বাংলা ভাষায় আবৃত্তিশিল্পকে ব্যাপক পরিসরে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে যে গুণীরা কাজ করে গেছেন, কামরুল হাসান মঞ্জু তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য একজন। জীবনজুড়ে মঞ্চ, গণমাধ্যম আর অডিও অ্যালবামে বহু কবিতার হৃদয়গ্রাহী আবৃত্তি করে গেছেন এই শিল্পী। এই শিল্পে তাঁর বিচরণ শুধুু আবৃত্তি পরিবেশনার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আবৃত্তির লক্ষ্য আর আঙ্গিক নিয়ে নিরন্তর ভেবে গেছেন কামরুল হাসান মঞ্জু। এ নিয়ে তিনি গবেষণা করেছেন। লিখেছেন। বই প্রকাশ করেছেন। আবৃত্তি বিষয়ে কামরুল হাসান মঞ্জুর বই ‘বৃত্তের ওপারে ঝুমকো ফুল’ সমাদৃত হয়েছে।
মানুষের পক্ষে কথা বলার যে সামাজিক দায়বদ্ধতা, তার শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে তিনি আবৃত্তিকে দেখেছেন। আবৃত্তির জন্য তাঁর কবিতা নির্বাচনে এর প্রতিফলন দেখা যায়। আবৃত্তির সংগঠন গড়ে তোলার মধ্য দিয়েও তিনি বিদ্যমান সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে শিল্পের সময়োপযোগী প্রয়োগে কাজ করে গেছেন। স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়ে গণতান্ত্রিক উত্তরণের আন্দোলনে মঞ্জু তাঁর আবৃত্তি পরিবেশনা আর সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নিরলস কাজ করে গেছেন। আবার সামাজিক অসঙ্গতি-অনিয়ম-শোষণ-বঞ্চনা-বৈষম্যের বিরুদ্ধেও তিনি তাঁর শিল্পমাধ্যম ব্যবহার করে সোচ্চার ছিলেন।
শিল্পীদের যূথবদ্ধতায় বিশ্বাস করতেন কামরুল হাসান মঞ্জু। এ জন্য স্বরিত নামে সংগঠন গড়ে তুলে অনেক দলীয় পরিবেশনা এবং আবৃত্তি প্রযোজনার গ্রন্থনা ও নির্দেশনা করেছেন তিনি। আর সেগুলো শিল্প আঙ্গিক হিসেবেও বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে। যা এই মাধ্যমে যুক্ত অনেকের মাঝে অনুকরণীয়ও হয়ে ওঠে। তাঁর গ্রন্থনা ও নির্দেশনায় উল্লেখযোগ্য আবৃত্তি প্রযোজনাগুলোর মধ্যে রয়েছে- দলছুট কবিতার কঙ্কাল, ১৯৯৯, পাঠশালা; বৃত্তের ওপারে ঝুমকো ফুল, ১৯৯৮, স্রোত আবৃত্তি সংসদ; দূরের পাল্লা, ১৯৯৬, স্বরিত; পরাণের গহিন ভেতর, ১৯৯৫, স্বরিত; যদি বৃষ্টিনামে, ১৯৯৪; পরাণের গহিন ভেতর, ১৯৯১, স্বরিত; পৃথিবী আমাদের বন্ধু, ১৯৯০, স্বরিত; কালো মানুষের গান, ১৯৮৯, স্বরিত; গীতসুধারসে এসো, ১৯৮৮, স্বরিত; রুদ্র তোমার দারুণ দীপ্তি, ১৯৮৬, স্বরিত; রুপালী স্নান সোনালী কাবিন, ১৯৮৫, স্বরিত; আমরা অনার্য আমরা দ্রাবিড়, ১৯৮৪, স্বরিত; প্রসূনের জন্য প্রার্থনা, ১৯৮৩ এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছয়শিল্পীর পরিবেশনা, ১৯৮৩।
একক আবৃত্তি পরিবেশনাগুলোর মধ্যেও তিনি তাঁর ভিন্নমাত্রিক চিন্তার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। কবিতার ছবি আঁকতে চেয়েছেন। আত্মার উচ্চারণ করতে চেয়েছেন। এর জন্য চিন্তা-ভাবনা আর চর্চায় তাঁর কোনো বিরতি ছিল না। কামরুল হাসান মঞ্জুুর একক আবৃত্তি অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে- মেঘের ভেতর আত্মগোপন, ১৯৯৬; একক সন্ধ্যা দ্বিতীয়, ১৯৯৪ এবং একক সন্ধ্যা প্রথম, ১৯৯৩। এছাড়া তাঁর উল্লেখযোগ্য মঞ্চ পরিবেশনা যদি বৃষ্টি নামে, ১৯৯৬, পাঠশালা এবং ফাউস্ট, ১৯৮২, গ্যোটে ইনস্টিটিউট।
কামরুল হাসান মঞ্জুর আবৃত্তি অ্যালবামগুলো হলো আমরা আবহমান ধ্বংস এবং নির্মাণে, ১৯৯৮ ও ২০০৯; তুমি হেমন্তের মতো, ১৯৯৪ ও ২০০৯; তুমি সুন্দর শুধু সুন্দর, ১৯৯৪ ও ২০০৯; যদি বৃষ্টি নামে, ১৯৯৪ ও ২০০৯; চির প্রণাম অগ্নি, ১৯৯৩ ও ২০০৯; দুজনে মিলে কবিতা, ১৯৯৩ ও ২০০৯; কালবেলার সংলাপ, ১৯৯২ ও ২০০৯; গীতাঞ্জলি, ১৯৯১ ও ২০০৯; এক অচ্ছুত অনার্য, ১৯৮৯ ও ২০০৯; যন্ত্রণার জয়াশা, ১৯৮৮ ও ২০০৯; কালো কবিতার কোলাজ, ১৯৮৮ ও ২০০৯, অর্জুন শুধু অর্জুন, ১৯৮৭ ও ২০০৯ এবং প্রসূনের জন্য প্রার্থনা, ১৯৮৬ ও ২০০৯।
সহযাত্রী আর পরবর্তী প্রজন্মকে আবৃত্তির উৎকর্ষে ঋদ্ধ করতে দেশজুড়ে তিনি আবৃত্তি প্রশিক্ষণ পরিচালনা করে গেছেন। প্রশিক্ষণের এই ধারাটিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেও কাজ শুরু করেছিলেন কামরুল হাসান মঞ্জু। ‘পাঠশালা’ নামে একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেছিলেন তিনি।
বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের সাথেও প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই যুক্ত ছিলেন কামরুল হাসান মঞ্জু। আবৃত্তিশিল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ তাঁকে গোলাম মুস্তাফা পদক ২০১৯ ’এ ভূষিত করে। এছাড়াও তিনি বেশ কিছু সম্মনানা ও সংবর্ধনা অর্জন করেন। বছরের শ্রেষ্ঠ আবৃত্তি প্রযোজনার জন্য ‘কামরুল হাসান মঞ্জু’ আবৃত্তি পদক প্রবর্তন করেছে বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদ।
২.
কামরুল হাসান মঞ্জু পেশাগত জীবনে গণমাধ্যম বিষয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ছিলেন। গণমানুষের গণমাধ্যম তৈরিতে নিজেকে নিবেদন করেন তিনি। এ লক্ষ্যে ম্যাস-লাইন মিডিয়া সেন্টার- এমএমসি নামে বেসরকারি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন মঞ্জু। এই সংস্থার মাধ্যমে- সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণমাধ্যমে তাদের কণ্ঠস্বর তুলে আনার লক্ষ্যে কাজ করে গেছেন তিনি। প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোর বঞ্চিত মানুষ যাতে তাদের নিজেদের সমস্যা-সম্ভাবনা-চাওয়া-পাওয়া-অধিকার-বঞ্চনার কথা তুলে ধরতে পারে, সেজন্য ‘তৃণমূল সাংবাদিকতা’র প্রসারে কাজ করে গেছেন মঞ্জু। দেশজুড়ে, বিশেষ করে উপকূলীয় এবং সমতলের আদিবাসীঅধ্যুষিত অঞ্চলে সাংবাদিকদের দক্ষতা উন্নয়ন তাঁর কাজের বড় ক্ষেত্র ছিল। তরুণ সমাজের মাঝে গণমাধ্যম-শিক্ষার প্রসার ঘটাতেও কাজ করেন তিনি। সাধারণ মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে মিডিয়া অ্যাডভোকেসি এবং গবেষণাও তাঁর কাজের অংশ ছিল। সংস্থার মাধ্যমে ‘লোক সংবাদ’, ‘মেঠো বার্তা’ ও ‘সবার কথা’ নামে প্রত্রিকা ও ‘প্রান্তজন’ নামে জার্নাল এবং বহু বই প্রকাশ করেন তিনি। ‘লোক বেতার’ নামে কমিউনিটি রেডিও প্রতিষ্ঠা করে গেছেন কামরুল হাসান মঞ্জু।
সাংবাদিকতা বিষয়ে তাঁর বইগুলোর মধ্যে রয়েছে- ‘সাংবাদিকতার খাতেখড়ি’, ‘সংবাদে নারীর সঠিক উপস্থাপনা’, ‘অ্যাডভোকেসি রিপোর্টিং এবং নীতিমালা: সংবাদ লিখন ও পরিবেশন’। গবেষণা নিয়ে তিনি লিখেছেন- ‘গবেষণা: রীতি ও পদ্ধতি’।
কয়েক বছর অসুস্থতায় ভোগার পর ২০১৯ সালের ২১ সেপ্টেম্বর রাজধানীর বাসায় মৃত্যুবরণ করেন কামরুল হাসান মঞ্জু। দ্বিতীয় প্রয়াণ বার্ষিকীতে এই গুণীর প্রতি শ্রদ্ধা।