একাত্তরে সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থন-সহযোগিতা করেছিল। এটুকুই প্রচারিত। কিন্তু এই সাধারণ মানুষ যে অসংখ্য অসাধারণ কাজও করেছে একাত্তরে, আমরা ভুলেও স্বীকার করি না। বিশ্বে ব্যতিক্রমী ধারা যুক্ত হতে পারে এমন কীর্তিগুলো তাই হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধ হিসেবে বলতে গিয়ে এফএফ, বিএলএফ এবং মুক্তিযুদ্ধের শেষাংশে এসে নিয়মিত বাহিনীর অবদানের কথা লিখি এবং বলি। কিন্তু বিশ্বের যুদ্ধের ইতিহাসে অনন্য সাধারণ ঘটনা, সাধারণ মানুষের যুদ্ধের ঘটনাগুলোকে এড়িয়ে যাই। কেউ কেউ আছেন, তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে চীন কম্বোডিয়ার পিপলস ওয়ারের সঙ্গে তুল্য হয়ে যায় ভেবে মুক্তিযুদ্ধে জনগনের অংশগ্রহণকে সহযোগীর ভূমিকার বেশি বলতে নারাজ। অথচ আমাদের কৃষক, শ্রমিক, সাধারণ মানুষ অস্ত্র হাতেও শত্রুর মোকাবেলা করেছে।
একবারে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক নির্দেশনা যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে, সেই কথাকে অনুসরণ করে। সেই যোদ্ধাদের কথা বলতে আমাদের জিবহা আটকে যায়। এটা কি আমাদের দীনতা নাকি দুর্বলতা জানি না।
কতটা নিস্পৃহ এই বিষয়টিতে, তার প্রমাণ পেলাম গত কয়েক বছর ধরে দৈনিক পত্রিকাগুলোতে ডিসেম্বর ও মার্চ মাসে প্রস্তাব দেওয়ার পর। এবারও একাধিক দৈনিকে প্রস্তাব দিয়েছিলাম জনযুদ্ধকে নিয়ে যেন লেখা প্রকাশ করা হয়। কয়েক বছর আগে ইত্তেফাক একটি সংখ্যা করেছিল হঠাৎ করে। তখন বিশেষ সংখ্যার দায়িত্ব পালন করছিলেন রাজীব নূর। এছাড়া গত ৪৫ বছরে বিশেষ কোনো গুরুত্ব কেউ দেয়নি।
একাত্তর যারা দেখেছেন, তাদের সাক্ষী মানছি। একাত্তরে যারা যুদ্ধ করেছেন, তাদের অনেকেই স্বীকার না করলেও তাদেরও সাক্ষী মানছি। আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র ছাড়াই প্রত্যক্ষ লড়াই করেছেন অনেক। সর্বোচ্চ ত্যাগের কথা যদি বলি তাও সেই সুবাদে তাদের স্বীকার করতে হয়েছে।
আমাদের দেশের খেতাব পাওয়ার যে যোগ্যতা আছে সেগুলো যদি এসব জনযোদ্ধার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হতো তাহলে অনেক যোদ্ধাকেই বীর উত্তম কিংবা বীর শ্রেষ্ঠ খেতাব দিতে হতো। দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে, সেসব বীরদের খেতাব থাক দূরের কথা তারা যে মুক্তিযুদ্ধ করেছে তাও স্বীকার করার পথ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, মুক্তিযোদ্ধার যে সংজ্ঞা করা হয়েছে তার মাধ্যমে। এটা সত্যকে মাটিচাপা দেওয়ার শামিল বলে মনে করি।
দুয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হবে।
হ্যাচকা টানে রাইফেল ছিনিয়ে নেন তবদিল হোসেন
কুমিল্লার ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার কল্পবাস গ্রামের আমীর খানের স্মৃতিচারণ দিয়েই বলি- ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে ধাওয়া খেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ৬ সদস্য এসে আশ্রয় নিয়েছে জাফরগঞ্জ বাজার থেকে দেড়/দুই কিলোমিটার পশ্চিমে মহাসড়কের পাশের একটি পাকা মসজিদে। মসজিদটি ঘেরাও করে রেখেছে হাজার হাজার মানুষ। তারাই মূলত ২৫ কিলোমিটার উত্তরের মীরপুর থেকে তাদের ধাওয়া করে এনেছে এখান পর্যন্ত। পথে ৫/৬জনকে গুলি করে হত্যা করে এসেছে সৈন্যরা। তারপরও সাধারণ মানুষকে থামানো যায়নি। শেষ পর্যন্ত সৈন্যরা মসজিদকে বাংকার বানিয়ে জনতার ওপর গুলি চালাতে থাকে।
হাজার হাজার মানুষ সেখানে দা কুড়াল দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এসেছে। তাদের থামানো কষ্টকর। অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীরা। এর মধ্যে দেবিদ্বার থানা থেকে প্রাপ্ত কিছু অস্ত্র আসে পাশের একটি মাটির ঘরে। রাজনৈতিক নেতারা সেগুলো এনেছে। কিন্তু অস্ত্র চালানোর লোক পাওয়া যাচ্ছিল না। দু’য়েকজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক, ইপিআর ও পুলিশ কিছু অস্ত্র নিয়ে মসজিদের জানালা লক্ষ্য করে গুলি করছেন। কিন্তু জানালা দিয়ে গুলি ঢোকার আগেই পাকিস্তানি সৈন্যরা মাথা নিচু করে ফেলে। যে কারণে বাইরের গুলি তাদের গায়ে লাগছিল না। কল্পবাস গ্রামের আমীর খান মাটির ঘরে থাকা একজনকে বললেন, অস্ত্র দেওয়ার জন্য। একইসঙ্গে তিনি বললেন, যেসব বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য আছেন তারা একত্রিত হোন। মাইকে তাই বলে দেওয়া হলো। ছুটিতে বাড়িতে আসা পুলিশ ইপিআর আর্মির কয়েকজনকে পাওয়া গেল। তাদের সঙ্গে যুক্ত হলো- কিছু অবসরপ্রাপ্ত ব্যক্তি। তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হলো। কিন্তু আক্রমণ করার কোন সুযোগ নেই। পুকুরের পশ্চিম দিক থেকে মসজিদ লক্ষ্য করে যদি গুলি করা হয় তাহলে সেই গুলি মসজিদের ভিতরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ মসজিদের পশ্চিম দিক দিয়ে কোন জানালা নেই। দক্ষিণ দিক কিংবা উত্তর দিকে যে জানালা আছে সেই জানালা দিয়েও গুলি করে লাভ হচ্ছে না। অন্যদিকে সৈন্যরা জানালা দিয়েই গুলি করে সাধারণ মানুষ মারছে।
হ্যান্ড গ্রেনেড থাকলে সাহসী যোদ্ধারা ওই অবস্থায় হয়তো মসজিদের ভিতরে গ্রেনেড মারতে পারতো। সেই সুযোগও নেই। অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যে চলছে সময়। সেই কঠিন অবস্থার মধ্যেও অসাধারণ ঘটনা ঘটে যায় একটা। দেবিদ্বারের দিক থেকে একটা বেবি টেক্সি আসতে দেখা গেল মসজিদের দিকে। প্যাসেঞ্জার ছিল তার ভিতরে। মানুষের জটলায় পড়ে আর সেটি এগিয়ে যেতে পারছিল না। অন্যদিকে মানুষও তাদের বারণ করছে মসজিদের পাশে দিয়ে যেতে। ওই বেবি টেক্সির চালক গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েন। রাস্তায় গাড়ি রেখে তিনিও মিশে যান জনতার কাতারে। বেবি টেক্সি চালক দাঁড়িয়ে পর্যবেক্ষণ করলেন কিছুক্ষণ। তারপর তিনি ঝাঁপ দিলেন পুকুরে। পুকুরের পূর্ব-উত্তর কোণে একটি পাকা ঘাট। মসজিদের মুসুল্লীরা এই ঘাট ব্যবহার করেন ওজু করার জন্য। ফলে মসজিদের উত্তরের দেওয়াল ঘেষে ছিল সরু একটি রাস্তা। রাস্তার উত্তর পাশে স্বল্প উচ্চতার একটি দেওয়াল। বড়জোড় আড়াই তিন ফুট হবে।
যাই হোক সেই ড্রাইভার সাঁতার কেটে ওই ঘাটে গিয়ে ওঠেন। মসজিদের পশ্চিমে ও উত্তর-পশ্চিমে থাকা মানুষের দৃষ্টি তখন তার দিকে। ঘাট থেকে তিনি মসজিদে যাওয়ার পথে চলে গেলেন দ্রুত। তারপর বসে পড়েন। বসে বসেই এগিয়ে যেতে থাকেন মসজিদের জানালা বরাবর। তখন মানুষ বুঝতে পারে, তিনি কী করতে যাচ্ছেন। তখনো মসজিদের ওই জানালা পথে পাকিস্তানি সৈন্যদের একটি রাইফেলের ব্যারেল বেরিয়ে আছে বেশ কিছুটা।
বেবি টেক্সি চালক ধীর গতিতে পা চালিয়ে জানালার কাছাকাছি চলে যান। একবারে কাছাকাছি গিয়ে কিছুটা সময় তাকিয়ে থাকেন রাইফেলের ব্যারেলের দিকে। হঠাৎ হাত বাড়িয়ে হেচকা টান দেন ব্যারেল ধরে। সৈনিকটি বুঝতেও পারেনি এত কাছে কেউ চলে আসবে। জানালার বাইরে ছিটকে পড়ে রাইফেলটি। রাইফেল নিয়ে তিনি দৌঁড় দেন পশ্চিমে ঘাটের দিকে। কি বুঝে তিনি রাইফেলটি ঢিল মেরে দেওয়ালের উত্তর দিকে রাস্তায় ফেলে দেন। রাস্তায় থাকা মানুষজন সেই রাইফেলটি সরিয়ে নেয় দ্রুত। এর মধ্যে একটা সৈন্য মসজিদের জানালা দিয়ে মুখ বের করে দেখে ফেলে। তার হাতে থাকা রাইফেল/পিস্তল দিয়ে গুলি করে চালককে লক্ষ্য করে। সেখানেই চালক ঢলে পড়েন। ওই জনযোদ্ধার নাম ছিল তবদিল হোসেন।
তিনি দেবপুর গ্রামের আলী আহমদ মুহূরীর গাড়ি ভাড়ায় চালাতেন। (পরবর্তীতে তবদিল হোসেনকে তাঁর পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। এই লড়াইয়ে শহীদ হওয়া অন্যদের মতো তিনিও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাননি) এর আগে শাকতলার একটি কিশোরও মারা পড়েছিল পাকিস্তানিদের গুলিতে। এমন অবস্থায় মানুষ পাগলের মতো হয়ে যায়। পারেতো মসজিদের ভিতরেই ঢুকে যায়। মসজিদের পশ্চিমে পুকুর থাকার কারণে পশ্চিম দিকের মানুষগুলো মসজিদের কাছে যেতে পারছে না। পূর্ব ও উত্তর দিকে জানালা দিয়ে গুলি হওয়ার কারণে সেদিক দিয়েও কাছে যেতে পারছে না। দক্ষিণেও জানালা আছে। দক্ষিণ দিকে খোলা জায়গায় একটি কবরস্থান। সেদিকে মানুষ যাচ্ছে না কবরস্থানের পবিত্রতা রক্ষার জন্য।
এমন পরিস্থিতিতে অভিনব কৌশল অবলম্বন করে সাধারণ মানুষ। হাতুড়ী, শাবল, কুড়াল আর মই এনে জড়ো করেছে তারা। কোথা থেকে কে যে এনেছে তার হিসাব নেই। বহু মানুষ ঝাপিয়ে পড়ছে পুকুরে। যাচ্ছে মিম্বরের দক্ষিণে এবং মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালের পশ্চিম দিকে। পুকুর ঘেষা ওই জায়গাটায় সামান্য খালি। অসংখ্য মানুষ সেখানে চলে যায়। মইয়ের সাথে মই জোড়া লাগিয়ে লম্বা করা হয়। তারপর সেই মই লাগানো হয় মসজিদের পশ্চিম দেওয়ালের গায়। একজন দুইজন করে ওঠতে থাকে মসজিদের ছাদে। কিছু লোক ছাদে ওঠার পর শুরু হয় ছাদ ভাঙ্গার কাজ। বোঝা যাচ্ছিল মসজিদের ছাদ ফুটো হতে বেশি সময় লাগবে না। কিন্তু কেউ জানে না তারা তারপর কি করবে। এরমধ্যে কিছু লোক চলে যায় জাফরগঞ্জ বাজারে। সেখান থেকে নিয়ে আসে মরিচভর্তি বস্তা। আনা হয় কেরসিনের টিন। সেগুলোও চলে যায় ছাদের ওপর। একবারে সিনেমার মতো চলে পুরো কাজ। ছাদ ভাঙ্গা শেষ হওয়ার পর সেই বস্তায় কেরসিন ঢালা হয়। তা ঢুকিয়ে দেওয়া হয় মসজিদের ভিতর। জিআই তার বা এমন কিছু দিয়ে সেই বস্তা ঝুলিয়ে রাখা হয়। তারপর ম্যাচের কাঠি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। নিরাপদ দুরত্বে থেকে সেই বস্তা আস্তে আস্তে মসজিদের ভিতরে ঢুকিয়ে দেয় জনযোদ্ধারা। মরিচের ঝাঁঝ এবং ধুয়া কার্যকর ভূমিকা রাখে বলে মনে হতে থাকে। পাকিস্তানিদের রাইফেল থেকে গুলি আসা বন্ধ হয়ে যায় সাময়িক সময়ের জন্য। হয়তো তাদের সবাই প্রচণ্ড আতঙ্কে পড়ে যায়। কারণ একটু আগেই তাদের হাত থেকে রাইফেল ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এখন আবার মসজিদের ছাদ ভেঙ্গে ফেলেছে মানুষ। মরিচের ঝাঁঝ দিয়েছে মসজিদের ভিতর। আতঙ্কের কারণেও হতে পারে তাদের দুজন বেরিয়ে পড়ে মসজিদ থেকে।
ছেড়া কাঁথায় কেরসিন ঢেলে আগুন
আমির খান দেখেন, মসজিদকে বাংকার হিসেবে ব্যবহারকারী সৈন্যরা বেরিয়ে এসেছে। তারা যদি রাস্তায় চলে আসে এলোপাতারি গুলি করবে। সেই অবস্থায় সাধারণ মানুষ আরো মারা যাবে। সুতরাং যে কোনো উপায়ে হোক তাদের ওখানেই শেষ করে দিতে হবে। কিন্তু এর মধ্যে ব্যত্যয় ঘটে গেছে। একজন প্রাক্তন সৈনিককে তিনি তাঁর নিজের অস্ত্রটা দিয়েছিলেন। ফলে অস্ত্রশুন্য অবস্থায় পড়ে যেতে হয় তাঁকে। তিনি চিৎকার করে বললেন, প্রশিক্ষণবিহীন কারো কাছে অস্ত্র থাকলে আপনারা আমাকে অস্ত্র দিয়ে দিন। কাছাকাছি থাকা এক যুবক, মনে হচ্ছিল কলেজের ছাত্র হবে, তিনি এগিয়ে এলেন। নিজের অস্ত্রটা দিয়ে দিলেন আমির খানের হাতে। গুলিও ছিল পর্যাপ্ত। মনের ভরসা পেলেন এবার। বুঝতে পারছিলেন, পাকিস্তানী সেন্য কয়েকটার মনোবল শুন্যের কোঠায়। শুধু অপেক্ষা করছিলেন কিভাবে গুলি করবেন।
তিনি তখন পুকুরের পশ্চিম পাড়ে অবস্থান করছিলেন। দেখলেন পাকা ঘাটের দিকে এগিয়ে আসছে একটা সৈনিক। হাফপ্যান্ট পড়া। হাতে অস্ত্র। সৈনিকটা ঘাটে আসার সঙ্গে সঙ্গে পুকুরের পশ্চিম পাড় থেকে তিনি গুলি করেন। গুলি খেয়ে সৈনিকটি গড়াতে গড়াতে ঘাটের নিচের সিঁড়িতে চলে আসে। বুঝতে পারছিলেন না গুলিবিদ্ধ পাকিস্তানীটি মারা গেছে কিনা। তবে জীবিত থাকলেও সে আর গুলি করে মানুষ হত্যার মতো অবস্থায় নেই এটা মনে হচ্ছিল। তারপরও নিশ্চিত হতে চাইলেন তিনি। জটলা পাকানো মানুষের দিকে তাকালেন তিনি। চিন্তা করতে থাকলেন, রাইফেলের বেয়নেট থাকলে কাজ হতো। দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন বেয়নেটের কাজ করবেন কৃষকের অস্ত্র দিয়ে। দেখলেন তার কাছেই একজন একটা ছুরি নিয়ে এসেছে। সেটাই চেয়ে নিলেন তিনি। ঝাপ দিলেন পুকুরে। সাবধানতা অবলম্বন করলেন, মসজিদের ভিতরে যদি কোন সৈন্য থাকেও সে যাতে তাকে দেখতে না পায়। সাঁতার কেটে চলে গেলেন ঘাটে। তারপর তাকে শেষ করে দিয়ে মসজিদের পশ্চিম দিক দিয়ে গেলেন দক্ষিণে। বারান্দায় একটা বিহারী সৈন্য নিজেকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় দিল। আমির খান তখন মসজিদের দক্ষিণে পূর্বপ্রান্তে বারান্দার কাছে পাকিস্তানি ওই সৈন্য থেকে কয়েক ফুট দূরে ছিলেন।
কিন্তু মানুষ চিৎকার করতে শুরু করেছে প্রচণ্ড। তাদের কথা- বাঙালি হলেও তাকে ছাড়া যাবে না। কারণ পথে পথে সেও মানুষ খুন করে এসেছে। আমির খান চিন্তা করলেন তাকে জনতার হাতে ছেড়ে দিতে হবে। এবং আপোসে তার কাছ থেকে অস্ত্রগুলো নিতে হবে। তিনি বললেন তোমার অস্ত্রগুলো দাও আমাকে। সেখানে পেলেন হ্যান্ড গ্রেনেডও। যা তার জন্য খুবই প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। তিনি তাকে বললেন, তুমি এখান থেকে বেরিয়ে যাও। ও বেরিয়ে যেতেই জনরোশে পড়ে। মানুষ কিল ঘুষি দিতে দিতে তাকে নিয়ে চলে যায় পূর্বদিকে।
এবার তিনি ক্রলিং করে মসজিদের দক্ষিণের দেওয়াল ঘেষে জানালার দিকে যেতে থাকেন। জানালার কাছাকাছি গিয়ে তিনি গ্রেনেড ছুরে মারেন মসজিদের ভিতরে। সঙ্গে সঙ্গে ওরা আরো কয়েকজন বারান্দায় চলে আসে। চরম উত্তেজনা চলছে রাস্তায়। আমির খান বুঝতে পারলেন না মসজিদের ভিতরে আর কেউ আছে কিনা। তারপর তিনি পুকুরে ঝাপ দেন। দক্ষিণ পাড়ে ওঠেন। অনেক মানুষ জড়ো হয়ে আছে পুকুরের তিনদিকে। রাস্তায়তো আছেই।
মসজিদের ভিতরে কেউ আছে কিনা তা নিশ্চিত হতে হবে। মানুষ হৈহৈ করে ওঠে। কারণ মসজিদের ছাদ ভাঙ্গার কাজটি তারা আগেই করেছে। আবার ছাদে ওঠে যায় কিছু মানুষ। বারান্দায়ও আগের মতো আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা করতে হবে। মানুষ হৈহৈ করে ওঠছে ছাদের ওপর। সেখানে মাথা বের করে তারা নিশানা করে নেয় বারান্দার কোন জায়গায় সৈন্যরা অবস্থান করছে। মানুষের হৈহুল্লুরে সম্ভবত পাকিস্তানি সৈন্যরা বুঝতেও পারেনি কোথা থেকে কি হচ্ছে। তারা বারান্দায় বসে ছোট ওয়ালের ওপর ব্যারেল রেখে বাইরে গুলি করছে। ওই সময় ছাদের ওপর থেকে কাঁথায় আগুন জ্বালিয়ে তা উপর থেকে বারান্দায় ফেলে দেওয়া হয়। দাউদাউ করে কাঁথাগুলো জ্বলতে থাকে বারান্দায়। সৈন্যরা পড়ি কি মরি করে স্থান ত্যাগ করে। বারান্দার দক্ষিণ দেওয়ালের পশ্চিম দিকে ছিলেন আমির খান। তিনি ক্রলিং করে বারান্দা বরাবর চলে যান। বারান্দার কাছে গিয়ে তিনি দাঁড়িয়ে যান। বলেন, হ্যান্ডস আপ। একজনকে দেখলেন হাতে গুলি খেয়ে আগেই আহত হয়ে আছে। সে হাত উচু করলেও ধরে রাখতে পারছিল না। সে চিৎকার করে বাংলায় বলছে, আমি বাঙালি আমাকে মারবেন না।
এরপর তিনি মসজিদের পূর্বদিকে চলে যান। বারান্দার পূর্বদিকেও ছোট দেওয়াল ছিল। তিনি মসজিদের ভিতর গুলি করেন। একটা গুলিতে একজনকে শেষ করে দেন। ওই সময় দেখতে পান অস্বাভাবিক চিত্র। একটা পাকিস্তানি সৈন্য সঙ্গে থাকা কিছু টাকা দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলছে। উদ্দেশ্য তার মৃত্যুর পরও যাতে কোন বাঙালি তার টাকা নিতে না পারে। আমির খান রাইফেল দিয়ে আঘাত করলেন তাকে। তার কাছ থেকে টাকাগুলো নিয়ে নেন। স্মৃতি হিসেবে তার কিছু তিনি সংরক্ষণ করেন নিজ ঘরে। তারপর মানুষের ঢল সামলানো কারো পক্ষেই সম্ভব হয়নি। শত শত মানুষ জীবিত ও মৃত সৈনিকদের বের করে নেয় মসজিদ থেকে। গণপিটুনীর মাধ্যমে শেষ হয় গণযুদ্ধের একটি অধ্যায়।
এমন বেশ কিছু ঘটনার তথ্য নিবন্ধকারের সংগ্রহে আছে। এমন তবদিলের মতো সাধারণ মানুষরা কি মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেতে পারে না? তাদের যুদ্ধকে কি যুদ্ধ বলেও স্বীকার করা যাবে না? বহু সাহসী যুদ্ধের কথা লেখা আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বইগুলোতে। এই তবদিলদের কথা যদি লেখা হয়, তাদের বীরত্ব যদি সাধারণ মানুষের সামনে উপস্থাপন করা হয় তাহলেই মুক্তিযুদ্ধে সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ আজকের প্রজন্মের কাছে প্রমানিত হবে। অন্তত মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে সব মানুষের লড়াই হিসেবে গণ্য করবে। (প্রকাশিতব্য বাংলাদেশের জনযুদ্ধ গ্রন্থের অংশবিশেষ)
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)