মরিচের আরেক নাম লঙ্কা। এই লঙ্কা নিয়ে এখন লঙ্কাকাণ্ড চলছে। এই লঙ্কা বা মরিচ আকস্মিকই হিট-নায়িকাদের মতো আলোচিত হয়ে উঠেছে। কারণ এর দাম। দশ-বিশ টাকা কেজির মরিচ এখন ডাবল সেঞ্চুরি পার হয়ে ট্রিপল সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছে। কোথায় গিয়ে যে থামবে-সেটা ঠাহর করা যাচ্ছে না।
বলা হচ্ছে, কয়েক দিনের লাগাতার বৃষ্টি আর বন্যার কারণে মরিচের ক্ষেত নষ্ট হয়েছে। পরিবহনে সমস্যা হচ্ছে। ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আসা বন্ধ হয়েছে। ফলে দামের এই ঊর্ধ্বগতি। হবেও হয়তো। যদিও আমাদের দেশে রাজনৈতিক হানাহানি আর জিনিসপত্রের দাম বাড়ার জন্য কোন কারণ লাগে না।
আমাদের দেশে জীবনের দাম বাড়ে না, সৃজনশীলতা বা স্বপ্নের দাম বাড়ে না, এমনকি মানুষের দামও বাড়ে না, বাড়ে শুধু বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম। এই দাম শুধুই বাড়ে। কারণে বাড়ে, অকারণে বাড়ে। বাড়তেই থাকে।
জিনিসপত্রের দাম বাজেটের আগে বাড়ে, পরেও বাড়ে। ঝড়, বৃষ্টি হলে বাড়ে, না হলেও বাড়ে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম বাড়লেও বাড়ে। ভোটারসহ নির্বাচন, ভোটারবিহীন নির্বাচনে নির্বাচিত সরকারের শাসনামলে বাড়ে, এমনকি অনির্বাচিত সরকারের আমলেও বাড়ে। রমজানের আগে বাড়ে, পরেও বাড়ে। তবে দাম একবার বাড়লে তা আর কমে না। আরো বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দাম কমলেও আমাদের দেশে দাম কমে না। এমনকি দেশে বাম্পার ফলন হলেও খাদ্যশস্যের দাম কমে না।
মানুষের বয়সের মতো, বর্তমান ইউরোপের অভিবাসীর মতো, আমাদের জীবনের সামগ্রিক হতাশার মতো জিনিসপত্রের দাম কেবল বাড়ে, বাড়তেই থাকে। দাম অবশ্য আপনা-আপনি বাড়ে না, বাড়ানো হয়। বলা বাহুল্য, এ দাম বাড়ার ক্ষেত্রে আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, আড়তদার, চাঁদাবাজ, আন্তর্জাতিক বাজার ইত্যাদির ভূমিকা থাকলেও সরকারি নীতির ভূমিকাও উপেক্ষণীয় নয়।
তবে আশার কথা হচ্ছে হচ্ছে এসব নিয়ে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ থাকলেও বড় বেশি ক্ষোভ নেই। এরও অবশ্য কারণ আছে। আমাদের দেশের শাসকরা নানা কৌশলে মানুষের সহ্য শক্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে যদি একটু একটু করে নির্যাতন করা হয়, আঘাত করা হয়, তাহলে এক সময় তা সয়ে যায়। এরপর আঘাতের মাত্রা বাড়ালেও খুব একটা ভাবান্তর হয় না।
আমাদের দেশের মানুষকেও একটু একটু করে আঘাত ও নির্যাতন চালিয়ে সর্বংসহা বানিয়ে ফেলা হয়েছে। এখন মানুষ ভীষণ অসন্তুষ্ট হলেও খুব একটা বিক্ষুব্ধ হয় না। মানুষের মধ্যে এখন মান-অপমান বোধ নেই, নেই যন্ত্রণা বা কষ্ট। কাউকে জুতাপেটা করলেও এ বিষয়ে সে শোক বা অনুতাপ করে না। বরং সেই জুতাটা রেক্সিন, না লেদারের- সে বিষয়ে তৃতীয় কারও সঙ্গে আলোচনা করে।
তবে যতো যাই বলি না কেন, মরিচ জিনিসটা কিন্তু বড়ই খাসা! রান্নায় দিলেই স্বাদের আগুন। স্বাস্থ্য বাঁচায়, শরীর ব্যথাও কমায়। ঝাল বলে ভয়? তা কয়জন করে?
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে যখন সূর্য অস্ত যেত না, সাহেবরা তখনও একটা জিনিসকে যমের মতো ভয় পেতেন। এই মরিচ। অথচ তাঁরাই মরিচকে গ্লোব-ট্রটার বানিয়েছিলেন। মুখে দিলে জ্বলে যায়, বাপ রে কী সৃষ্টি, এই ফলটির আদিভূমি, যত দূর জানা যায়, দক্ষিণ আমেরিকা। অন্তত দশ হাজার বছর আগেই তার ব্যবহার ছিলো সেখানে। তার পর মরিচের কায়কারবার ঘটে পনেরো শতকে কলম্বাস ও সহশিল্পীবৃন্দের মাধ্যমে। পর্তুগিজ বণিকরাই মরিচ নিয়ে গেলেন নানা দেশে।
বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পশ্চিম ভারতের উপকূলে কেন রান্নাবান্নায় মরিচের এমন দাপট, বুঝতে কোনও অসুবিধে নেই। ইউরোপ আমেরিকা অস্ট্রেলিয়া বাদ দিয়ে বাকি দুনিয়াতেই মরিচের প্রতিপত্তি, তবে এশিয়ার দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল হল তার হেডকোয়ার্টার্স।
বলে রাখা ভালো, খুব ঝাল মরিচও সকলের ঝাল লাগে না। যেমন পাখির। ওরা তাই দিব্যি মরিচ খেয়ে ফেলে, সেই মরিচের বীজ ওদের মলের সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে অন্যত্র।
অনেক মানুষ আছেন, পাখির কাছাকাছি, আপনি যখন নাকের জলে চোখের জলে অস্থির, তখন তিনি আপনার পাশে বসে দিব্যি তারিয়ে তারিয়ে ওই একই পদটি খাচ্ছেন আর বলছেন, ‘কই, তেমন ঝাল হয়নি তো !’ আবার, সব মরিচ নয় সমান।
ওলসিদ্ধতে একটা আস্ত কাঁচামরিচ চেপেচুপে মুখে তুলে কত বার দেখেছেন, এ হে হে, ঝাল বলে কিছুই নেই! তবে বগুড়া কিংবা পাহাড়ি এলাকার মরিচ নিয়ে কোনও পরীক্ষা না চালানোই ভালো। এসব মরিচ থেকে আপনি দূরে থাকুন, নিরাপদে থাকুন। বেশি ঝাল লাগলে বরং এই ভেবে শান্তি পান যে, মরিচেও চিনি আছে। খাদ্যগবেষকদের মতে, প্রতি একশো গ্রাম মরিচে থাকে প্রায় পাঁচ গ্রাম শর্করা ! মেলাবেন তিনি, মেলাবেন!
যাঁরা ঝাল খান না, তাঁরা বলেন, মরিচ খেলে শরীর খারাপ হয়। মরিচ খুব বেশি খাওয়া নিশ্চয়ই ঠিক নয়, বিশেষ করে শুকনো মরিচ, তবে সে তো কোনও জিনিসই বেশি খাওয়া ভাল না। কিন্তু, নানা রকম মশলার মতোই, মরিচ কেবল স্বাদ বাড়ায় না, পুষ্টিও দেয়।
কী আছে মরিচ? আছে ভিটামিন ‘এ’, বি-সিক্স, ‘সি’, আছে আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম। ভিটামিন ‘এ’ আমাদের দৃষ্টিশক্তি, মজবুত দাঁত ও শক্ত হাড়ের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। ভিটামিন ‘সি’ অ্যান্টি-অক্সিড্যান্ট হিসেবে কাজ করে, শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, যে কোনও ক্ষত নিরাময়ে সাহায্য করে। আছে অল্প প্রোটিন, বেশ কিছুটা কার্বোহাইড্রেট। আর এনার্জি? হ্যাঁ, তা-ও।
ভুল করে লঙ্কা চিবিয়ে ফেললে যে রকম আ-আলজিভ ঝনঝন করে ওঠে, সে রকম এনার্জির কথা বলছি না, মরিচ থেকে সত্যিই অনেকটা ক্যালরি সংগ্রহ করে নিতে পারেন। এনার্জি ড্রিঙ্ক-এর থেকে কোনও অংশে কম উপকারী নয় এ জিনিস। যাঁরা ডায়েট করছেন, তাঁরা কিন্তু একটু সাবধান। বেশি খেলে ফ্যাট বেড়ে যেতে পারে!
ওষুধ হিসেবেও মরিচের গুণ কম নয়। ব্যথার ওষুধে, বিশেষ করে নানা ধরনের বাত এবং নার্ভের ব্যথা কমানোর ওষুধে মরিচ ব্যবহার করা হায়। এ ছাড়া আছে মরিচের অ্যান্টি-ব্যাকটিরিয়াল, অ্যান্টি-ডায়াবিটিক গুণও। উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবিটিসের বিভিন্ন ওষুধে মরিচ মিশ্রিত থাকে। হজমের সহায়ক এনজাইমগুলোয় একটি নির্দিষ্ট পরিমাণে মরিচ ব্যবহার করা হয়। ভিটামিন ‘বি-কমপ্লেক্স’ সিরাপে নির্দিষ্ট পরিমাণ মরিচ মিশ্রিত থাকে। ত্বকে কোলাজেনে রক্ত সঞ্চালন ঠিক রাখতে মরিচ খুবই উপকারী।
বিজ্ঞানের সীমানা পার হলেই বিশ্বাসের দুনিয়া। দক্ষিণ ভারতের মানুষ ভাবেন, বেশি ঝাল খেলে বুদ্ধি বাড়ে। বাঙালির যেমন মাছের মুড়ো খেলে বাড়ে।
তবে মরিচের দাম বাড়ানোর পেছনে ‘অন্য উদ্দেশ্য’ আছে। বন্যা, ক্ষেত নষ্ট হওয়া, ভারত থেকে না আসা-এগুলো ভাঁওতা মাত্র। বুঝতে হবে যে, আমাদের দেশের মানুষের মধ্যে যতটুকু তেজ বা ঝাঁঝ, তা মোটামুটি পেঁয়াজ এবং কাঁচামরিচের গুণ। এখন পেঁয়াজ-মরিচের সীমাহীন দামের কারণে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এই দুটি জিনিস খাওয়া বাদ দিতে বাধ্য হচ্ছে। ফলে মানুষের সামগ্রিক তেজ বা বারুদ আরও নিম্নগামী হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। পেঁয়াজ-মরিচের দামের এই অভিশ্বাস্য মূল্যবৃদ্ধির পেছনে শাসক গোষ্ঠীর অনন্তকাল ক্ষমতায় থাকার অভিসন্ধি কাজ করছে নাতো?
আমাদের দেশের মানুষ খাবার বলতে একটু কাঁচা মরিচের ঝালই খায়। এই ঝাঁল খেয়েই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলে, গালি দেয়, তড়পায়। এখন আড়াই-তিনশ টাকা কেজির মরিচ খেতে না পেরে যদি বিএনপির নেতাকর্মীদের মতো ঝিমিয়ে পড়ে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু নেই!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)