রাজধানীর হাজারীবাগ এলাকা থেকে তরুণ হোসেন নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর মরদেহ উদ্ধারের পর উঠে এসেছে তার জীবনের করুণ আর নির্মম এক গল্প।
আপাতদৃষ্টিতে একে দুর্ঘটনা বলে মনে হলেও তার সহপাঠীদের দাবি, হতাশায় নিমজ্জিত তরুণ আত্মহত্যা করেছে। শৈশবে মাতৃহারা স্বল্পভাষী, নিভৃতচারী তরুণ কেনই বা হাজারীবাগের নির্মাণাধীন ওই ছয়তলা মসজিদে গিয়েছিল; সে বিষয়টিও স্পষ্ট নয় তাদের কাছে।
বুধবার দুপুরে হাজারীবাগের বেড়িবাঁধ কলার আড়তের কাছে নির্মাণাধীন একটি মসজিদের পাশ থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ।
নিহত তরুণ হোসেন ফিন্যান্স বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। থাকতেন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এ এফ রহমান হলের গণরুমে।
লাশ উদ্ধারের পর পুলিশ তরুণের পকেট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র পেয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে খবর দেয়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার রেকর্ড থেকে ঠিকানা বের করে পরিবারকে জানায়।
পুলিশ ঘটনা তদন্ত করছে বলে জানিয়েছেন হাজারীবাগ থানার ওসি মো. ইকরাম আলী মিয়া।
চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, বুধবার দুপুরে হাজারীবাগের সেকশন এলাকায় বেড়িবাঁধের কলার আড়তের পাশে নির্মাণাধীন একটি ছয়তলা মসজিদের পাশ থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়।
তবে শিক্ষার্থীদের দাবি হতাশার কারণে তরুণ ছাদ থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করেছে।
তরুণের সহপাঠীরা জানায় তরুণ খুবই চুপচাপ ও শান্ত ধরণের ছেলে ছিল। একাকী সময় কাটাতে বেশি পছন্দ করতো। নিজের গায়ের রং ও শারীরিক গড়নের কারণেও কিছুটা হীনমন্যতায় ভুগতো সে।
জানা গেছে, তরুণের পরিবার অার্থিকভাবে দুর্বল হওয়াতে বেশ সংকটেও থাকতে হতো শৈশবে মা হারানো ছেলেটিকে। তবে সব বাধাকে জয় করার সংগ্রামে নেমেছিল তরুণ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর কুলিয়ে উঠতে পারেনি নিরীহ ছেলেটি। সবকিছুকে বিদায় জানিয়ে অজানার বুকেই পাড়ি দিল সে।
তরুণ জিগাতলায় একটি বাসায় টিউশনি করাতেন। তিনি হাজারীবাগে কেন গিয়েছিলেন সে বিষয়ে তার বন্ধুরাও কিছু বলতে পারছে না।
বুধবার সন্ধ্যায় তার মৃত্যুর সংবাদ ক্যাম্পাসে ছড়িয়ে পড়ার পর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে নেমে আসে শোকের ছায়া। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ও বর্তমান ছাত্রদের ফেসবুক ওয়াল ভরে উঠতে থাকে তরুণকে নিয়ে দেয়া আবেগঘন বিভিন্ন পোস্টে।
সাংবাদিক জাহিদ নেওয়াজ খান তরুণকে নিয়ে তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে একজন শিক্ষার্থীর সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক সম্পর্কের বিষয়টি তুলে ধরে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কি শুধু নাম নিবন্ধন আর সনদ দেওয়ার জন্য! মা-বাবা কিংবা পরিবার যখন একটা ছেলে বা মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান, তখন তারা বিভাগীয় শিক্ষক এবং হলের প্রভোস্ট-হাউস টিউটরদের তাদের ছেলেমেয়েদের অভিভাবক বিবেচনাতেই পাঠান। শিক্ষকরা সেই দায়িত্বের মর্যাদা রাখবেন না
আমরা যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন বিভাগীয় কাউন্সেলর ছিলেন অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তার কাছে যেকোনো সমস্যা নিয়ে যাওয়া যেতো। সেটা হোক মাস শেষে বাড়ি থেকে টাকা না আসার জন্য কারো অর্থকষ্ট কিংবা কারো মনোগত কোনো সমস্যা। ছাত্রাবস্থায় কিংবা পাস করে যাওয়ার পর চাকরি-বাকরিতে সহায়তা পাওয়ার জন্যও তার কাছে যাওয়া যেতো।
এখন কি সেইরকম কাউন্সেলিং এর কোনো ব্যবস্থা নেই? থাকলে ছেলেমেয়েরা কি তাদের কাছে কোনো সহায়তা পায় না?
বিশ্ববিদ্যালয় কি শুধু নাম নিবন্ধন আর সনদ দেওয়ার জন্য! মা-বাবা কিংবা পরিবার যখন একটা ছেলে বা মেয়েকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পাঠান, তখন তারা বিভাগীয় শিক্ষক এবং হলের প্রভোস্ট-হাউস টিউটরদের তাদের ছেলেমেয়েদের অভিভাবক বিবেচনাতেই পাঠান। শিক্ষকরা সেই দায়িত্বের মর্যাদা রাখবেন না!
একটা ছেলে ক্রমশ: একা হতে হতে আত্মহননের মতো চরম পথ বেছে নেওয়ার আগে হল এবং বিভাগ কি তার সঙ্গে কখনো বসার চেষ্টা করেছে? কোনো শিক্ষক কি একবারও তার সঙ্গে কথা বলেননি? একবার তার মাথায় মমতার পরশ বুলিয়ে দিতে পারেননি?কথাগুলো শুনতে সনাতনী মনে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের চরিত্রটা সেরকমই হওয়ার কথা ছিল।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান রাহাত তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন,
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স বিভাগের একজন ছাত্র হতাশায় আত্মহত্যা করার খবরে মনটা কাল রাত থেকেই খারাপ হয়ে আছে। টাইমলাইনে বিভিন্ন পোস্ট দেখে যা বুঝলাম, তার সাথে অনেক অন্যায় করা হয়েছে। সে আর্থিক সমস্যায় ছিল, কিন্তু এত ভাল বিভাগ থেকে তাকে সাহায্য করার মত কেউ ছিল না! পৃথিবীর বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাক্তন ছাত্ররা হাজার হাজার ডলার ডোনেশন দেয়। যেহেতু ভাল একটা বিভাগ এখানকার প্রাক্তনরা অবশ্যই বড় বড় অবস্থানে আছে। তারা বিভাগের অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের দিকে নজর দিতে পারত। শরীরের রঙ, গঠন নিয়েও নাকি সে তাচ্ছিল্যের শিকার হয়েছে। ফেসবুকিং সংস্কৃতিতে এটা একটা সাধারণ ব্যাপার। কিন্তু সব মানুষ এক নয়। অনেকের মনে এর জন্য বিরুপ প্রভাব পড়তে পারে।’
স্ট্যাটাসের শেষে হে সমাজ মানুষকে সুখী করতে যদি নাই পারো, দুঃখ কেন দাও? বলে প্রশ্ন রাখেন তিনি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের আরেক সাবেক শিক্ষার্থী ইব্রাহিম মল্লিক সুজন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছেলে আত্মহত্যা করেছেন বলে খবর বেরিয়েছে। খবরে বলা হচ্ছে, তার বাপ-মা ছিলো না। তার পকেটে খাওয়ার টাকা থাকতো না, এ কারণে সৃষ্ট জটিলতায় তিনি অসহায়বোধ করতেন। তার গায়ের রং উজ্জ্বল ছিলো না। প্রচলিত সুন্দরের ধারণাতেও তাকে ফেলা যেতো না। দামি পোশাক পরিধানের বিষয়টি ছিল স্বপ্নের মতো। এসব কারণে তার চারপাশ তাকে ভালভাবে নেয়নি, তার কষ্টের কথাটা কেউ শুনতে চায়নি।
যাইহোক, অবশেষে সে মুক্তি পেয়েছে, জগৎসংসারের এই প্রয়োজন-অপ্রয়োজনের অনেক উপরে উঠে গেছে সে। খবরে তার নামটাও জানা গেছে, তরুণ। এখন হয়তো ‘তরুণে’র জন্য মাতম উঠবে, কিন্তু ‘তরুণ’ এখন বেঁচে নেই। আপনারা সবাই কেমন বোধ করছেন?’