নেপালের কাঠমান্ডু বিমানবন্দরে ইউএস-বাংলার প্লেন দুর্ঘটনায় প্রকৃত কারণ তদন্তাধীন থাকলেও প্রাথমিকভাবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল (এটিসি) এবং পাইলটদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির কারণেই মূলত বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। তবে নেপালি গণমাধ্যমে প্রকাশিত একটি ভিডিওচিত্র এবং ত্রিভুবন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সূত্র ধরে অনেকে ওই ফ্লাইটের মূল পাইলট আবিদ সুলতানের দায়ও দেখছেন।
দুর্ঘটনার পরপরই নেপালের শিখরনিউজ.কম নামের অনলাইন পোর্টাল একটি ভিডিওচিত্র প্রকাশ করে, যেটি পরবর্তীসময়ে অনেক বড় বড় সংবাদমাধ্যমও প্রকাশ করেছে। সেই ভিডিওতে দেখা যায়, অবতরণের আগেই বিমানটি একটি পাহাড়ের পাদদেশে বিধ্বস্ত হতে হতে বেঁচে যায়। এছাড়া এটিসি দাবি করেছে অবতরণ অ্যাপ্রোচের আগেই প্লেনটি আনস্ট্যাবল ছিল এবং পাইলটের ভুলের কারণেই বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। তাই শিখরনিউজের ওই ভিডিওচিত্র এবং এটিসির দাবির সূত্র ধরে প্লেনটির মূল পাইলট আবিদ সুলতানকে দায়ী করছেন অনেকে।
তবে ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষের অভিযোগ প্লেনটিতে কোন ত্রুটি ছিল না। সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী আসিফ ইমরান নেপালের এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে দায়ী করে বলেছেন: তারা ভুল বার্তা দিয়েছিল। যদিও ত্রিভুবন বিমানবন্দরের মহাব্যবস্থাপক রাজকুমার ছত্রী তাদের কোনো ত্রুটি ছিল না উল্লেখ করে সিএনএনকে বলেন, ‘নেপালের এয়ার ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ থেকে ভুল বার্তা দেওয়া হয়েছিল বলে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ যে বক্তব্য দিয়েছে, আমরা তা প্রত্যাখ্যান করছি। উড়োজাহাজটিকে দক্ষিণ প্রান্ত দিয়ে নামার জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি উত্তর প্রান্ত দিয়ে নামে।’
এ ব্যাপারে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের সাবেক একজন সিনিয়র পাইলট নাম প্রকাশ না করার শর্তে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: যেকোন এক্সিডেন্ট বা ইনসিডেন্ট যাই বলেন না কেন, ৯০-৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে এগুলো মানুষের ভুলেই (হিউম্যান এরর) হয়ে থাকে। বিভিন্ন রকমের ঝামেলা থেকেই এমনটা হয়। কিন্তু সেখানে আসলেই কী ঘটেছে আমরা তো ঠিকমত জানি না এখন পর্যন্ত। সেজন্য আমাদের এখনই এ বিষয়ে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।
একাধিক সংবাদমাধ্যমের দাবি, ওই ফ্লাইটের মূল পাইলট আবিদ সুলতান কাঠমান্ডুতে ফ্লাইট পরিচালনার আগে ওই দিনই আরও দুটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট পরিচালনা করেছিলেন এবং তিনি ইউএস-বাংলা থেকে অব্যাহতি নিতে পদত্যাগপত্রও দিয়েছিলেন। তাই তিনি মানসিকভাবে বিধ্বস্ত ছিলেন এমন আশঙ্কাও করেছেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও এ ধরনের কোন অভিযোগই স্বীকার করেনি ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষ।
তবে সার্বিক বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে সাবেক ওই সিনিয়র পাইলট মনে করেন পাইলটের কোন ভুল থাকলেও থাকতে পারে।
নিজের পরিচালনা করা ফ্লাইটগুলোর অভিজ্ঞতার আলোকে তিনি বলেন: ‘‘তবে যেটা মনে হয়েছে যে, আমরা যেরকম ফ্লাই করেছি আরকি… যদি আমরা কোন অ্যাপ্রোচের চেষ্টা করি এবং সেটা যদি ‘আনকমফোর্ট্যাবল’ হয়, অর্থাৎ ভুমি বা রানওয়ে থেকে ১ হাজার ফিট ওপর থেকে যদি কোন কারণে আমরা ল্যান্ডিং আনকমফোর্ট্যাবল মনে করি, অর্থাৎ আপনি পারবেন কি পারবেন না (অবরতণ), অর্থাৎ যদি স্ট্যাবল না হয় এক হাজার ফিটের মধ্যে, তখনই আমরা ‘ওভার স্যুট’ করে ফেলি, অর্থাৎ অ্যাপ্রোচ ডিসকন্টিনিউ করে ফেলি। তখন প্রসিডিউর মেইনটেন করে একটা জায়গা আছে সেখানে গিয়ে হোল্ড করতে হয়। হোল্ড করার পর আপনি সিদ্ধান্ত নেবেন আপনি আবারও অ্যাপ্রোচ করবেন নাকি ফিরে যাবেন বা বিকল্প কোন এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করবেন।
এখন এক্ষেত্রে (দুর্ঘটনা কবলিত ইউএস-বাংলা প্লেন) যেটা হয়েছে, উড়োজাহাজের অ্যাপ্রোচিং লাইন দেখে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, তারা এসেছে, কিছুটা আনস্ট্যাবল ছিল অ্যাপ্রোচটা, তারপর এসে বাম দিকে চলে গেল প্লেনটা। এখন এটা কি প্লেনের ইঞ্জিনের কোন সমস্যা ছিল নাকি… ইঞ্জিনের কোন সমস্যা থাকলে একটা ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়, তখন অবতরনের ক্ষেত্রে পাইলট স্কিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আমার কাছে পরিষ্কার হলো না, কেনো প্লেনটা বাম দিকে চলে গেল ।
এখন প্রশ্নটা হলো, সাধারণত ০২ তেই (রানওয়ের দক্ষিণ প্রান্ত) অ্যাপ্রোচ করা হয় এবং ২০ এর (রানওয়ের উত্তর প্রান্ত) দিকে অনেক বড় বড় পাহাড়। যখন ভিজ্যুয়াল কন্ডিশন থাকে, যখন মেঘ বা কুয়াশা থাকে না তখন অনেকে ০২ তে অ্যাপ্রোচ করে।’’
তিনি বলেন: ‘‘আমি এখনও জানি না যে সেখানে কী ঘটেছিল। সেটা হয়তো ব্ল্যাকবক্সের রেকর্ড থেকে জানা যাবে। তবে আমার কাছে মনে হয়েছে যে পাইলটের ভুলও থাকতে পারে। সে কেন খামোখা ঘুরতে গেল? তার অ্যাপ্রোচ ভালো লাগেনি সে চলে আসতে পারতো, তাই নয় কি? তাছাড়া কোন টেকনিক্যাল ফল্টের কথাও সে বলেনি, এরকম আরও অনেক কিছু ফ্যাক্ট আছে।’’
ওই ভিডিও চিত্রের ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন: আপনি যদি নির্দিষ্ট রুল ফলো না করে নিচে নেমে আসেন তাহলে বিধ্বস্তের জন্য আপনাকে দায় নিতে হবে। আপনি এটি করতে পারেন না। বিশেষ করে কাঠমান্ডুতে অবতরণের ক্ষেত্রে আপনি কোনভাবেই আপনার নির্ধারিত উচ্চতার চেয়ে নিচে নামতে পারেন না।
ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট বিধ্বস্তের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে নেপালের মন্ত্রিপরিষদ। গত সোমবার সন্ধ্যায় মন্ত্রিপরিষদের এক জরুরি বৈঠকে নেপালের প্রাক্তন সচিব ইয়াগিয়া প্রসাদ গৌতমের তত্ত্বাবধানে ছয় সদস্যের তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে।
তদন্ত কমিটির ছয়জনের মধ্যে রয়েছেন- নেপালের প্রাক্তন সচিব ইয়াগিয়া প্রসাদ গৌতম, লেফটেন্যান্ট কর্নেল ড. রাজিব দেব, ক্যাপ্টেন কে কে শর্মা, সুনিল প্রধান, প্রসাদ সুবেদী ও যুগ্ম-সচিব বুদ্ধ সাগর লমচাঁন।
আলাদা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ইউএস বাংলা কর্তৃপক্ষও।
তদন্ত সংশ্লিষ্টদের বরাত দিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর অনুযায়ী ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের ড্যাস-৮ কিউ ৪০০ এয়ারক্রাফটের ‘যান্ত্রিক ত্রুটির ক্লু’ সামনে রেখে কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি। পাশাপাশি রানওয়ের সংকেত নিয়ে টাওয়ারের সঙ্গে পাইলটের ‘রেডিও টেলিফোনি’র (আরটি) ভুল বোঝাবুঝি, পাইলটের ভুল ‘রিড ব্যাক’, টাওয়ারের ভুল সংশোধন না করা ও ‘ল্যান্ডিং কন্ট্রোল’ কার হাতে ছিল- এসব বিষয়ও গুরুত্বের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে এ কমিটি।
তদন্ত করতে কত সময় লাগবে সে ব্যাপারে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল নাইম হাসান বলেছেন: নেপালে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা তদন্তে দীর্ঘ সময় লেগে যেতে পারে।
তিনি বলেন: ইন্টারন্যাশনাল সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও) নিয়ম অনুযায়ী ৩৬৫ দিনের মধ্যে এ ধরনের তদন্ত শেষ করতে হয়। প্রয়োজনে আরও বেশি সময় নেয়া যেতে পারে।