চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কাতালোনিয়ার জনগণের ইচ্ছের কোন মূল্য নেই?

জনগণের ইচ্ছেকে বলা হয় স্বাধীনতা। মানুষ, দেশ, জাতি স্বাধীনতা চায়, স্বাধীন হতে চায়। কিন্তু আদতেই কি মানুষের ইচ্ছের কোনো মূল্য আছে? মানুষ কি প্রকৃতই স্বাধীন?

একাত্তরে অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু সত্যিই কি আমরা স্বাধীন? পৃথিবীর কোনো জাতি, কোনো মানুষ কি আদতেই স্বাধীন হতে পারে? ইচ্ছের মূল্য পায়? স্বাধীনতা এমন একটা শব্দ যেটা আমরা অর্জন করেছি কাগজে-কলমে। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে এর বাস্তবায়ন কি এখনও সম্ভব হয়েছে? পরিবার থেকে শুরু করে বৈশ্বিক পর্যায়ে আমরা সব জায়গায় সাবঅর্ডিনেটেড বা ডমিনেটেড। আমরা স্বাধীন নই আমরা পরনির্ভরশীল।

প্রকৃতপক্ষে বাস্তব জগতে স্বাধীন ইচ্ছা বলে কিছু নেই। আমরা যাকে স্বাধীন ইচ্ছে বলে মনে করি সেটি আসলে গড়ে উঠেছে প্রকৃতি এবং পরিবেশের পরাধীনতার উপর ভিত্তি করে। আমাদের কোন স্বাধীন ইচ্ছেশক্তি নেই। আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশের কাছে পরাধীন। আমাদের ইচ্ছেশক্তিও প্রকৃতি এবং পরিবেশের কাছে পরাধীন।

যদি আমরা বৈষয়িক দিক থেকে বিচার করি তাহলেও দেখা যায়, আমাদের ইচ্ছের বা স্বাধীনতার তেমন কোনো মূল্য নেই। বরং টাকা-পয়সার সঙ্গে অনেক বেশি সম্পৃক্ত ইচ্ছের স্বাধীনতা। আমাদের নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস থেকে শুরু করে আমাদের প্রতিটা মুহূর্ত, মৃত্যুকাল বা মৃত্যুপরবর্তী সময়েও অতি আবশ্যকীয় অনুষঙ্গ হিসেবে আষ্টেপৃষ্ঠে এমনভাবে জড়িয়ে আছে যে তা থেকে আমাদের মুক্তি নেই। তবে কি এই মূর্ত-জগতের ব্যবহারিক অধিপতি মানুষ প্রজাতিটা আসলে পরাধীন? আসলেই তাই। রাস্তার ফকির থেকে ক্ষমতার শীর্ষদেশে অবস্থানকারী প্রাসাদবাসী ব্যক্তিটিও প্রকৃত অর্থে পরাধীনই। জ্যাঁ জ্যাক রুশো কি আর এমনি এমনি বলেছিলেন, ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মগ্রহণ করে এবং সর্বত্র সে শৃঙ্খলে আবদ্ধ। একজন মানুষ নিজেকে অন্যদের প্রভু মনে করে, কিন্তু সে অন্যদের চেয়েও বেশি দাস।’

কাতালোনিয়া-স্পেন
বামে: মারিয়ানো রাহয়, ডানে: কার্লেস পুজদেমন

এই শৃঙ্খল, এই পরাধীনতা অস্বীকার করা বা এড়িয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। সভ্যতার অনিবার্য শর্ত হিসেবে তা এড়িয়ে যাবোই বা কীভাবে! সভ্যতার অপরিমেয় দীর্ঘ চেইনের এই যে অতিক্ষুদ্র অংশ আমরা প্রত্যেকে, সেই চেইন তো বহু বিস্তৃত বহুধাবিভক্ত একটা অভিন্ন প্রবাহমাত্র। এই প্রবাহে রয়েছে ব্যক্তিক, পারিবারিক, সামাজিক, রাষ্ট্রনৈতিক, আন্তর্জাতিক, সময়কালিক হাজারো লক্ষ শাসন, অনুশাসন, নিয়ম-নীতি, বিধি-বিধান, স্বপ্ন পরিকল্পনা, অধিকার ও ব্যবহারের আন্ত-প্রসারী পারস্পরিক গ্রন্থিতে আটকানো একটা ধারাবাহিকতা, চেইন রিং-এর মতোই। এখানে বিশ্লিষ্ট হবার সুযোগ কোথায়?

আমরা কারো না কারো বশ্যতা বা দাসত্ব মেনেই দুনিয়ায় টিকে আছি। যদিও মানুষের প্রবৃত্তি হল কারো দাসত্ব স্বীকার না করা। প্রতিটি মুহূর্তে সে কারো না কারো দাসত্ব করে যাচ্ছে, শুধুমাত্র নিজের অহংবোধ এর কারণে স্বীকার করতে রাজি নয়। এক বা একাধিক সত্তার দাসত্ব মেনে নিয়ে তবেই আমাদের বেঁচে থাকা। হয়ত আফিসের বস, পরিবারের কেউ বা রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক যে কারোর হোক না কেন আমরা অবশ্যই পরাধীন, কারো না কারো দাসত্ব করছি।

জনগণের ইচ্ছে বা স্বাধীনতার অসারতার বিষয়টি সামনে চলে আসছে কাতালোনিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার প্রশ্নটিকে ঘিরে। সম্প্রতি কাতালান স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এই ঘোষণার পর বার্সেলোনা মেতে ওঠে শ্যাম্পেনের বন্যায়। রাস্তায় নেমে পড়ে হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী জনগণ। স্লোগান উঠে, ‘এই পথঘাট আমাদের। আমাদেরই থাকবে।’

কিন্তু এরপর পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। যে গণভোট কাতালানবাসীর জন্য স্বাধীনতা উদযাপনের স্বপ্ন দেখায়, তা নিভে যায় স্পেনের শাসকদের কঠোর অবস্থানের কারণে। গণতন্ত্রের কাঠামোর মধ্যে গণভোট বিষয়টি যে কত বিপজ্জনক অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে, স্পেন ও কাতালোনিয়ার বর্তমান সংঘাত তা আবার প্রমাণ করল। অনেক সময়ই গণভোট একটি ভয়ানক নৈরাজ্য আহ্বান করে আনে, দেশের গণতান্ত্রিক সংবিধান যা সামলাবার জন্য যথেষ্ট সমর্থ হয় না। উপরন্তু, গণভোটের ফলাফলের মধ্যে ভোটদাতা জনসাধারণের মতামত স্পষ্টই প্রকাশিত হলেও সেই মতের মধ্যে যে গভীর অনুধাবন থাকে, ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রীয় দিশার হদিশ থাকে, এমন বলা যায় না। স্বাধীনতা-অভিলাষী প্রদেশ কাতালোনিয়া বহু কাল ধরেই স্পেন থেকে অব্যাহতি চায়। সেই অভিলাষ মাথায় রেখেই তাদের স্বশাসিত প্রদেশ হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল। তার পর বিচ্ছিন্নতাকামী প্রদেশটি ১ অক্টোবর এক গণভোটের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেয় যে নব্বই শতাংশ কাতালোনিয়াবাসী চান—স্বাধীনতা, আলাদা দেশ।

স্পেন ঘোষণা করে, স্বশাসনের নামে দেশের সংবিধান অগ্রাহ্য করেছে কাতালোনিয়া প্রশাসন, সুতরাং তার স্বায়ত্তশাসন কেড়ে নিতে হবে। আপাতত, এক দিকে, স্পেন সংবিধানের ১৫৫ ধারা প্রয়োগ করে বার্সেলোনাকে মাদ্রিদের সরাসরি অধীনে ফের টেনে আনবার জোর উদ্যোগ নিচ্ছে, আর অন্য দিকে, কাতালোনিয়ার স্বশাসন প্রত্যাহার ও সরকার ভেঙ্গে দেওয়ার লক্ষ্যে স্পেনের পদক্ষেপ আটকাবার জন্য কাতালান স্বাধীনতাকামীরা রাস্তায় নেমে তীব্র বিক্ষোভে শামিল হয়েছেন।

কাতালোনিয়ার স্বাধীনতার দাবি ও স্পেনের সঙ্গে তার দ্বন্দ্বের ইতিহাস বহু পুরাতন। ঐতিহ্যগতভাবে স্পেনীয় রাজারা কাতালোনিয়ার অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ভাবে উন্নত অঞ্চলটিকে উপনিবেশের মতো ‘ব্যবহার’ করতেন। ফ্রাঙ্কোর জমানায় কাতালোনিয়ার নিজস্ব ভাষার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছিল। প্রসঙ্গত, কাতালোনিয়ার দুটি ভাষা, ৭৫ শতাংশ মানুষ কাতালান ভাষা ব্যবহার করেন, যাহা মূল স্পেনীয় ভাষার থেকে আলাদা। স্পেন তো বটেই, ইউরোপের অনেক অংশের তুলনায় কাতালোনিয়ার একটি বহির্মুখী উদার ঐতিহ্য আছে, বহু সংখ্যক বহিরাগতকে সে নিজ কোলে টেনে নিয়ে একটি বিশিষ্ট সমাজ ও সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছে। এই অঞ্চলের অধিবাসীদের পক্ষে তাই ‘কাতালোনিয়া ফর দ্য কাতালানস’ দাবি খুব অসঙ্গত বলা যাবে না।

কিন্তু প্রাদেশিক বিভাগের দাবি আর স্বাধীনতা বা বিচ্ছিন্ন দেশের দাবি তো সমগোত্রীয় নয়। এইখানেই সমস্যার মূল সূত্র। বার্সেলোনার বিদ্রোহ যেহেতু খাস মাদ্রিদের বিরুদ্ধে, সেই অর্থে এটা রাষ্ট্রীয় নীতিতে ‘অন্যায়’! এই পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক গণভোটের ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না, বরং তা নতুনতর ও জটিলতর সমস্যা ডেকে আনতে পারে। খানিকটা এনেছেও। সুতরাং আবেগের দিক দিয়ে স্বায়ত্তশাসন সমর্থনীয় হলেও যে স্বশাসন ‘বিচ্ছিন্নতাবাদের’ সমার্থক, তার রাষ্ট্রগত মীমাংসা মিটিং-মিছিল দিয়ে হয় না। স্পেনের বর্তমান সংকট তাই সহজেই বোধগম্য। ব্রেক্সিট দেখিয়ে দিয়েছে, গণভোট অনেকাংশে আবেগভিত্তিক, যুক্তিভিত্তিক নয়। কাতালান গণভোটও প্রমাণ করছে সব সমাধান গণভোটের রাস্তায় হয় না।

সর্বশেষ খবর হলো, কাতালানিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া কার্লেস পুজদেমনসহ তার চার সহযোগী বেলজিয়ামের পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। কাতালানে এখন এক ধরনের নৈরাজ্য বিরাজ করছে। পুজদেমনসহ ওই নেতারা স্পেন থেকে পালিয়ে বেলজিয়ামে আশ্রয় নিয়েছেন।

মুক্তির ডাক দেওয়া নেতারা এখন পলাতক! স্পেনের প্রশাসনকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়েই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিল কাতালানিয়ার প্রাদেশিক পার্লেমেন্ট। গণভোটের ঠিক ২৭ দিনের মাথায়। কিন্তু মাদ্রিদ এই ঘোষণা মানতে নারাজ। আন্তর্জাতিক মঞ্চেও কাতালানিয়ার এই ‘প্রতীকী জেহাদ’ তেমনভাবে স্বীকৃতি পাচ্ছে না। স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাহয় পুজদেমনকে বরখাস্ত করেন এবং আঞ্চলিক পার্লামেন্ট বিলুপ্ত করেন। কাতালোনিয়ায় কেন্দ্রের শাসন জারি করা হয়। স্পেনের সরকারি কৌঁসুলি পুজদেমনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ ও বিদ্রোহের অভিযোগ আনেন।রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধে স্পেনে ৩০ বছরের সাজা হওয়ার বিধান আছে। এছাড়া ব্রিটেনের মতো বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশও জানিয়েছে, তারা স্পেনের পাশে আছে।

১৭১৪ সালেই যে স্প্যানিশ সাম্রাজ্যের দখলে চলে গিয়েছিল কাতালোনিয়া। বার্সেলোনা দখল করে নিয়েছিল স্প্যানিশ শক্তি। সেই যন্ত্রণা আজও তিলে তিলে দগ্ধ করে কাতালানদের। স্পেন বনাম কাতালানিয়ার রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ তিনশো বছর ধরে চলে আসছে। ‘আমরা’ আর ‘ওরা’—এই শব্দ দু’টো বোধহয় স্প্যানিশ আর কাতালানদের সম্পর্কে খুব ভালো করেই ব্যবহার করা যায়।

কাতালানবাসীর বিজয়োল্লাস এখন থেমে গেছে। শব্দহীন হাহাকার চলছে কাতালান জুড়ে। কাতালানবাসীর ইচ্ছে, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মূল্য স্পেনের শাসকদের কঠোর মনোভাবের কাছে পরাস্ত হতে বসেছে!

কাতালানবাসীর সান্ত্বনা আপাতত একটাই, সেই রুশোর উক্তি: ‘Man is born free, and everywhere he is in chains…!’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)