চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কাঁচা বেলের মোড়ব্বা এবং কালো পিঁপড়ে

মেঝমনি (মিনু বিল্লাহ) আর মেঝদা (মেওয়া বিল্লাহ) ত্রিপুরা চলে গেল ভোরের আলো ফুটবার আগেই। শাহাদাত ভাই, আলম ভাই, ফতে আলীদের সাথে আগরতলার মেলাঘরে, মা আর চার ভাই ঝিনু মাহমুদ (বম্মা), শাওন, আমি, ভাইয়া রয়ে গেলাম। সেপ্টেম্বরের তিন তারিখ যাব আমরা। মা, আমরা কেউ কাঁদছি না কিন্তু অপার এক বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আমাদের চোখে মুখে। সবার মনে একটা শূন্যতা কাজ করছিল, হয়তো ভেবেছিলাম এ জন্মে তোমরা এবং আমরা যদি বেঁচে থাকি তবে হয়তো বা দেখা হবে- নাও হতে পারে।

সেদিন ওরা চলে যাওয়ার পর ভাইয়ার মনের মাঝেও ঝড় বইছিল। সেই হাত কাটা সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর চেক লুঙ্গি পড়ে খাটে বসে রইল দুপাশে দুই হাত দিয়ে, শরীরের ভার বহন করছে দুই হাতে, ঝাঁকড়া চুলের মাথাটা নিচের দিকে নোয়ানো, চোখ দুটো মেঝের দিকে স্থির। হঠাৎ অলৌকিক মানসিক ক্ষমতার অধিকারী মানুষ মাথার ভেতরে জমানো চিন্তার আবর্জনা দূরে ঠেলে দিয়ে ঝট করে উঠে দাঁড়িয়ে মাত্র মামনি মামনি বলে মা কে ডাকতে লাগলেন। তাঁর ডাকাডাকিতে আমরা সবাই ছুটে গেলাম।

ততক্ষণে ভাইয়া আমাদের বাড়ির পিছনের উঠানে চলে গেছে, বেল গাছের দিকে তাকিয়ে আছে, এই সময়টায় বেল কাঁচা থাকে, তবে কি দেখছে ভাইয়া! বেল গাছের দিকে তাকিয়ে! হঠাৎ মাকে বললেন, “মামনি চিনির শিরা করে দেন, আমি কাঁচা বেলের মোড়ব্বা বানাব।”

মায়ের চোখ মুখ থমথমে, তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন! “কাঁচা বেলের মোড়ব্বা! এখন বানাবা আলতু?” মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ বললেন। কাঁচা বেল পারা হলো। সেটা কাটার জন্য ছুড়ি, দা, বটি নিয়ে নিমগ্ন হয়ে গেল। এত শক্ত খোসা সেই বেল কি আর সহজে কাটে?

বুঝতে পারছিলাম মা এবং আমাদের মন খারাপ করা চেহারাগুলো ভাইয়াকে কষ্ট দিচ্ছিল। তাই বুকের ভাঙন রোধ করার জন্য এই অদ্ভুত কাজে আমাদের ব্যস্ত রাখার চেষ্টা।

অনেক কষ্ট করে ছুরি দিয়ে খোসার ওপর দাগ কেটে বটি দিয়ে দু’ভাগ করা হলো সবগুলোকে। আমাকে বলল, “যা, জলে লবণ মিশিয়ে বড় গামলায় নিয়ে আয়। নইলে কষ উঠবে বেলগুলো কালো হয়ে যাবে।” গুরু আদেশ করেছেন- আমাকে মান্য করতে হবে।

গামলা ভরে লবণ জল এনে দিলাম, এবার শুরু হলো শিল্পীর হাতের নিপুণ খেলা! আমাদের কাউকে ধরতে দিচ্ছে না। পিঁড়ি পেতে পিছনের বারান্দায় বসে সে আপন মনে খেলে চলেছে, ধরতে গেলেই বলছে, “তোরা পারবি না সুন্দর করে ভেতর থেকে বেলটাকে বের করে আনতে, হাতটাত কেটে কেলেঙ্কারি করবি।”

আহা ভাইয়া তোমার শরীরের কোনো জায়গায়ই তো ওরা অক্ষত রাখেনি!আলতাফ মাহমুদ-কাঁচা বেলের মোড়ব্বা এবং কালো পিঁপড়ে

কি সুন্দর করে খোসার ভেতর থেকে বেলের মূল অংশটাকে বের করে আনলো! তারপর গোল গোল চাক চাক করে টুকরো করা হলো। দীর্ঘ সময় অতিক্রান্ত হয়েছে, এর মধ্যে দুপুরও গড়িয়েছে। তবুও তিনি ক্লান্তিহীন, বিরামহীন। সবগুলো কাটা শেষ করে মায়ের পাশে পিঁড়ি নিয়ে বসে পড়ল, মায়ের চিনির শিরা প্রায় ঘন হয়ে এসেছে। আমি কিন্তু আছিই পিতাগুরুর পিছু পিছু হচ্ছেটা কী দেখার জন্য।

“মামনি শিরার মধ্যে দারচিনি, এলাচ আর তেজপাতা দিতে হবে।” দেয়া হলো। এবার কাঁচা বেলগুলো সেদ্ধ করতে হবে। সেটাও হলো। এখন চিনির শিরায় বেলগুলোকে দিয়ে ভালো করে জ্বাল দিতে হবে, যেন মিষ্টিটা বেলের ভেতরে যায়। মা তাই করলেন। ভাইয়ার নির্দেশনা শুনে মনে হচ্ছিল মা কোনোদিন রান্না করেননি! মা কিচ্ছু জানে না! লক্ষ্মী মেয়ের মতো মা ভাইয়ার সব নির্দেশনা পালন করে যাচ্ছেন, কি অপূর্ব দৃশ্য!!!

আমরা কোনদিন কাঁচা বেলের মোড়ব্বা খাইনি, কেউ বানিয়েছে এমনও দেখিনি। তাই বিপুল আগ্রহ ও কৌতুহল নিয়ে চুলার পাড় ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি, দুপুরের রান্না, মোড়ব্বা দু’টো সামলাতে গিয়ে ঘেমেনেয়ে অস্থির, দরদর করে ঘামছেন মা, “মামনি আপনার গরম লাগছে না? এই শিমূল যা ঘর থেকে মামনির হাতপাখাটা নিয়ে আয়।”

আমি দৌড়ে গিয়ে মায়ের ঘর থেকে পাখা এনে দিলাম ভাইয়ার হাতে। সেটা দিয়ে এমন জোরে মাকে বাতাস করতে লাগলেন ভাইয়া যে তাতে চুলার আগুনই প্রায় নিভে যায়। মা যতই বলেন, আলতু বাতাস করতে হবে না আমার গরম লাগছে না, ভাইয়া আরো দিগুণ বেগে বাতাস করে যাচ্ছেন। কি অপূর্ব দৃশ্য!

দুধে আলতা রঙ মায়ের লাল হয়ে গেছে। আচ্ছা ভাইয়া তোমার শরীরে ওরা যখন গরম পানি ঢালত সেই গরমকে তুমি কোন মন্ত্রে, কোন ঐশ্বরিক ক্ষমতায় সহ্য করতে! সেই মন্ত্রটা তো আমাকে শিখিয়ে গেলে না। না শিখিয়ে ভালোই করেছ। আচ্ছা তুমি কি বুঝে গিয়েছিলে যে, সেই মন্ত্রের যথাযোগ্য মর্যাদা এই কুষ্ঠরোগগ্রস্ত জাতি দিতে পারবে না।আলতাফ মাহমুদ-কাঁচা বেলের মোড়ব্বা এবং কালো পিঁপড়ে

ঘন শিরার মাঝে কাঁচা বেলগুলো তার নিজস্ব রঙ হারিয়ে খয়েরিও না হলুদও না কেমন মিষ্টি একটা রঙ ধারণ করেছে। “ঝিনু একটা ডিশ আনো তো, ডিশে ঢেলে ঠাণ্ডা করে ফ্রিজে রাখবো, সবাই মিলে বিকেলে চেখে দেখবো কেমন হয়েছে।” ভাইয়া কিন্তু নামানোর আগেই চেখে দেখে নিয়েছে মিষ্টি ঠিক আছে কিনা, “হ্যাঁ মামনি সব একদম পরিমাণ মতো হয়েছে।” মনে মনে হাসি আমি, যার হাতের রান্না ছাড়া মুখে খাবার রোচে না তাঁকেই বলছে সব ঠিক আছে!

আচ্ছা ভাইয়া, মা আমাদের সবাইকে ছেড়ে তোমাকে এত বেশি ভালবাসত কেন? তোমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর মা সেই ট্রাক আর সাদা টয়োটার পিছন পিছন দৌড়ে রাস্তায় চলে গিয়েছিল, ফিরে এসে বারবার এক কথাই বলছিল, “ওরা আলতুকে ছাড়বে না”, কেন? তবে কি মায়ের মন যা বলে তাই ফলে!

নিজের হাতে একটা একটা করে মোড়ব্বা সাজিয়ে ডিশে রেখে তার উপরে যেটুকু শিরা বাকি ছিল তা ঢেলে দিলো, “এবার ফ্যানের নিচে রেখে দাও ঝিনু ঠাণ্ডা হোক।”

ভাইয়া তোমাকে তো ওরা ফ্যানের সাথে ঝুলিয়ে রাখত ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাথা নিচে পা উপরে, সেই অবস্থায় আসা যাওয়ার পথে সিগারেট নেভাত তোমার শরীরে। দ্রুতগতিতে ফ্যান ছেড়ে দিত, আবার মাঝে মাঝে ওইভাবে রেখেই গরম পানি ঢেলে দিত। আবার কখনো গরম পানি নিচে রেখে পায়ের রশি ঢিলে করে শুধু মাথার তালুটা চুবিয়ে রাখত। সেই তাপের অসহ্য যন্ত্রণা কেমন ভাইয়া? কী করে এই অসীম ধৈর্য সহ্য ক্ষমতা অর্জন করেছিলে!আলতাফ মাহমুদ-কাঁচা বেলের মোড়ব্বা এবং কালো পিঁপড়ে

শুধু একজন মুক্তিযোদ্ধার নাম বললে তোমাকে ছেড়ে দিবে বলেছিল ওরা, কিন্তু তুমি ওদের বিশ্বাস করোনি। আর এখন অনেকেই কি অবলীলায় অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের! তোমাদের মতো শারীরিক যন্ত্রণা সইতে হলে কী করত এই প্রজন্ম?

দুপুরের খাবার দেয়া হয়েছে টেবিলে, মা বললেন, “আমার খেতে ইচ্ছা করছে না। তোমরা খেয়ে নাও।” স্নান শেষ করে ভাইয়া এই কথা শোনা মাত্রই গোঁ ধরে বসলেন, “আপনি না খেলে আমরা কেউ খাব না।” জেদি ভাইয়ার সাথে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। অগত্যা মা খেতে বসলেন। তবে গলা দিয়ে খাবার নামছিল না, খেতে বসে সবার মন খারাপ। আহা মিনু, মেওয়া আর সবাই না জানি কতদূর যেতে পেরেছে, কী দিয়ে কী খাচ্ছে খোদাই জানে।

মা অল্প খেয়েই উঠে গেলেন। আঁকড়ে ধরলেন জায়নামাজ আর কোরান শরিফ, সেদিন ভাইয়া আর বাসা থেকে বের হলেন না, শাওনকে বুকে নিয়ে ঘুমালেন।

আজ ২৯ তারিখ, ভাইয়া একবার বাইরে গেলেন, ফিরে আসলেন যখন তখন বেশ চিন্তিত মনে হলো, হয়তো চিন্তিত হয়তো বা আমার বোঝার ভুলও হতে পারে।‌

আচ্ছা শাওন কি খেয়েছিল ওর বাবার হাতের তৈরি শেষ খাবার? আজ আর স্মরণ করতে পারছি না, কারণ আগামীকাল ভোরে আমাদের জীবনে যে বীভৎস ঘটনা ঘটবে তার জন্য আমরা প্রস্তুত ছিলাম না। এই রাতে যে কি ভয়ংকর ঘটনা ঘটে যাচ্ছে সেটাও জানতাম না। রাতেই পাকিস্তানি আর্মিরা ধরে নিয়ে গেছে আজাদ, রূমী, বদী, বকর, জুয়েল, হাফিজ, আব্দুস সামাদ, চুল্লুভাইসহ আরো অনেককেই।আলতাফ মাহমুদ-কাঁচা বেলের মোড়ব্বা এবং কালো পিঁপড়ে

ভোর বেলা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বাড়ির পিছনের দরজা ভেঙে হুড়মুড় করে ঘরের ভিতর ঢুকে পড়ল পাকিস্তানি আর্মিরা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি সারা বাড়িটা ঘিরে ফেলেছে, ট্রাক ভর্তি আর্মি। মা ভোরের নামাজ পরে কোরান শরিফ পড়ছিলেন মৃদুস্বরে, হঠাৎ দরজা ভাঙার শব্দ এবং আর্মিদের চিৎকারে হতভম্ব হয়ে কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না। তিনি তাঁর বিশ্বাসে হাত রাখলেন, বুকে টেনে নিলেন কোরান শরিফ।

আর্মিরা ভাইয়ার নাম ধরে চিৎকার করছে আর বলছে, “আলতাফ মাহমুদ কৌন হ্যেয়?” ভাইয়ার পরনে সেই চেক লুঙ্গি আর সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি, ঝিনু আপা ভীষণ ভয় পেয়ে ভাইয়াকে পিছন থেকে টেনে ধরেছিল। ভাইয়া ঘুরে শুধু বলেছে, “এত ভয় পাচ্ছো কেন!” এটাই শেষ কথা ঝিনু আপার সাথে।

শোবার ঘরের দরজা খুলেই ভাইয়া স্পষ্ট ভাষায় বলল, “আমিই আলতাফ মাহমুদ।” আর তখনই চারদিক থেকে ঘিরে, বন্দুকের কাঠের অংশ দিয়ে মারতে মারতে সামনের উঠানে নিয়ে গেল। ততক্ষণে বসার ঘর থেকে বের করে নিয়েছে চারভাইসহ আলভী মামাকে দোতলা থেকে, পাশের বাসা থেকে ধরে আনলো আরও চার পাঁচজন।

শাওন হঠাৎ করে ঘুম থেকে উঠে পড়েছে। প্রচণ্ড শব্দ করছিল ওরা, ভয়ে অনবরত বমি করছে শাওন। এই প্রথম খেয়াল করলাম পাকিস্তানি আর্মিদের সাথে আব্দুস সামাদ! সে-ও রাতেই ধরা পড়েছিল, অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে অনেকের নাম বলে দিয়েছে। অন্যান্য বাড়ি শনাক্ত করার সময় তার মুখ ঢাকা ছিল তাই সামাদকে চিনতে পারেনি। আমাদের বাড়িটা ছিল শেষ বাড়ি, ভাইয়াকে সবার শেষে ধরেছিল, তাই এখানে তার মুখ খোলা ছিল। সামাদ আঙ্গুল দিয়ে ভাইয়াকে দেখিয়ে নিশ্চিত করল ইনিই আলতাফ মাহমুদ।আলতাফ মাহমুদ-কাঁচা বেলের মোড়ব্বা এবং কালো পিঁপড়ে

আজ ৩০ আগস্ট ১৯৭১ আমার সাতভাই চম্পার চিরদিনে জন্য হারিয়ে যাওয়ার দিন।

পাকিস্তানি আর্মির দানবীয় অত্যাচারে সামাদ স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল যে আলতাফ মাহমুদের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র রেখে গেছে পরবর্তী আক্রমণের জন্য। যেদিন অস্ত্রগুলো গোপন জায়গায় লুকিয়েছিল সেদিন সামাদ এবং মেঝদাও সাথে ছিল। আর ছিল আমাদের বাড়িওয়ালার ছেলে ইকুমামা, পাশের বাড়ির পিছনের উঠানে লেবু গাছের নিচে মাটির নিচে দুই ট্রাংক অস্ত্র গোলা বারুদে ঠাসা।

সবাইকে লাইন ধরে দাঁড় করিয়েছে, এক্ষুনি গুলি করে মেরে ফেলবে, মা কলেমা পড়ছে, আমি জানালা দিয়ে লুকিয়ে দেখছি। শাওন বমি করেই যাচ্ছে, ঝিনু আপা ওকে নিয়েই ব্যস্ত, এক থেকে সাত গুনল, দশের মধ্যে না বললে গুলি চালাবে। কোনো এক ফাঁকে ভাইয়া বিয়ের আংটিটা খুলে খনুর হাতে দিয়ে বলেছে মাকে দিতে। ভাইয়া ধীরে হাঁটা শুরু করলেন, আর সবাইকে ট্রাকে নিয়ে ভরল মারতে মারতে। সামনের উঠান ঘুরে পিছনের বাড়ির লেবু তলায় গিয়ে দাঁড়ালেন, সামাদ জায়গাটা চিহ্নিত করল।

সেই ভোরে ১৪ বছরের আমি ঝড়ের তাণ্ডবে ৪০ হয়ে গেলাম! ভাইয়ার হাতে কোদাল, মাটি খুঁড়ছে, দেরি হলেই বুটের লাথি কোমরে, বেয়নেটের খোঁচা কপালে, রক্তে ভেসে যাচ্ছে। পাশের বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে সব দেখলাম কী করে সুরের এক অনির্বাণ শিখাকে স্তব্ধ করে দিচ্ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। ট্রাংক দু’টো দড়ি দিয়ে টেনে টেনে উঠালো ভাইয়া একা।

এবার হাত দু’টো সেই দড়ি দিয়েই পিছন দিকে বাঁধল। এবার যাবার পালা, নিয়ে যাচ্ছে ভাইয়াকে আমার চোখের সামনে দিয়ে, রক্তাক্ত মুখ, হঠাৎ আমাকে দেখে দাঁড়ালেন, কয়েক মুহূর্তর জন্য, কী বলতে চেয়েছিলেন ভাইয়া? জানি না, আর কোনদিন জানা হবেও না।

আলতাফ মাহমুদ-কাঁচা বেলের মোড়ব্বা এবং কালো পিঁপড়ে

চলে যাচ্ছে ভাইয়া, পিছনে ফেলে যাচ্ছে প্রিয়তমা স্ত্রী, বুকের মানিক, মমতাময়ী মামনি, কন্যাস্নেহতূল্য শিমূলকে ফেলে। কোন অন্ধকার গহ্বরে আমাদের নিমজ্জিত করে গেলে তুমি জানতেও পারলে না! যাবার আগে ফিরিয়ে দিলে বাদবাকি আর সবার জীবন, তোমার জীবনের অসমাপ্ত আয়ু ধার করে আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে আছি এই দিন দেখবার জন্য। তোমাকে যেভাবে অপমান, নির্যাতন করেছিল সেই একই আগুনে দগ্ধ হচ্ছি আমরা প্রতিনিয়ত।

কাঁচা বেলের মোড়ব্বা সেদিন আমরা সবাই মিলে খেয়েছিলাম, ভীষণ স্বাদু হয়েছিল, বাকিটা মা ফ্রিজে রেখে দিয়েছিলেন, ভাইয়েরা এক তারিখ ছাড়া পেয়েছে, ছাড়া পেয়েছে বাকি সবাই, শুধু তুমি রয়ে গেছ।

মা পাগলের মতো যে যা করতে বলছে তাই করছে, দিনের পর দিন ক্যান্টনমেন্টের গেটে সকাল থেকে সন্ধ্যে দাঁড়িয়ে থেকেছে। কে নাকি বলেছে ভাইয়াকে ক্যান্টনমেন্টে দেখা গেছে। আবার কেউ বলেছে জেল হাসপাতালে আছে। সেখানেও দাঁড়িয়ে থেকেছে। ভাইদের শারীরিক অবস্থা ভালো নেই। নির্যাতনের কারণে হাত দিয়ে খেতেও পারে না, খাইয়ে দিতে হয়।

শাওন স্তব্ধ হয়ে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে, কিন্তু বাবার কথা কাউকে জিজ্ঞেস করছে না! সেই যে চুপ হলো হলোই, আর কোনদিন মুখ খোলেনি। ওই বয়সে ও বুঝে গিয়েছিল ১৯৭১ এ বাবার নাম মুখে আনা নিষিদ্ধ। আজ আর ঝিনু আপার কথা নাইবা বললাম, সোনার বরণ পুতুলটা ছাই বরণ হয়ে গেছে।

কিছুদিন পর কোন এক কারণে ফ্রিজ খুলে নিথর হয়ে গেলাম, সেই কাঁচা বেলের মোড়ব্বার রঙ মলিন হয়ে গেছে, গোল গোল চাকগুলোকে চারপাশ থেকে কালো পিঁপড়েরা ঘিরে ধরেছে।

যেমন করে ভাইয়াকে ঘিরে ধরেছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা –