মার্চে সারা পৃথিবীর মানুষের ভীড় জমে কুষ্টিয়ায়। আসেন সাধক, সাংবাদিক ও গবেষক। মুক্তপ্রাণের মানুষের পদচারণায় মুখরিত হয় সংস্কৃতিঋদ্ধ কুষ্টিয়া। এ মাসেই দোল পূর্ণিমা। বাউল সম্রাট লালন স্মরণে বছরে যে দুটি উৎসব জমে এটি তারই একটি। দিন যত যাচ্ছে এই উৎসবের প্রাচুর্য বাড়ছে। সারাদেশ তো বটেই, পৃথিবীর সব প্রান্তের মানুষের মধ্যে খবর হয়ে যাচ্ছে এই ক্ষণটির।
মানুষের চিন্তা ও ভাবজগতের মহান মনিষীর বাণী শুনতে আর তার স্মৃতিধন্য জায়গাটি ছুঁয়ে দেখতেই মানুষের এই আপ্রাণ মিলনের টান। উচ্চতর চিন্তা ক্ষেত্র কুষ্টিয়ার ছেউড়িয়া আখড়াবাড়ি। ফকির লালন সাঁইয়ের সমাধি ঘিরে বিস্তারিত আঁখড়াবাড়ি একটি ক্ষেত্র। এর অল্পদূরেই আরেক বিশ্বচিন্তার প্রতিভু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি ‘শিলাইদহ কুঠিবাড়ি’, পাশে বাংলা সাহিত্যের দিকপাল মীর মশাররফ হোসেনের বাস্তুভিটা, আরেকটু দূরেই বাংলা সংবাদমাধ্যমের অন্যতম চারণক্ষেত্র কাঙাল হরিণাথ মজুমদারের বাড়ি।
আরো আছে। পাশেই বিপ্লবী বাঘা যতীন এর জন্মভিটা। পৃথিবীবাসীর দৃষ্টি দেবার মতো এমন অসংখ্য সোনার খনি আছে কুষ্টিয়ায়। এই খনিগুলি জেগে ওঠে লালন সাঁইকে ঘিরে। লালন সাঁই এককভাবেই এখানে হীরের খনি হয়ে আছেন। সেই সুবাদে কুষ্টিয়ার পর্যটন সম্ভাবনা অতীতে যেমন ছিল আজও আছে। শত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কুষ্টিয়া শহরে এসে ‘টেগর লজ’ এ উঠতেন। বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস বিবেচনা করতে কুষ্টিয়ার বাতাস গায়ে মাখা অপরিহার্য। এই বাতাসে বাঙালির ভাবসাধন, মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক মনিষা বর্তমান।
কিন্তু এই গুরুত্ব উপলব্ধি করে কুষ্টিয়াকে আজও পর্যন্ত পর্যটনের গুরুত্বে সাজানো হয়নি। কুষ্টিয়ায় সমুদ্র ও পাহাড় নেই, কিন্তু যা আছে তা চিন্তার গহীন অরণ্য, ভাবনার অতল সাগর আর সম্ভাবনার সুউচ্চ পাহাড় বললে মোটেও অমূলক হবে না। কিন্তু কুষ্টিয়া হতোদ্যম এক শহর। যে শহর এখন আর মানুষের মমতায় সমৃদ্ধ হয় না, অরক্ষিত হয় ক্ষমতার দাপটে।
কুষ্টিয়ায় এখন এমন এমন অপরাধ ঘটে যা মুহূর্তে পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে চলে যায়। কলঙ্ক লেপটে যায় এই মাটির সর্ব গর্বিত সন্তানদের মুখে।
আগের জের টানতে চাই না। মার্কিন ফ্রিলান্স সাংবাদিক এলিসন জয়েস কুষ্টিয়ায় তার পেশাগত কাজে এসে এক ন্যাক্কারজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হলেন এবার। তিনি উঠেছিলেন কুষ্টিয়ার ছয় রাস্তার মোড়ের একটি হোটেলে। হোটেলটির নাম ‘খেয়া’। বেশ অভিজাত ও আধুনিক এই হোটেলটি। গত ৫ মার্চ রাতের কথা। একটার দিকে ওই হোটেলের মালিকদের একজন বিশ্বনাথ সাহা বিশু মদ্যপ অবস্থায় তার দরজায় নক করা শুরু করেন। সাংবাদিক এলিসন আতঙ্কিত হয়ে দরজা না খুললে বিশু হোটেলের নিবন্ধন খাতা থেকে নাম্বার নিয়ে অনবরত ফোন করতে থাকেন। এক পর্যায়ে দরজায় ধাক্কাও দেন। পরে ফোন পেয়ে স্থানীয় পরিচিত তরুণ আলী আহসান এসে তাকে উদ্ধার করেন। ওই রাতে আরেকটি হোটেলে এলিসনকে রাখার জন্য গেলে ওই হোটেলও একা কোনো নারীকে রাখতে রাজি হয়নি। আলী আহসান অন্যত্র তার থাকার ব্যবস্থা করেন।
এই তথ্যগুলো রোববার সকাল থেকে ফেসবুকে চাউর হচ্ছে। এর মধ্যে সাংবাদিক এলিসন জয়েস মার্কিন দূতাবাসের মাধ্যমে একটি চিঠি দিয়েছেন কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে। এখান থেকে সংবাদ ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র।
সোমবার বেলা ১টায় কুষ্টিয়া পুলিশ বিশ্বনাথ সাহা বিশুকে গ্রেফতার করেছে। যা হোক দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে হোক আর চাপে হোক, পুলিশ এ বিষয়ে সক্রিয় হয়েছে; এটি ভালো দিক। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, পর্যটনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুমে কুষ্টিয়ারে হোটেলগুলো অরক্ষিত থাকে কেন? এখানে কেন আইন প্রশাসনের কঠোর নজরদারি থাকে না। কুষ্টিয়ায় মার্চে ও অক্টোবরে পর্যটকের ভীড় থাকে। নানা প্রয়োজনে দেশের ও বাইরের নারী-পুরুষ যান। লালনভূমিখ্যাত কুষ্টিয়া কি বাইরের মানুষের কাছে ‘অপরাধ নগরী’ সাব্যাস্ত হবে? কেন হবে?
কুষ্টিয়ার এক সাংবাদিক বললেন, বিশ্বনাথ সাহা বিশু ও তার চারপাঁচজন ব্যবসায়ী বন্ধু গত বছর ছয়রাস্তার মোড়ে ‘খেয়া রেস্তোঁরা’ নামে একটি রেস্টুরেন্ট খুলেছেন। অন্য মালিকদের মধ্যে রয়েছেন ব্যবসায়ী অজয় সুরেখা, কামরুজ্জামানসহ আরো দুয়েকজন। এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন কুষ্টিয়া সদরের সংদ সদস্য মাহবুব উল আলম হানিফ। রেস্টুরেন্ট এর সঙ্গেই রয়েছে চার কক্ষের একটি অভিজাত বিশ্রামাগার। আবাসিক হোটেল হিসেবে সেটির কোনো বৈধ অনুমোদন আছে কি-না তা জানা নেই। এই বিশ্রামাগারটি তারা মাঝে মাঝে ব্যবহার করেন বিদেশী ব্যবসায়ী মেহমান এর আবাসিক ব্যবস্থার কাজে। বাকি সময় নিজেদের আমোদ-প্রমোদ ও ভাড়া। ভাড়াও এক রাতের জন্য ৫ থেকে ছয় হাজার টাকা।
ঠিক এই সময়ে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের ঢল নেমেছে কুষ্টিয়ায়। হোটেলের কক্ষ খুঁজে বেড়াচ্ছেন বাইরে থেকে যাওয়া অতিথিরা। কেউ কেউ হোটেল জায়গা পাচ্ছেন না। এরই মধ্যে এক অনাকাঙ্ক্ষিত খবরে এক নেতিবাচক উপলব্ধি ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুকে কুষ্টিয়ার সচেতন নাগরিকরা জানাচ্ছেন উদ্ভুত ঘটনার জন্য আইনি সাজা হোক দৃষ্টান্তমূলক। যার মধ্য দিয়ে পর্যটকের গুরুত্ব ও তাদের সঙ্গে আচরণের শিষ্টাচার সম্পর্কে অনেকেই সতর্ক হতে পারে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)