চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

‘কলমের সঙ্গে সংসারে’ এক ‘প্রণীত জীবন’

সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক স্মরণ

‘জাগো বাহে কোনঠে সবাই’ আসাদুজ্জামান নূরের কণ্ঠে এই কবিতার মধ্য দিয়ে সৈয়দ শামসুল হককে আমার চেনা। একযুগেরও বেশি পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো একটি অনুষ্ঠানে আসাদুজ্জামান নূর সৈয়দ শামসুল হকের এই বিখ্যাত কবিতা আবৃত্তি করেছিলেন। অভিনয়শিল্পী পরে আওয়ামী লীগ সরকারের সংস্কৃতিমন্ত্রী নূরের এটি একটি প্রিয় কবিতাও। এটি শামসুল হকের ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ কাব্যনাট্যের অংশ।

সৈয়দ শামসুল হকের জন্ম বাংলাদেশের সবচেয়ে পিছিয়ে থাকা জনপদের একটি কুড়িগ্রামে, ১৯৩৫ সালে। সেখান থেকে কলকাতা, ঢাকা, ব্রিটেন হয়ে ঢাকায় এক লেখক জীবন তার। বর্ণাঢ্য ও বৈচিত্র একজীবনে তিনি তিনটি বাংলা দেখেছেন। কিশোর বয়স কেটেছে ব্রিটিশ বাংলার সবচেয়ে বিবর্ণ এক উত্তরের জনপদে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ দারুণ দাগ কেটেছিলো কিশোর শামসুল হকের হৃদয়ে। তার জীবনভিত্তিক গদ্যগ্রন্থ ‘প্রণীত জীবনে’ তাই দুর্ভিক্ষের নির্মমতা উঠে আসে মমতার সাথে। ভাত না পেয়ে ভাতের মাড় খাওয়া, বড় ছোটর ব্যবধান ঘুছে যাওয়া, মানুষে মানুষে ভেদাভেদের কদর্য রূপ। সাতচল্লিশে দেশ ভাগের চিত্র একেবারের স্পষ্ট। তখন শিশুকাল অতিক্রম করে বয়ঃসন্ধির কালে যাত্রা তার। হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসক বাবার জীবন, পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গের মানুষের দরদ, সেই অজপাড়াগাঁয়ে মিছিল সব যেনো কলমের পাতায় স্পষ্টভাবে উঠে আসে।

পড়াশুনা করতে এসে ঢাকায় জীবন। ইংরেজি সাহিত্যের শিক্ষার্থী। ভাষা নিয়ে পাকিস্তানীদের একগুয়ে আচরণ, পাকিস্তানীদের বৈষম্যে পূর্ব বাংলার হাহাকার, তার প্রভাবে শিক্ষার্থীদের ভাষার জন্য আত্মহুতি; এমনি এক সময়ে লেখক হয়ে ওঠার সংগ্রাম শুরু করেছিলেন সৈয়দ শামসুল হক। পুরো পাকিস্তান আমলে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী, ক্ষমতাবান রাজনীতিবিদ, ধান্ধাবাজ লেখক যারা পাক বাংলার ঢং প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চালিয়েছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সাহিত্য ফ্রন্টে কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। তখন ছবি আঁকার ক্ষেত্রে একই যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন জয়নুল আবেদিন, সফিউদ্দিন, কামরুল হাসান।

সৈয়দ শামসুল হক তার ‘কলমের সাথে সংসারে’ সংস্কৃতিজন মফিদুল হককে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তখন সমাজের কাছে আমাদের দাবি মেলে ধরবার জন্য তিনটি ক্ষেত্রে কাজ হয়েছে। একটা হলো রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, আরেকটা সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে আর শেষটা রিপ্রেজেন্টেটিভ আর্ট বা ছবি আঁকায়। পুরো পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্র সম্মেলন আন্দোলন থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে নিজ লেখনি ও অংশগ্রহণে সপ্রতীভ ছিলেন সৈয়দ শামসুল হক।

ব্যক্তিজীবনে দারুণ সাহসী সবসময় স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ। এসএসসি পাস করেই হঠাৎ মাথায় ভূত চাপে, চলচিত্র প্রযোজনায় কাজ করবেন। চলে গিয়েছিলেন মুম্বাইয়ে। পরে ফিরে এসে জগন্নাথ কলেজ থেকে এইসএসসি পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন। হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন ইংরেজি বিভাগে পড়লে তার সাহিত্যিক হওয়ার স্বপ্ন মাটি হয়ে যাবে। একাডেমিক পড়াশুনা যে সৃষ্টিশীল সাহিত্য রচনার বিরোধী মনে করে তাই তিনি পড়াশুনার পুরো শেষ না করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোনিবেশ করেন। ১৯৫১ সালের ‘অগত্যা’ ম্যাগাজিনে গল্প লেখা দিয়েই তার লেখালেখি শুরু। ষাট বছর অনবরত লিখেছেন। সৈয়দ শামসুল হকের পূর্বে সবাই গ্রামীণ জীবনকে উপজীব্য করে গল্প-কবিতা লিখতেন। তিনিই প্রথম লেখক যিনি মধ্যবিত্ত বাঙ্গালীর জীবনের আবেগ-অনুভূতি সহজ ছন্দে ও গদ্যে তুলে এনেছেন।

একজন সৈয়দ হক বাংলা সাহিত্যের যে শাখায় হাত দিয়েছেন, সেখানে সোনা ফলেছে। তিনি সেই বিস্ময়কর প্রতিভা, যিনি একই সাথে কবিতা, গল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, চিত্রনাট্য লিখেছেন। তার ‘নূরলদীনের সারাজীবন’ আর ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’ ঢাকার থিয়েটারে আলোড়ন তোলে। এখনো নূরলদীনের চরিত্রে আসাদুজ্জামান নূর তার জীবনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনয় বলে গর্ববোধ করেন। যে কারণে তিনি এখনো প্রায়ই ওই কাব্যনাট্য পাঠ করেন।

লেখালেখির কলাকৌশল নিয়ে তার লেখা ‘মার্জিনে মন্তব্য’ বাংলা সৃজনশীল লেখকদের জন্য বাইবেলের মতো। এই বইয়ের শুরুতে একটি গল্প আছে কবি টিএস ইলিয়টের। ‘ইলিয়টের পরিচিত একজন এক বন্ধু এক তরুণকে নিয়ে এলেন তার সাথে দেখা করানোর জন্য। কবিকে বললেন, তরুণটি কবিতা লেখে, আপনার সাথে দেখা করতে চায়। ইলিয়ট জানতে চাইলেন তরুণটির বয়স কতো। ঐ লোক বললো, ২০ বছর। তখন কবি ইলিয়ট বললেন, ওকে ২০ বছর পরে আবার দেখা করতে বলো। তখন লোকটি জানতে চাইলো, এই ২০ বছর তরুণটি কি করবে? ইলিয়টের দ্রুত উত্তর, কেন কবিতা লিখবে’।

এই বইয়ে সৈয়দ হক লিখেছেন, ‘রাইটিং ইজ এ লাভ লেটার টু টাইম’। লিখতে হলো প্রচুর পড়তে হয়। এই বই নিয়ে সাক্ষাতকারে হকের সহজ স্বীকারোক্তি, লেখালেখি গুরুমুখী বিদ্যা। তবে সেটি টোলের কিংবা বিদ্যালয়ের গুরুমুখী নয়। তোমার পূর্বে যারা লেখালেখি করেছেন তারা। কারো সাথে হয়তো তোমার দেখা হবে। বেশিরভাগই তোমাকে শেখাবে অদেখায় তাদের লেখনির মাধ্যমে। তাদের পাঠের মধ্য দিয়ে নতুন লেখকের সচেতন অচেতন মন লেখালেখি করে যাবে।’

আমি এখন পর্যন্ত বইটি ৪ বার পড়েছি। যতবার পড়ি, ততবার নতুন নতুনভাবে আবিস্কার করি। বইটির শেষ দিকে কথাসাহিত্যিক প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘তেলেনাপোতা আবিস্কার’ গল্পের বিশ্লেষণ আছে। ‘মার্জিনে মন্তব্য’ না পড়লে আমার কখনো জানা হতো না, এ রকম গল্পও বাংলা সাহিত্যে আছে। তার কবিতা, গল্প, উপন্যাস, কাব্যনাট্য, চিত্রনাট্যের নাম দিয়ে লেখাটি অহেতুক দীর্ঘ করলাম না। তবে বাংলার তিন হাজার বছরের ইতিহাস থেকে আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উঠে আসা সেই গল্প কি দারুণ কাব্যময়তায় লিখলেন সৈয়দ হক তার ঐতিহাসিক কবিতা ‘আমার পরিচয়ে’।

‘আমি জন্মেছি বাংলায়
আমি বাংলায় কথা বলি।
আমি বাংলার আলপথ দিয়ে,
হাজার বছর চলি।
চলি পলমিাটি কোমলে আমার চলার চিহ্ন ফেলে।
তেরশত নদী শুধায় আমাকে, কোথা থেকে তুমি এলে?

আমি তো এসেছি চর্যাপদের অক্ষরগুলো থেকে
আমি তো এসেছি সওদাগরের ডিঙির বহর থেকে।
আমি তো এসেছি কৈর্বতের বিদরোহী গ্রাম থেকে
আমি তো এসেছি পালযুগ নামে চিত্রকলার থেকে।
এসেছি বাঙালি পাহাড়পুরের বৌদ্ধবিহার থেকে
এসেছি বাঙালি জোড়বাংলার মন্দির বেদি থেকে।
এসেছি বাঙালি বরেন্দ্রভূমে সোনা মসজিদ থেকে
এসেছি বাঙালি আউল-বাউল মাটির দেউল থেকে।

আমি তো এসেছি সার্বভৌম বারোভূঁইয়ার থেকে
আমি তো এসেছি ‘কমলার দীঘী’ ‘মহুয়ার পালা’ থেকে।
আমি তো এসেছি তিতুমীর আর হাজী শরীয়ত থেকে
আমি তো এসেছি গীতাঞ্জলি ও অগ্নিবীণার থেকে।

এসেছি বাঙালি ক্ষুদিরাম আর র্সূযসেনের থেকে
এসেছি বাঙালি জয়নুল আর অবন ঠাকুর থেকে।
এসেছি বাঙালি রাষ্ট্রভাষার লাল রাজপথ থেকে
এসেছি বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুিজবুর থেকে।

আমি যে এসেছি জয়বাংলার বজ্রকণ্ঠ থেকে
আমি যে এসেছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে।
এসেছি আমার পেছনে হাজার চরণচিহ্ন ফেলে
শুধাও আমাকে ‘এতদূর তুমি কোন প্রেরণায় এলে ?

তবে তুমি বুঝি বাঙালি জাতির ইতিহাস শোনো নাই-
‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।’
একসাথে আছি, একসাথে বাঁিচ, আজো একসাথে থাকবোই
সব বিভেদের রেখা মুছে দিয়ে সাম্যের ছবি আঁকবোই।

পরিচয়ে আমি বাঙালি, আমার আছে ইতিহাস গর্বের-
কখনোই ভয় করি নাকো আমি উদ্যত কোনো খড়গের।
শত্রুর সাথে লড়াই করেছি, স্বপ্নের সাথে বাস;
অস্ত্রের শান দিয়েছি যেমন শস্য করেছি চাষ;
একই হাসিমুখে বাজায়েছি বাঁশি, গলায় পরেছি ফাঁস;
আপোষ করিনি কখনোই আমি- এই হ’লো ইতিহাস।

এই ইতিহাস ভুলে যাবো আজ, আমি কি তেমন সন্তান ?
যখন আমার জনকের নাম শেখ মুজিবুর রহমান;
তারই ইতিহাস প্রেরণায় আমি বাংলায় পথ চলি-
চোখে নীলাকাশ, বুকে বিশ্বাস পায়ে উর্বর পলি।’

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)