোট দ্বন্দ্বগুলোর দিকে নজর না দেওয়ায় একসময় তা জড়ো হয়ে বড় আকার ধারণ করে। তখন বিষণ্নতা এতটাই প্রকট আকার ধারণ করে যে ছোট ছোট বিষয়েও মানুষ অনেক বেশি আগ্রাসী হয়ে উঠে যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
বিষয়টি স্পষ্ট করে তিনি বলেন, ‘ধরেন আপনার ঘর প্রতিদিন ঝাড়ু দেওয়ার কথা। কিন্তু আপনি তা না দিয়ে এক বছর পর সেটা ঝাড়ু দিতে গেলেন। তাহলে একদিন ঝাড়ু দিয়ে কি আপনি এক বছরের ময়লা পরিষ্কার করতে পারবেন?’
‘এভাবে একটু একটু করে ময়লা জমে হয়তো ঘরটিই বসবাসের অযোগ্য হয়ে যায়। মনের ব্যাপারগুলোও তেমন। কারণ একটু একটু করে মানসিক অসুস্থতা যখন প্রকট আকার ধারণ করে তখন আবেগীয়ভাবে মানুষ অনেকটা ভঙ্গুর হয়ে যেকোন সময় যেকোন সিদ্ধান্ত নিতে পারে।’
মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে উদাসীনতা এবং মানসিক অসুস্থতার যত্ন না নেওয়াকে এমন সব ঘটনার জন্য দায়ী করে এ মনোবিজ্ঞানী বলেন: আমাদের সামান্য শারীরিক অসুস্থতা দেখা দিলেই আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠি। সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের কাছে ছুটে যাই। কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মানসিক অসুস্থতা জমতে জমতে প্রকট হয়ে উঠলেও আমাদের সে দিকে নজর নেই। নেই ন্যুনতম সচেতনতাও।
তরুণ সমাজসহ সব শ্রেণির মানুষের হতাশা এবং বিষণ্নতা দুর করতে যে সচেতনতা দরকার তা দেশে নেই বলে মনে করেন অধ্যাপক নাসরিন ওয়াদুদ। মিডিয়াও এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত ভুমিকা রাখতে পারছে না বলে মত দেন তিনি।