যুগে-যুগে, কালে-কালে পৃথিবীতে চলেছে রাজার শাসন তথা রাজতন্ত্র। একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী এসব শাসকেরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আধিপত্য ও ক্ষমতার লোভে হয়ে যেতেন অন্ধ। কোনো বিবেকবোধ বা মানবতাবোধ তাদের মধ্যে আর অবশিষ্ট থাকত না।
“রাজায় রাজায় লড়াই, উলুখাগড়ার প্রাণান্ত!” এটাই ছিল তৎকালীন সময়ের এক চরম সত্য।এমনই এক সমাজ বাস্তবতার গল্প নিয়ে পাঠক সমাজে হাজির হয়েছেন তরুণ কথাসাহিত্যিক কিঙ্কর আহসান।
‘রাজতন্ত্র’ উপন্যাসের সূচনা হয় নাসরিন আহমেদ নামের এক নারীর হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে। এ হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে ঘটতে থাকে নানা ঘটনা। আসে প্রেম, আসে বিরহ। নিরীহ মানুষ পরিস্থিতির শিকার হয়ে বাস্তুহারা হয়ে পড়ে। গ্রামের সহজ-সরল মেয়েটির ঠাঁই হয় পতিতালয়ে। শেষ মুহূর্তে গিয়ে উন্মোচিত হয় মূল রহস্য। বাকি সময়ে ঘুণাক্ষরেও এ ব্যাপারে কোনো আঁচ পর্যন্ত পাওয়া যায়না। এভাবে অনেকটা সিনেমার ঢঙে এগিয়ে চলে উপন্যাসের গল্প। এ ব্যাপারটি অভিনব লেগেছে আমার কাছে।
উপন্যাসের মূল চরিত্রে রয়েছেন জলিল সাহেব নামে এক ক্ষমতা ও অর্থলোভী ব্যবসায়ী। সমাজের একদম নিম্নস্তর থেকে উঠে আসা এ ব্যক্তি ক্ষমতা ও অর্থের লোভে মানবতা বিবর্জিত হয়ে পড়েন। এ দুইয়ের সমন্বয় তাকে অন্ধ করে দেয়। ক্ষমতা ও অর্থের জন্য এমন কোনো হেন কাজ নেই, যা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধাবোধ করেন তিনি। এমনকি নিজের একমাত্র ছেলেকে নিজহাতে খুন করতেও দ্বিতীয় বার ভাবেন নি তিনি। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, নিজের ক্ষমতার মসনদ ধরে রাখতে সম্রাট জাহাঙ্গীর তার বিদ্রোহী জ্যেষ্ঠ পুত্রের চোখ অন্ধ করে দিয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। জলিল সাহেব এ সবই করেছেন কেবল নিজের একক আধিপত্য বজায় রাখবার জন্য।
গল্পে তার ছেলে সামিরকে উপস্থাপন করা হয়েছে এক সহজ, সরল, মাতৃভক্ত প্রাণী হিসেবে। এক সময়ের প্রাণচঞ্চল যুবক সামির বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজেকে গুটিয়ে নেয়। ঘরের ভেতর আবদ্ধ করে নেয় নিজেকে। তার তেমন কোনো বন্ধু থাকে না, যার কাছে প্রাণ খুলে সবকিছু নিঃসঙ্কোচে বলতে পারবে। তার পাশে বন্ধুবেশে যাদেরকে থাকতে দেখা যায়, তারা আসলে দুধের মাছি; নিজেদের স্বার্থোদ্ধার হলেই কেটে পড়বে আস্তে করে। এ জন্য তার বন্ধুত্ব হয় গাছপালা, পশুপাখির সাথে। মানুষ তার সাথে প্রতারণা করলেও এরা কখনওই প্রতারণা করবে না—-এটাই তার বিশ্বাস।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে রয়েছে খসরু নামের এক ব্যক্তি। জলিল সাহেবের ডানহাত বলে পরিচিত এ ব্যক্তি তার সকল কুকর্মের সাক্ষী। জলিল সাহেব কোথায় যান, কী করেন, সব ব্যাপারে তার কাছে তথ্য থাকে। তবে দুশ্চরিত্র লোকের সহচর হলেও সে ব্যক্তিগতভাবে ভালো লোক থাকে। জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা প্রদীপের নিচে যেমন নিঃশব্দে মোমবাতির গাত্রদাহন চলতে থাকে, তার ক্ষেত্রেও তেমনটিই ঘটে। বলা বাহুল্য, ফলশ্রুতিতে তার পরিণাম খুব একটা সুখকর হয়না।
এ তো গেল সমাজের এক দিককার গল্প। এর বাইরেও আরেকটি গল্প রয়েছে। সেটি এক সাধারণ মানুষের গল্প। একজন সাধারণ শিল্পী ও তার পরিবারের গল্প। সময়ের পরিক্রমায় ইহজগতের জটিলতা ও কুটিলতা সম্পর্কে অজ্ঞ শিল্পী যশোরথ ও তার পরিবার এ দ্বন্দ্বের গল্পে জড়িয়ে পড়ে। সবসময় মানুষের উপকার করে যাওয়া শৌখিন এ মানুষটি ফেঁসে যায় আরেক নিরীহ একজন মানুষ শাফিনকে উপকার করতে গিয়ে। শাফিনও তাদের মত পরিস্থিতির শিকার একজন মানুষ। এভাবেই এগিয়ে চলে গল্প।
এগুলো ছাড়াও ঔপন্যাসিক তার উপন্যাসের প্রয়োজনে আরও কিছু গৌণ চরিত্রের আশ্রয় গ্রহণ করেছেন। এসব চরিত্র কখনো সমাজের শাসক শ্রেণীর স্থানীয় প্রতিনিধি ও মধ্যস্বত্তভোগী সহযোগীদের প্রতিনিধিত্ব করে, কখনো বা আপামর শোষিত শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব করে।
উপন্যাসের গল্প ও চরিত্র চিত্রণ নিয়ে বস্তাপচা আলাপ তো আর কম হলো না! এবার আসা যাক ভাষাশৈলী ও শব্দচয়নের গল্পে। পুরো উপন্যাসটি বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করে রচিত হলেও তাদের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য মিল রয়েছে। প্রতিটি অংশের সাথে অন্যান্য অংশের সংযুক্তি রয়েছে, বিচ্ছিন্নতা নেই। অনেকটা থ্রিলারের ভঙ্গিমায় এগিয়েছে উপন্যাসের গল্প। এ কাজে ঔপন্যাসিককে বেশ মুনশিয়ানার পরিচয় দিতে হয়েছে বৈকি! লেখক হিসেবে তার দক্ষতার আড়ালে এ ব্যাপারটি চাপা পড়ে গিয়েছে। দারুণ লিখনশৈলীর কারণে এ ব্যাপারটি অসামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হয়নি আমার। পুরো উপন্যাসটি বেশ প্রাঞ্জল ভাষায় উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে মাঝেমধ্যে কিছু বানান জনিত ত্রুটি একজন সচেতন ও অনুদার পাঠক হিসেবে আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। এছাড়া কোথাও তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য কোনো ত্রুটি লক্ষণীয় নয়। সব মিলিয়ে এক কথায় দারুণ লেগেছে বইটি আমার। আশা করি, অন্য বইপ্রেমী পাঠকদেরও বইটি খারাপ লাগবে না তেমন।
“মা, মা গো, বাবা চায় আমি ক্ষমতাবান হই, রাজা হই। আমি তো রাজা হতে চাই না। মানুষ হতে চাই।”
সাম্প্রতিক সময়কার মানবতাবোধ বিবর্জনের লড়াইয়ে গোটা বিশ্ব মেতে ওঠবার সময়ে উপন্যাসের শেষভাগে উল্লেখিত সামিরের এ উক্তি হোক আমাদের আজকের দিনের চাওয়া!
পাঠ অনুভূতি সুখের হোক!
বইয়ের নাম: রাজতন্ত্র
লেখক: কিঙ্কর আহসান
বইয়ের ধরন: উপন্যাস
প্রকাশক: বর্ষা দুপুর
প্রথম প্রকাশ: অমর একুশে বইমেলা, ২০১৮
মুদ্রিত মূল্য: ২৭০ টাকা
রিভিউ লেখক: মোঃ আশিকুর রহমান খান