ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের রাজধানী থেকে ৩০ হাজার কুকুর অন্যত্র অপসারণের সিদ্ধান্তকে অবৈজ্ঞানিক ও স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তারা বলছেন, কুকুরের সঙ্গে মানুষের যে সহাবস্থান সেটা নষ্ট হবে। এছাড়াও কুকুর অপসারণ না করে স্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ (লাইগেশন) পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) শহর থেকে কুকুর সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্তকে বেআইনি মনে করে সম্প্রতি নগর ভবনের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে প্রাণীপ্রেমী সংগঠনগুলো। এছাড়াও এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডে দেয়ালচিত্র এঁকেছে চিত্রশিল্পী ও প্রাণিপ্রেমিরা।
এই শহরে নিপীড়িত প্রজাতি কুকুরের বেঁচে থাকার গল্প, মানুষের পরম বন্ধুত্ব আবার নিপীড়ন, পরিবেশে কুকুরের ভূমিকা জানাতে ‘পথকুকুর-দেয়ালচিত্রে বেঁচে থাকার সংগ্রাম’ শীর্ষক সচেতনতামূলক দেয়ালচিত্র অঙ্কন কর্মসূচি পালন করে পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ার (প ফাউন্ডেশন) নামে একটি প্রাণীপ্রেমী সংগঠন।
উত্তরে বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্প থাকলে দক্ষিণে কেন নয়?
‘‘ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে সংগঠন অভয়ারণ্যের সঙ্গে কুকুরদের বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্প চলছে। যদি উত্তর সিটি করপোরেশনে এই প্রকল্প চলতে পারে তাহলে দক্ষিণে কেন এই প্রকল্প চলবে না’’, এমন দাবি প্রাণীপ্রেমী সংগঠনগুলোর কর্তাব্যক্তিদের।
তারা বলছেন, হাইকোর্টে রিট ছিল রিটের পরে নতুন করে আইন পাশ হয়েছে। সেখানে সাত নম্বর ধারায় স্পষ্ট বলা হয়েছে ‘নিধন বা অপসারণ করা যাবে না।’ মানুষের মানবিকা, নৈতিকতা কেন আইন দিয়ে বুঝতে হবে। আইনে অপসারণ যুক্ত করা হয়েছে, এটা বেআইনি।
পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ারের (প ফাউন্ডেশন) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘‘দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বন্ধ্যাত্বকরণ প্রকল্প করা উচিত, অপসারণ কোন সমাধান না। শহর থেকে যদি কুকুরের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করতে হয় তাহলে তো আপনি অপসারণ করতে পারবেন না। এটা সাময়িক একটা প্রক্রিয়া। যুগ যুগ ধরে কুকুর বাংলাদেশে নিধন হয়েছে, পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে ২০১০ সাল পর্যন্ত দেশে কুকুর নিধন হয়েছে। কিন্তু কুকুর বিলুপ্ত হয়নি। এর বড় কারণ হচ্ছে অপসারণের জন্য কুকুরগুলো নিয়ে যাওয়ার সময় কিছু কুকুর পালিয়ে যাবে। ওই কুকুরগুলো যদি পরের মৌসুমে বাচ্চা দিবে তখন শূণ্যস্থান পূরণ হয়ে যাবে।’’
কুকুর অপসারণ অযৌক্তিক জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘এর মাধ্যমে সাময়িকভাবে মানুষকে খুশি করা গেলেও দীর্ঘমেয়াদি হিসেবে কুকুর কমবে না। ডিএসসিসি’র কাছে আমাদের দাবিটা হচ্ছে আপনারা বন্ধ্যাত্বকরণটা শুরু করেন। আপনি কুকুর অপসারণের জন্য লোক নিয়োগ, গাড়ির তেল ফুরানো, অন্য জায়গায় স্থানান্তরের নানান ঝামেলায় না গিয়ে, শুধুমাত্র প্রাণি সম্পদ বিভাগ থেকে একজন ভেটেনারি সার্জনের মাধ্যমে বন্ধ্যা করবেন। তারপর কুকুরটাকে এলাকায় আবার ফেরত পাঠাবেন। এইভাবে পাঁচ দশ বছর গেলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি আর পাবে না। এটাই প্রক্রিয়া।’’
এমিল বলেন, ‘‘বর্তমানে সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগের একটি জাতীয় কর্মসূচির প্রকল্প চলেছে। জাতীয় নির্মূল কমিটির অধীনে সারাদেশের ৭০ ভাগের ওপরে কুকুরকে এক রাউন্ড জলাতঙ্ক নির্মূল টিকা দেওয়া হয়েছে। এবং সরকার প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ২০২২ সালের মধ্যে কুকুরের জলাতঙ্ক নির্মূল করতে হবে। এখন সিটি করপোরেশন যদি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে সমন্বয় না করে কুকুরগুলোকে সরিয়ে দেয়, এরপরে যে কুকুরগুলো অবস্থান নেবে সেগুলো টিকা পাবে কি পাবে না, সেটা কিভাবে বুঝবেন। এখানে জনস্বাস্থ্যের একটা হুমকি থেকেই যাচ্ছে। জলাতঙ্ক সেখানে আবির্ভাব হতে পারে। দেখা যাচ্ছে একটি বিভাগ টিকা দিয়ে গেল আর আরেকটি বিভাগ কুকুর ফেলিয়ে দিচ্ছে।’’
মানুষের বিরক্তির কারণ কী?
রাকিবুল হক এমিল বলেন, ‘আসলে ডিএসসিসি এলাকার মধ্যে পুরান ঢাকার রাস্তাগুলো অনেক সরু। এখন ভাদ্র মাসে কুকুর প্রজননের জন্য ছোটাছুটি বেশি করে। যে কুকুরগুলো সারা বছর ঘুমিয়ে ছিল কিংবা শান্ত ছিল তারাই ছোটাছুটি বেশি করছে। তাই হঠাৎ করে মনে হচ্ছে কুকুর বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কুকুরের ছোটাছুটিতে মানুষ বিরক্ত হচ্ছে।’
কুকুরের কামড় বেড়ে যাবে ও রেবিস ভাইরাস বৃদ্ধি পাবে
কুকুর অপসারণের সিদ্ধান্তের ফলে কুকুরের কামড় বেড়ে যাওয়া ও রেবিস ভাইরাস বৃদ্ধির ঝুঁকি সৃষ্টি করবে বলে জানিয়েছেন সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের সাবেক পরিচালক ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ।
‘এটা সম্পূর্ণ ভুল সিদ্ধান্ত, বিজ্ঞান বিরোধী সিদ্ধান্ত। এমন সিদ্ধান্তের ফলে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অবৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের ফলে কুকুরের মধ্যে যে হের্ড ইমিউনিটি তৈরি হয়েছিল সেটা নষ্ট হয়ে যাবে। কুকুরগুলো যে এলাকাগুলিতে থাকে সেসব এলাকার মানুষগুলোর সঙ্গে একটা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিরাজ করে। তারা সাধারণত স্থানীয় কাউকে কামড় দেয় না।’
আইইডিসিআরের সাবেক এই প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘যখন এই কুকরগুলোকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যাওয়া হবে তখন তারা সেখানকার কুকুরদের মানবে না এবং স্থানীয়দের মানবে না। ফলে কুকুরে কুকুরে মারামারি হবে এবং কুকুর মানুষদেরও মারতে যাবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর রেবিস নির্মূলে সারা দেশ জুড়ে টীকা দিয়ে যাচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কুকুরগুলোকেও টিকা দেওয়া হয়েছে। সুতরাং রেবিস না ছড়াতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তারা যথাযথ দায়িত্ব পালন করেছে।’
কুকুর অপসারণ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের একটি স্বেচ্ছাচারী সিদ্ধান্ত জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তারা কখনো মানুষকে নিরাপদ করার জন্য কুকুরকে টিকা দেয় নি। এখন যেখানে স্বাস্থ্য বিভাগ কুকুরগুলোকে টিকা দিয়ে ফেলেছে তখন তাদের সঙ্গে আলোচনা না করে এই ধরণের একক সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সেচ্ছ্বাচারিতা। এটা জনগণের জন্য ক্ষতি হবে।’
কুকুর অপসারণের বিষয়ে সর্বশেষ তথ্য জানতে চেয়ে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শাহ মো. ইমদাদুল হককে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেন নি। এছাড়াও ডিএসসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদের মুঠোফোন বন্ধ পাওয়া যায়।
পরিবেশ বান্ধব কুকুর
‘‘ব্যাঙ না থাকার কারণে, ফড়িং না থাকার কারণে, গাপ্পি মাছ না থাকার কারণে মশা নিয়ে আমাদের উৎপাত শুরু হয়েছে। এর জন্য ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া হচ্ছে। তেমনি কুকুর না থাকতে আমরা বুঝতে পারব কি কি রোগ আমাদের পোহাতে হয়’’, বলছিলেন ‘প’ ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান রাকিবুল হক এমিল।
তিনি বলেন, ‘একবার নিউইয়র্কে যখন কুকুরদের ধরে সেল্টার হোমে পাঠানো হলো তখন সেখানে ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে গেল। আমাদের শহরেও ড্রেন ও ম্যানহলে লাখ লাখ ইঁদুর আছে। তাদের বংশ বিস্তার কুকুরের চাইতেও অনেক দ্রুত হয়। কুকুরগুলো যখন রাতের বেলায় রাস্তা ঘাটে ঘুরে বেড়ায় তখন কিন্তু ইঁদুরগুলো বাইরে বের হতে পারে না। ইঁদুর প্রায় ১৪ থেকে ১৫টা রোগের বাহক।’
ভালোবাসা নিয়ে কুকুরের পাশে
আহত প্রাণীকে সহায়তা, প্রাণীর প্রতি মানুষের মমতা ও সচেতনতা বৃদ্ধি করতে স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান হিসেবে ফেসবুক ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ২০১৫ সালে যাত্রা শুরু পিপল ফর এনিমেল ওয়েলফেয়ারের (প ফাউন্ডেশন)। সরকারিভাবে স্বীকৃতি পায় ২০১৬ সালে।
মিরপুর-গাবতলী বেড়িবাঁধের পাশে কুকুরদের জন্য প-ফাউন্ডেশেনের রেসকিউ অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার। নির্যাতিত ও আহত প্রাণির চিকিৎসার্থে প-ফাউন্ডেশন চালু করে প-লাইভ কেয়ার সেন্টার। কুকুর-বিড়ালের চিকিৎসার প্রতি বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় এ সেন্টারে।
প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে ক্লিনিকে একজন পশু চিকিৎসক সেবা দেন। এছাড়া এখানে কুকুরের জন্য শ্যাম্পু, বেল্ট, খাবার ও ওষুধও পাওয়া যায়। এগুলো বিক্রি করে অবহেলিত কুকুরের সেবায় ব্যয় করা হয়।
সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল বলেন, ‘‘আমাদের ঢাকা, যশোর ও খুলনা মিলিয়ে প্রায় ৪০ জন সদস্য। এরমধ্যে যশোরে খুব ভালো কাজ হচ্ছে এবং খুলনায় ধীর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে।’’