সিগার বা চুরুটের ভেতর বিস্ফোরক ঢুকিয়ে বিশ্বজুড়ে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের আইকন কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার পরিকল্পনার কথা তো মোটামুটি সবারই জানা।
কিন্তু তাকে হত্যা করার জন্য শুধু এভাবে একবার নয়, আরও ৬৩৭ বার বিচিত্র রকমের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। যার মধ্যে রয়েছে সামুদ্রিক শামুক-ঝিনুকের খোলসের ভেতর বিস্ফোরক ঢুকিয়ে হত্যা, সাঁতারের পোশাকে বিষ মাখানো, মুখে লাগানোর ক্রিমে বিষাক্ত ট্যাবলেট গুঁড়ো লুকিয়ে রাখাসহ আরও অনেক কিছু।
কাস্ত্রোরই সাবেক এক দেহরক্ষীর লেখা বই ও টিভি তথ্যচিত্র থেকে এসব পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে বিবিসি। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ এবং যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী নির্বাসিত কিউবানরা অর্ধ শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার এসব পরিকল্পনা করে। কিন্তু বিস্ময়করভাবে তার সবগুলোকেই ব্যর্থ করে দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের দশজন প্রেসিডেন্টের শাসনকাল পার করে বেঁচে ছিলেন তিনি।
এ প্রসঙ্গে কিউবার বিপ্লবী এই নেতা একবার নিজেই বলেছিলেন: “আততায়ীদের হত্যাচেষ্টা থেকে বেঁচে যাওয়ার ওপর যদি অলিম্পিকে কোনো প্রতিযোগিতা বা ইভেন্ট থাকত, তাহলে আমি স্বর্ণপদক পেতাম।”
অবশ্য যত পরিকল্পনা করা হয়েছিল তার সবকটিই কিন্তু শেষ পর্যন্ত কার্যকর করা হয়নি। বেশিরভাগই শুধু পরিকল্পনার মধ্যেই সীমিত ছিল বলে জানান কাস্ত্রোর সাবেক দেহরক্ষী ফাবিয়ান এসকেলান্তে।
বিল ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট থাকাকালে বেশ কিছু তথ্য প্রকাশ করা হয়েছিল। সেখানে দেখা যায়, সিআইএ কর্মকর্তারা কাস্ত্রোকে হত্যার জন্য একটা পর্যায়ে শামুক ঝিনুকের মতো ক্যারিবীয় সামুদ্রিক প্রাণীর খোলসের ওপরও গবেষণা শুরু করেছিলেন।
ওই কর্মকর্তাদের পরিকল্পনা ছিল, বৈচিত্র্যময় এরকম কিছু খোলসের ভেতরে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয়া হবে। ফিদেল কাস্ত্রো একজন ডুবুরি ছিলেন। ডুব দিয়ে তিনি যখন ঝিনুকের এই খোলসের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেটা হাতে নেবেন, আর তখনই বিস্ফোরণ ঘটানো হবে – এমনই পরিকল্পনা ছিল।
এরকম আরও একটি পরিকল্পনা ছিল – এমন একটি সাঁতারের পোশাক তৈরি করা, যাতে বিষাক্ত ছত্রাক মাখিয়ে দেয়া হবে। সেই ছত্রাক সংক্রমিত হয়ে কাস্ত্রোর শরীরে রোগ ছড়িয়ে পড়বে এবং তাতেই তার মৃত্যু ঘটবে। পরে অবশ্য এই দু’টো পরিকল্পনাই বাদ দেয়া হয়েছিল।
যুক্তরাষ্ট্রে সেনেট চার্চ কমিশন ১৯৭৫ সালে এ ধরণের ৮টি পরিকল্পনার কথা প্রকাশ করেছিল। তার অনেকগুলো কল্পনাকেও হার মানিয়েছে বলে সেখানে উল্লেখ করা হয়।
এর মধ্যে একটি পরিকল্পনা ছিল ফিদেল কাস্ত্রোর হাতে বিষাক্ত কলম তুলে দেয়া। বলা হয়, সিআইএ’র এক কর্মকর্তা কিউবার একজন গোয়েন্দার কাছে সূই বসানো এরকম একটি কলম প্রায় তুলেই দিয়েছিলেন। কিন্তু কিউবান ওই গোয়েন্দা সেটি নিতে চাননি। কারণ তিনি এর চেয়েও সুন্দর একটি কলম চেয়েছিলেন।
কাস্ত্রোকে হত্যা করার জন্যে তার এক প্রাক্তন প্রেমিকা মারিতা লোরেঞ্জকেও ভাড়া করা হয়েছিল। তাকে দেয়া হয়েছিল বিষাক্ত ট্যাবলেট কাস্ত্রোর পানীয়ের গ্লাসে মিশিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু ফিদেল কাস্ত্রো এই পরিকল্পনার কথা আগেই জেনে ফেলেন। এবং সাবেক ওই প্রেমিকার হাতে তিনি নিজের অস্ত্র তুলে দিয়েছিলেন তাকে (কাস্ত্রো) হত্যা করার জন্যে।
লোরেঞ্জ নিউইয়র্কের একটি সংবাদপত্রকে বলেন, “কাস্ত্রো তখন আমাকে বলেন, তুমি আমাকে মারতে পারবে না। আমাকে কেউ মারতে পারবে না। তারপর একরকম হাসতে হাসতে মুখে চুরুট চিবুতে লাগলেন তিনি। তখন আমি দমে যাই। কারণ তিনি আমার ব্যাপারে খুবই নিশ্চিত ছিলেন।”
এখন পর্যন্ত পাওয়া তথ্য অনুসারে, ফিদেল কাস্ত্রোকে হত্যার সর্বশেষ পরিকল্পনাটি করা হয় ২০০০ সালে। পানামায় কাস্ত্রো যে মঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে ভাষণ দেয়ার কথা তার নিচে প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক রেখে দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু কাস্ত্রোর নিরাপত্তারক্ষীরা সেই পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেয়।
ওই পরিকল্পনায় জড়িত থাকার দায়ে সিআইএ’র গুপ্তচরসহ ৪ জনকে কারাদণ্ড দেয়া হয়েছিল। পরে অবশ্য তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়া হয়।
তবে শুধু হত্যা নয়, এই নেতাকে অপদস্থ করারও কিছু পরিকল্পনা করা হয়েছিল। দাঁড়ির জন্য বিখ্যাত ফিদেল কাস্ত্রোকে তার দাঁড়ি নিয়েই লজ্জায় ফেলার চেষ্টা করা হয় এক সময়।
একবার ঠিক করা হয়, বিদেশ সফরে গেলে কাস্ত্রোর জুতায় থ্যালিয়াম লবণ ছিটিয়ে দেয়া হবে। যেন এর ফলে তার বিখ্যাত দাঁড়ি মুখ থেকে খসে পড়ে। সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়ে যায় যখন কাস্ত্রো নির্ধারিত সফর বাতিল করে দেন।
এছাড়াও একবার প্ল্যান করা হয়, টেলিভিশনে বক্তব্য দিতে যাওয়ার আগে কাস্ত্রোর মুখের ওপর এলএসডি এরোসল স্প্রে করে দেয়া হবে, যাতে তিনি পর্দার সামনে অসংলগ্ন আচরণ করতে শুরু করেন।
এসব পরিকল্পনা এড়াতে কাস্ত্রোকে বহু সতর্কতা অবলম্বন করতে হতো। তবে ১৯৭৯ সালে যখন জাতিসংঘের একটি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিনি নিউইয়র্কে যাওয়ার সময় বিমানে সাংবাদিকদের প্রশ্ন ছিল, তিনি বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরে আছেন কিনা। জবাবে কাস্ত্রো তার শার্ট খুলে তার উন্মুক্ত বুক দেখিয়ে দেন। বলেন, “আমার আছে নৈতিকতার বর্ম।”