সম্প্রতি একটি দৈনিকের শিরোনাম এরকম-৩৫০০ কোটি টাকা নিয়ে চম্পট।
বাংলাদেশে এখন এ রকম খবরে আর আশ্চর্য হবার মত কিছু নেই। কারণ একের পর এক হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দেবার ঘটনা আমাদের চেতনাকে স্থবির করে দিয়েছে। আমরা বোধশক্তি হারিয়ে ফেলছি। বলা ভালো প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, যেন চুরি করাটাই স্বাভাবিক-এরকমই ধরে নিয়েছি।
দেশের মানুষ জানে এর পরবর্তী বিষয়গুলো কি হবে ? পত্রপত্রিকায় বেশ কিছুদিন লেখালেখি হবে। টেলিভিশনের টক শোতে একটু আধটু আলোচনা হবে। সরকার পক্ষের আলোচকগণ বলবেন-আমাদের সরকার এ ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি পালন করবে। সে যেই হোক, দুর্নীতিবাজ দুর্নীতিবাজই। সে আমাদের দলের হলেও তাকে ছাড় দেয়া হবে না।
আর বিপক্ষের সরকার বিরোধী কেউ থাকলে বলবেন-দেশে এখন আইনের শাসন নেই। আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর কাঁধে ভর করে সরকার চলছে। সরকার জনগণের ভোটে নির্বাচিত হলে এ অবস্থা হতো না। সরকারের কাছের লোকেরা এসব দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত। সুতরাং কিছু হবে না।
আর মাঝামাঝি পক্ষের একজন থাকলে বলবেন-এসব ব্যাপারে সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ এখনই নিতে হবে। মানুষকে সচেতন হতে হবে। তারা টাকাটা কোথায় রাখছেন- তার খোঁজ খবর ভালোভাবে জেনেই তবেই বিনিয়োগ করা দরকার। সরকারকে কঠোর হস্তে এসব দুর্নীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে হবে।
এই হচ্ছে এসব দুর্নীতির ঘটনার ফলোআপ। কারণ আজ পর্যন্ত জনগণ দেখেনি, বা জানার সুযোগ পায়নি-হলমার্ক কেলেঙ্কারির নায়কদের কোনো কঠিন শাস্তি হয়েছে কি না। বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের কিছু হয়নি। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির সঙ্গে কারা আসলে জড়িত জনগণ জানতে পারেনি। শেয়ার বাজারের কারসাজির সঙ্গে কারা জড়িত-সরকার ভালো করেই জানে, কিন্তু তাদের কিছুতো হচ্ছেই না বরং তারাই সরকারের নীতি নির্ধারক পর্যায়ে বসে অর্থনীতির চাকাকে চিরতরে পঙ্গু করার জন্য যা যা করা দরকার সবই করে যাচ্ছে। শেয়ারবাজারকে চাঙ্গা করার নামে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা হিসেবে টাকা নিয়ে সেই টাকা কাদের পকেটে যাচ্ছে সবাই জানে। কিন্তু তাদের টিকিটি ধরার কোনো সাহস সরকারের নেই।
ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে কোনো কঠিন পদক্ষেপ নিতে দেখেনি জনগণ। বরং তাদেরকে আরো ঋণ দিয়ে কিভাবে ব্যাংকখাতকে দেউলিয়ার খাতায় নাম লেখানো যায় সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর কারা এইসব সিদ্ধান্ত নিচ্ছে সরকারের কর্তাব্যক্তিরা তো জানেনই, পাশাপাশি সাধারণ জনগণও জানেন। যাদের বিরুদ্ধে অর্থ কেলেঙ্কারি, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত থাকায় মামলা রয়েছে।
ব্যাংকখাতকে বাঁচানোর জন্য জনগণের করের টাকা নেয়া হচ্ছে। প্রতিবছরই এ নিয়ে বেশ লেখালেখি হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। আবার নতুন অর্থবছর এলেই সেই একই সুর-এবারও জনগণের করের টাকা নেয়া হবে ব্যাংককে সচল রাখার জন্যে। আর সরকারের প্রভাবশালী মহল ঋণ নিয়ে ব্যাংককে অচল করে দেবার পাঁয়তারায় মত্ত থাকবে।
সম্প্রতি আরো ভয়াবহ কথা শোনা যাচ্ছে-সাধারণ মানুষ তাদের জমানো টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতো, সেখানে একটু কড়াকড়ির কারণে মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। সরকার এতদিন সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নিতো, সেখানে সুদ গুনতে হতো বেশি। তাই এখন সরকার ব্যাংকের দিকে হাত দিয়েছে। সরকারের এ ঋণ নেয়ার কারণে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা আগের মতো ঋন পাবে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক তথ্য বলছে- চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত সরকার ঋণ নিয়েছে ৪৪ হাজার ৭৭৬ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছে ৭ হাজার ৯৪৭ কোটি টাকা। আর বেসরকারি ব্যাংক থেকে নিয়েছে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এভাবে ঋণ নেয়ার প্রবণতা থাকলে কর্মসংস্থানের বাধা সৃষ্টিসহ জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এখন মূল প্রসঙ্গে আসা যাক, কে নিল এই ৩৫০০ কোটি টাকা সে কিন্তু অন্যদেশ থেকে এসে মেরে চলে যায়নি। এ দেশেরই সন্তান। তার নাম প্রশান্ত কুমার হালদার। পি কে হালদার নামে পরিচিত। বাড়ি পিরোজপুর জেলার নাজিরপুর উপজেলার দিঘিরজান গ্রামে। বুয়েট থেকে স্নাতক শেষ করে ব্যবসায় প্রশাসন নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে উপব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়ে ২০০৯ সালে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হন। এরপর ২০১৫ সালের জুলাই মাসে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন।
তার মানে কি? খুবই বিচক্ষণ সন্দেহ নেই। এরপর একে একে অনেক কিছু করেছে। চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখলে নিয়ে নেয়। খোলেন অসংখ্য কোম্পানি। শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমান শেয়ার কেনে। দখল করার আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা সরিয়েছে ঋণের নামে। বিলুপ্ত হওয়া সেই আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যারা বিনিয়োগ করেছিল তারা এখন টাকা ফেরত পাচ্ছে না।
প্রশান্ত কুমার হালদার এখন উধাও।
এই হচ্ছে মূল খবর। ওই দৈনিকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, পিকে বাবুর এতসব দুর্নীতির পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা জড়িত। বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এর চোখের সামনেই অপকর্ম ঘটেছে। কাগুজে যেসব প্রতিষ্ঠানের মালিকানা রয়েছে তার মা ভাই আর ভাইয়ের বৌয়েরা। একটি ব্যাংকের সাবেক এমডিও তার একটি কোম্পানির মালিকানায় আছে। নিজের নামে শেয়ার না কিনলেও সব ধরণের সুযোগ সুবিধা নিয়েছে এই ধূর্ত পিকে।
প্রশ্ন হচ্ছে-একজন সাধারণ মানুষ যখন তার পারিবারিকভাবে কোনো সম্পত্তি বিক্রি করে ব্যাংকে টাকা রাখতে যায় তখন সেই টাকার উৎস বাংলাদেশ ব্যাংকে না জানালে সেই গচ্ছিত টাকা উত্তোলন করতে পারে না। এটাই নিয়ম। এটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ টাকার মালিক নানা ধরণের কাগজপত্র জমা দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে সন্তুষ্ট করতে পারলেই টাকা উঠাতে বা অন্য কোথাও বিনিয়োগ করতে পারেন। এটা সবদেশেই নিয়ম। অর্থাৎ স্বচ্ছতা। টাকাগুলো বৈধপথে পাওয়া।
কিন্তু সেই বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতরে এই বিষধর সাপ কারা? যারা এত অপকর্মের সঙ্গে গোপনে জড়িয়ে থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে পালিয়ে যেতে সহায়তা করলো পিকে বাবুকে?
তাদের কথা কি সাধারণ মানুষ জানতে পারবে কোনোদিন?
সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার জায়গা তা হলে আর থাকলো কই?
আমাদের ব্যাংকখাত যেভাবে লুটপাট হয়ে যাচ্ছে, শেয়ারবাজার থেকে রক্তচোষারা যেভাবে ক্রিম খেয়ে বেরিয়ে গিয়ে সরকারের খুব কাছে থেকে এখন তারাই নীতি নির্ধারণ করছে শেয়ারবাজারে বিপর্যস্তদের নিয়ে তখন এদেশের অর্থনীতির কি ভয়াবহ অবস্থা হবে সামনে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
বাংলাদেশ ব্যাংক আসলে কাদের দ্বারা চালিত হচ্ছে? তারা চোরবাটপারদের চেয়ে বড় কেউ? যারা সাধারণ মানুষকে নীতির কথা বলে আর প্রকারন্তরে তারাই ব্যাক্তি বিশেষকে লুটপাট করতে সহায়তা দেয়।
মানুষের ভেতরে আস্থার জায়গাটা কে তৈরি করবে? অনেকেই তো কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির সঙ্গে নানা কৌশলে জড়িয়ে আছে। তা হলে আমাদের শেষ ভরসা কি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনা?
অর্থনীতিকে অন্ধকার কুয়া থেকে টেনে তুলে ধরতে তিনি ছাড়া আর কেউ নেই। আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)