দরিদ্রমুক্ত বিশ্ব এবং ঋণ সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর গড়ে ওঠে বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফ। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে পশ্চিমা নিয়ন্ত্রিত এ প্রতিষ্ঠানগুলো তৃতীয় বিশ্বের কাছে হয়ে ওঠে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক খবরদারির হাতিয়ার। এমন বাস্তবতায় অর্থনৈতিক এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিজেদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে বিশ্বের উদীয়মান অর্থনীতিক দেশগুলো। সেই প্রচেষ্টারই বাস্তব প্রতিফলন হয়ে ওঠে ব্রিকস প্রতিষ্ঠা।
ব্রিকস নেতৃবৃন্দ ২০১৩ সালে বিশ্ব ব্যাংকের পাল্টা একটি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং প্রস্তাবিত সংরক্ষিত তহবিলকে মিনি আইএমএফ হিসেবে দেখা হচ্ছে।
এর আগে ২০০৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ব্যাংক অব সাউথ প্রতিষ্ঠা করা হয়। আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, প্যারাগুয়ে, উরুগুয়ে, ইকুয়েডর, বলিভিয়া ও ভেনেজুয়েলা ব্যাংকটির সদস্য। ব্রিকসের ভাবনায় এই রাষ্ট্রগুলোকেও ধীরে ধীরে সদস্য করার পরিকল্পনা রয়েছে।
ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং সাউথ আফ্রিকার মতো পাঁচটি উদীয়মান গুরুত্বপূর্ণ দেশের জোট ব্রিকস। এই দেশগুলোর আদ্যক্ষরের সমন্বয়ে নামকরণ করা হয় উদীয়মান জাতীয় অর্থনীতির এই সংস্থার।
২০১০ সালে সাউথ আফ্রিকা অর্ন্তভূক্ত হবার পূর্বে এই সঙ্ঘটি ‘ব্রিক’ নামে পরিচিত ছিল। ব্রিকসে অন্তর্ভুক্ত সকল রাষ্ট্র উন্নয়নশীল অথবা সদ্য শিল্পোন্নত, কিন্তু তাদের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ঘটনাবলীর উপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব। পাঁচটি রাষ্ট্রই জি-২০-এর সদস্য।
২০১৪ সালের হিসেবে, ব্রিক্সের পাঁচ সদস্য রাষ্ট্র প্রায় ৩ বিলিয়ন মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে, যা বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশ। পাঁচটি রাষ্ট্রের সম্মিলিত জিডিপি মার্কিন ডলারের হিসেবে ১৬ দশমিক ০৩৯ ট্রিলিয়ন, যা মোট বিশ্ব পণ্যের প্রায় ২০ শতাংশের সমতূল্য এবং মার্কিন মিলিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের আনুমানিক ৪ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু সদস্যরাষ্ট্রগুলো বলছে, তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধির হার অনুযায়ী বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও নিরাপত্তা পরিষদ নিজ নিজ অবস্থান বদলায়নি।
এই ব্যাংকের প্রাথমিক মূলধন পরিমাণ ছিল পাঁচ হাজার কোটি ডলার। এর সংরক্ষিত তহবিলের পরিমাণ হবে দশ হাজারন কোটি ডলার। এতে সদস্যভুক্ত ৫ দেশের সমান শেয়ার থাকবে। ব্যাংকের জন্য চীন সরকার বেশি অর্থাৎ ৪ হাজার ১শ’ কোটি ডলারের জোগান দেয় এবং ব্রাজিল, রাশিয়া ও ভারত প্রত্যেকে ১৮০০ কোটি করে ডলার এবং সাউথ আফ্রিকা ৫শ’ কোটি ডলার দেয়।
২০০৯ সালে প্রতিষ্ঠার পর দ্রুত বর্ধনশীল চার অর্থনীতির দেশের ২০১০ সালে যুক্ত হয় সাউথ আফ্রিকা। এ পাঁচ দেশই আগামী দিনের বিশ্ব শাসন করবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
প্রতিষ্ঠার পর ২০১৩ হয় ব্রিকস উন্নয়ন ব্যাংক। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব অর্থব্যবস্থায় দীর্ঘদিন থেকে যে এককেন্দ্রিক শাসন চলছে এর অবসান ঘটাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে উন্নয়নশীল বিশ্বের এ ব্যাংক।
ব্রাজিলের ফোর্তালেজা শহরে ব্রিকসভুক্ত দেশগুলোর নেতারা ১০ হাজার কোটি ডলারের উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। সেসময় জানানো হয়, ব্যাংকের পাশাপাশি জরুরি সংকট মোকাবিলায় আইএমএফের বিকল্প হিসেবে ১০ হাজার কোটি ডলারের একটি মুদ্রা তহবিলও থাকবে।
আপাতত এ পাঁচ দেশের মধ্যে সদস্যপদ সীমিত থাকলেও পরে আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও ইন্দোনেশিয়ার মতো উন্নয়নশীল দেশকেও সদস্যপদ দেওয়ার জন্য আলোচনা চলছে।
ব্রিকস দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা মনে করছেন, ব্রিকস গঠনের মাধ্যমে পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর আর্থিক নির্ভরতা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। আর বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বব্যাংক এবং আইএমএফে কাঙ্ক্ষিত হিস্যা না পেয়েই মূলত ব্রিকস দেশগুলো বিকল্প এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।