চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কেন আবারও ৫টার মধ্যে বর্ষবরণ শেষ করার নির্দেশ?

পয়লা বৈশাখের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বিকাল ৫টার মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে কয়েক বছর ধরেই এমন নির্দেশনা থাকছে।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সমাজ বিজ্ঞানীরা বলছেন, নিরাপত্তা ব্যবস্থা যদি সাময়িকভাবে প্রতিরোধমূলক হয়ে থাকে তাহলে হতেই পারে, কিন্তু যদি এটাই সরকার নিয়মের অংশ করে ফেলে তবে দেশের উৎসব, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

২০১৫ সালে পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান বিকাল সাড়ে ৫টা’র মধ্যে শেষ করতে বলা হলেও পরের বছর গুলোতে বিকাল পাঁচটায় শেষ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এ বছরও কোন ব্যতিক্রম ঘটেনি।

তবে, পয়লা বৈশাখে বিকাল ৫টার মধ্যে সব ধরনের উন্মুক্ত সাংস্কৃতিক আয়োজন বন্ধের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের পক্ষে স্বয়ং সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। রোববার পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমিতে আয়োজিত এক আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় তিনি বলেন, “বিকাল ৫টার মধ্যে অনুষ্ঠান শেষ করার সিদ্ধান্তটি গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা সাংস্কৃতিক জাগরণের কথা বলছি। কিন্তু এ ধরনের সিদ্ধান্তের কারণে যে অপশক্তির বিরুদ্ধে আমরা লড়াই করছি তারা পরোক্ষভাবে লাভবান হচ্ছে।”

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “যারা ঘর থেকে বের হতে যাচ্ছেন, আমরা তাদের ঘরে ঢোকাতে চেষ্টা করছি। উপরন্তু যাদেরকে আমরা দমন করতে চাচ্ছি, তারাই এ সুযোগে প্রকাশ্যে তাদের কর্মকাণ্ড চালাতে পারে। সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড যেন বাধাগ্রস্ত না হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।”

সংস্কৃতিমন্ত্রীর কথার সুরেই অভিমত দিয়েছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও সমাজ বিজ্ঞানীরা।

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আমাদের পুলিশের স্বল্পতা ও বাংলাদেশের সামাজিক সাংস্কৃতিক যে অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এমন নির্দেশ, এছাড়াও আমাদের জনসংখ্যার যে ঘনত্ব, আমাদের যে নগরায়ন প্রক্রিয়া তাতে এ সমস্ত বিষয়ে টেরোরিজমের ঝুঁকি থেকে যায়। এছাড়া আমাদের পুলিশের কতোটুকু সক্ষমতা রয়েছে সেটা নিয়েও একটা প্রশ্ন থেকে যায়?

ড. জিয়া বলেন, আমাদের সামাজিক যে প্রেক্ষাপট তাতে সাময়িকভাবে দুই তিন বছর বর্ষবরণ অনুষ্ঠান বিকাল ৫টায় শেষ হতে পারে। সরকারের একটা পরিকল্পনার একটা অংশ হিসেবে এটা চলতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা হিসেবে এটা গ্রহণযোগ্য নয়।

ড. জিয়ার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: স্বাভাবিকভাবে আমরা যেকোনো অনুষ্ঠান ৯টা/১০টা পর্যন্ত করি, আমাদের টিএসসিও খোলা থাকে। পয়লা বৈশাখ হচ্ছে সকল ধর্মের মানুষের অনুষ্ঠান, এখন এ বিষয়টি (৫টার মধ্যে শেষ করা) যদি আমরা নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসি তবে সমাজে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম

দেশের ঐতিহ্য ও মানুষের চাওয়া পাওয়া দেখতে হবে জানিয়ে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ড. জিয়া বলেন: সাময়িকভাবে বিষয়টা ঠিক আছে, এটাকে আমরা প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা ধরতে পারি।মানুষের বৃহত্তর স্বার্থে যদি এটা করা হয় তাহলে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদি বা নিয়মিত করে ফেললেই সমস্যা। যদি বিষয়টাকে আমাদের সংস্কৃতিতে রূপ দেওয়া হয়, তাহলে আমাদের যে হাজার বছরের সংস্কৃতির উৎসব ঐতিহ্য তা ধ্বংস হয়ে যাবে।

উৎসব আয়োজন নিয়মিতই এরকম সীমাবদ্ধ করে দেয়া হলে গণতান্ত্রিক বাকস্বাধীনতা স্তব্ধ হয়ে যাবে জানিয়ে ড. সাদেকা হালিম বলেন: আমাদের চিন্তা চেতনা, অধিকার, কৃষ্টি সামাজিক বিশ্বাস, মূল্যবোধ এ বিষয়গুলো আমাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বুঝতে হবে, নিরাপত্তা কখনো অনুষ্ঠানকে বন্ধ করতে পারে না, যেসব দেশে জঙ্গি হামলা হয়েছে তারা একদিনের জন্যও কিছু বন্ধ করেনি। বরং ওইসব জায়গায় অনুষ্ঠানগুলো আরো বড় আকারে হয়েছে। যারা সঙ্গীত পরিবেশনা করেছে তারা বলেছে, আমরা আরো গান করব।

“আমাদের শিল্পী সমাজ প্রস্তুত, জঙ্গি সন্ত্রাস দমনে শিল্পী সমাজকে আরো বেশি করে কাজে লাগাতে হবে। কিন্তু আমরা তাদের স্তব্ধ করে দিচ্ছি।”

ড. সাদেকার হালিমের সঙ্গে একমত প্রকাশ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: দেশের মানুষকে শ্বাস প্রশ্বাস প্রবাহিত করার সুযোগ দিতে হবে, এ জায়গায় মানুষকে বদ্ধ করা যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. শাহ এহসান হাবীব

কারণ সংস্কৃতি চর্চাটাকে যদি আমরা রূদ্ধদার করে দেই তাহলে বন্যার মতো অবস্থা হবে।

মানুষের ক্ষোভ তৈরি হতে দেওয়া যাবে না জানিয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক দেশে আমরা ৫টার পর বৈশাখের অনুষ্ঠান করতে পারব না আর স্বৈরাচার এরশাদের ৯ বছর শাসনে করতে পারলাম, এটা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। যদি অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের দরকার হয় তবে তা সরকারের করা উচিত। তবুও মানুষের উৎসবমুখর পরিবেশের সময় এভাবে নষ্ট করা উচিত নয়।

পয়লা বৈশাখ নিরাপদে উদযাপন করতে সমর্থ হবো জানিয়ে মঙ্গলবার সন্ধ্যায় আইজিপি ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রাজধানী ঢাকায় রমনা বটমূল, রবীন্দ্র সরোবর, হাতিরঝিলসহ বৃহৎ জনসমাগমস্থল এবং মঙ্গল শোভাযাত্রায় পুলিশ এবং অন্যান্য সংস্থার সমন্বয়ে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে নিরাপত্তা ঝুঁকি পর্যালোচনা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

বর্ষবরণ উপলক্ষে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা সংক্রান্ত সভায় পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী

পুলিশের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা জোরদার করা হবে জানিয়ে আইজিপি বলেন: রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বড় বড় শপিং সেন্টার, মার্কেট, বাজার, দোকানপাট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসমূহে নববর্ষের হালখাতা অনুষ্ঠান উপলক্ষে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

ফেসবুকসহ অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী যাতে অপপ্রচার চালিয়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাতে না পারে সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন এবং নাশকাতাকারীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নজরদারী বাড়ানো হবে। জরুরি উদ্ধার অভিযানের জন্য প্রস্তুত থাকবে র‌্যাবের হেলিকপ্টার।