চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কলকাতায় বাতিল নোট নিয়ে এক বাংলাদেশীর বিরূপ অভিজ্ঞতা

৯ নভেম্বর সকালে কলকাতা যাব। ৮ নভেম্বর রাতে সব গুছিয়ে ঘুমাতে যাব এমন সময় সহকর্মীর ফোন, ভাই লন্ডন থেকে একজন ফোন দিয়ে জানালেন, কাল থেকে ভারতে ১০০০ ও ৫০০ রুপির নোট বাতিল। আপনার কাছে খুচরা নোট আছে তো? আমার কাছে খুচরা ছিল ৫-৬শ’ মতো। বাকি ভারতীয় ১০০০ রুপির নোট, মার্কিন ডলার, বাংলাদেশী নোট।

৮ নভেম্বর রাতে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট বাতিল ঘোষণা করেন। জাল নোট এবং কালো রুপির বিতরণ রুখতেই এ ব্যবস্থা বলে জানান মোদী। সরকারী ঘোষণায় বলা হয় যাদের হাতে এসব নোট আছে ১০ নভেম্বর থেকে ৩০ ডিসেম্বরের মধ্যে জমা দিলে সমমূল্যের অর্থ ফেরত পাবেন। ৩০ ডিসেম্বরের পর শুধু রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বাতিল হওয়া এসব নোট নিবে। ৯ নভেম্বর স্ত্রী কন্যাসহ কলকাতায় নেতাজী সুভাস চন্দ্র বোস এয়ারপোর্ট থেকে মুকুন্দপুর যেতে প্রি পেইড ট্যাক্সি নিতে গেলাম, কাউন্টারের লোক জানালেন ৩৫০ রুপি। দিলাম ১০০০ রুপির নোট। বললেন, নেহি চালেগা..। আমি বললাম তো ? বলল, শ’কা নোট দিজিয়ে। পকেট কুড়িয়ে ১শ টাকার ৪টা নোট দিলাম। রিসিট নিয়ে ট্যাক্সিতে উঠে মনে হল ভাংতি ৫০ রুপি ফেরত নেয়া হয়নি। যাচ্ছিলাম চিকিৎসা বিষয়ে মুকুন্দপুর এনএইচ রবীন্দ্রনাথ ট্যাগর ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিয়াক সাইন্সে। যেতে যেতে ট্যাক্সি চালক বললেন, মোদিজী কালো টাকা আর জাল নোট থেকে ভারতে রক্ষা করতে ১০০০ আর ৫শ টাকার নোট বাতিল করেছেন। আজ ব্যাংক বন্ধ।

টাকা বদলানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে লেখক
টাকা বদলানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে লেখক

হাসপাতালে ঢুকে কাউন্টারে সিরিয়াল দেয়ার জন্য যখন দাঁড়িয়েছি, হাসপাতালের একজন কর্মী আনন্দবাজার পত্রিকার একটি কাটিং কাউন্টারের সামনে সেঁটে দিচ্ছেন, পাঁচশ-হাজার বাতিল…। কাউন্টারে ফাইল রেডি করার অনুরোধ করলাম পুরনো নোটে, ফ্রন্ট ডেস্কের ভদ্রমহিলা বললেন, চলবে না, বললাম, হাসপাতালে তো নেয়ার কথা শুনেছি, বলল, সরকারি হাসপাতালে। বললাম, তাহলে ক্রেডিটে আমার ফাইলটা তৈরি করে দিন। বলল, এখানে টাকা জমা না হলে কোনো ফাইল আমরা তৈরি করতে পারব না। তখন আমার পকেটে সাকুল্যে ১শ ২০-৩০ রুপি হবে। খরচ করে ফেললে আর কিছুই থাকবে না, সাথে ছোট্ট মেয়েটি ওর যদি কোনো প্রয়োজন হয়! দুপুরে রাতে খাওয়া? থাকা তো পরের ব্যাপার। হাতে থাকা সিম মোবাইলে ভরে দেখি আউট গোয়িং নেই। ইন্টারনেট আছে। ইন্টারনেটে ডাক্তারকে ফোন দিলাম। ডাক্তার বলল পুরনো ফাইল জমা দিন, আমি দেখব।

১টার দিকে ডাক্তারের সাথে দেখা। বলল, কোথায় উঠেছেন? বললাম উঠিনি। খুচরা টাকা আছে ? বললাম, না। বললেন, আমার কাছে ৭০০ রুপি আছে আপনাকে ২শ দিতে পারি। বললাম ধন্যবাদ, লাগলে বলবো। কিছু টেস্ট দিলেন সবগুলো করে আবার দেখা করতে হবে পরে। আমার মতো এমন শত শত চিকিৎসাপ্রার্থী হাসপাতালে, কেউ চলে যাচ্ছে-কেউ কি করবে ভাবছে।

নতুন টাকা
নতুন টাকা

হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটা রেস্ট হাউজে গেলাম, বললাম থাকতে হবে। বলল থাকুন, দুপুরে খাবার সময় রেষ্ট হাউজ থেকে ১০০০ রুপির একটা নোট অনেক অনুরোধে ১টা ৫শ আর ৫টা ১শর নোট নিলাম। পরের দিন দুপুরে বের হই, খোঁজ নিয়ে জানলাম স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া জনপ্রতি ৪ হাজার এর পরিবর্তন করছে। ৩-৪ ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে ৩ পাসপোর্টে ১২ হাজার রুপি নিলাম। এর মধ্যে ৩টা ২ হাজার রুপির নোট। স্থানীয়রা আমার হাতে ২ হাজার রুপির নোট দেখে নেড়ে চেড়ে দেখলেন। নিজেরা বলাবলি করছে, এর মধ্যে চিপস দেয়া আছে, কেউ আর নকল করতে পারবে না। আবার কেউ বলছে কই দেখি চিপস কই, কোথাও কোনো চিপস তো দেখছি না।

নতুন পুরনো নোট মিলিয়ে খাওয়া আর রেস্ট হাউজ ভাড়া দিয়ে মুকুন্দপুরে ৩দিনে হাসপাতালের কাজ শেষ করে কলকাতা শহরে আসি। কিন্তু ততক্ষণে ঐ নোট তো শেষ! এক সহকর্মী রিপন ছিল কলকাতায় ফোনে ও বলল, ভাই টাকা নাই। ও আমার জন্য একটা হোটেল বুকিং দিল যেখানে পুরনো নোট চলে। কিন্তু পুরনো নোট ও তো প্রায় শেষ আমার। কলকাতায় এসে মিশন ১০০ রুপির নোট জোগাড় করা। কিনলাম ৫শ রুপির ২০ হাজার। সেগুলো ব্যাংকের মাধ্যমে পরিবর্তন বা যে সব দোকান পুরনো নোট নেয় সেখানে বিনিময় করা। মুকুন্দপুর থেকে কলকাতা সবখানেই সব ব্যাংক আর পোষ্ট অফিসের সামনে দীর্ঘ লাইনে মানুষ। খাবার হোটেল, দোকানপাট সবখানেই একই কথা খুচরো দিতে হবে। কোনো কিছু কিনতে গেলেই বলে ১শ টাকার নোট আছে তো!

নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে
নায়করাজ রাজ্জাকের সঙ্গে

২ হাজার টাকার নোট নিয়ে আরেক বিপত্তি। অল্প দামের কোনো কিছু কিনতে চাইলে ২০০০ রুপির নোট নেয় না দোকানীরা। এদিকে সোনালী ব্যাংক কলকাতা শাখায় পাসপোর্টে এনডোর্স করা থাকলে ২শ ডলারের সমপরিমাণ ১শ রুপির নোট বদলে দেয় এই খবরে যাই ৮ লেনিন স্মরণীর সোনালী ব্যাংক শাখায়। সব বাংলাদেশী যেন লাইনে দাঁড়িয়েছে। যে সময়ে আমি যাই সে সময়ে লাইনে দাঁড়ালে সারাদিনে বোধ হয় আর রুপি পরিবর্তন করা যেতো না। ভাগ্যিস আমার আগে রিপন গিয়ে দোতলার গেট পার করে ভেতরে প্রবেশ করতে পেরেছিল। ২ পাসপোর্টে ৩শ ডলার পরিবর্তন। বাংলাদেশী যাদের সাথে কথা হয়েছে বেশীরভাগই যে কাজে গেছেন কাজ না করে অপেক্ষাকৃত কম ক্ষতিতে যে যার মতো দেশে ফেরার চেষ্টায় আছেন। কেউ দাঁড়িয়ে আছেন ঢাকার বাস কাউন্টারে, যারা দেশে ফিরছে তাদের কাছ থেকে যদি কিছু খুচরা রুপি পাওয়া যায়! রোববার ১৩ নভেম্বর ছোট-খাট কেনাকাটা, খাওয়া, হোটেল ভাড়া দিয়ে রোববার ঢাকার উদ্দেশ্যে এয়ারপোর্ট আসি। ট্যাক্সি ভাড়া দিয়ে এয়ারপোর্ট পৌঁছে দেখি পকেটে ১শ ২০-৩০ রুপি আছে। এয়ারপোর্ট থেকে এক কাপ কফি নিয়ে পুরোটা শেষ করে ফেললাম!!

অনেকের ছোট ছোট আবদার ছিল কিছু নিয়ে আসার। কিন্তু পকেটে টাকা থাকলেও খুচরোর অভাবে কিছুই কেনা হয়নি। এয়ারপোর্টে বাংলাদেশীদের আলোচনায় জানা যায়, তারা কাজ শেষ না করেই দেশে ফিরছেন। একই ফ্লাইটে ফিরছিলেন নায়ক রাজ রাজ্জাক। আমাকে ডেকে বললেন, কেন এসেছি, কি অবস্থা, এই সব। তিনি জানালেন দিল্লি আজমীর ঘুরে ৮ নভেম্বর কলকাতায় এসেছেন তিনি। নোট জটিলতায় তাকেও ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে অনেক।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)