কলকাতার শিয়ালদহ স্টেশনের কাছেই এক আধুনিক এবং বড় ডেন্টাল হাসপাতালেন নাম ডা. আর আহম্মদ ডেন্টাল কলেজ এন্ড হাসপাতাল, এই হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছেন বাংলার এক পিতৃহীন বালক। পুরা নাম রফিউদ্দীন আহম্মদ।
বাড়ী বাংলাদেশের ঢাকা জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার বর্ধনপাড়া গ্রামে, জন্ম ২ ডিসেম্বর ১৮৯০ সাল। পিতার নাম মৌলভী শফিউদ্দীন মহম্মদ, মা ফায়জুন্নেচ্ছা। এক বোন ও চার ভাই এর মধ্যে সে দ্বিতীয়।
প্রাথমিক পড়াশেনা গ্রামের মাদরাসায়, পরে ঢাকা মাদ্রাসায়, পরের যার নাম হয় কলেজিয়েট স্কুল। এখান থেকেই সে ১৯০৬ সালে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন এনট্রান্স পাশ করেন। এই সময় তার সিঙ্গাপুর ও হংকং যাওয়ার ইচ্ছা জাগে।কিন্তু কীভাবে যাবে? টিকিটের পয়সা তো তার কাছে নেই। এই সময় তার সামনে এক সুযোগ এসে গেল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া শিপিং কোম্পানিতে সে চাকরি পেয়ে উঠলো এস এস দিলওয়ারা জাহাজে, সমুদ্র ভ্রমণ এবং সিঙ্গাপুর ও হংকং দেখে পিরে এলে তার বাবা তাকে পড়াশোনা করতে পাঠিয়ে দিল আলীগড়।
সেখানে সে মোহামেডান এ্যাংলো ওরিয়েন্টাল কলেজে ভর্তি হয়ে আএসসি পাশ করল ১৯০৮ সালে। এখন সেই শিক্ষা প্রতিঠানের নাম আলীগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটি। তার আর আলীগড়ে পড়তে ইচ্ছা করল না। চলে এলো বোম্বাই। তার খুব ইচ্ছা ভাল একজন দাঁতের ডাক্তার হবে। ছোট বেলায় তার মাকে দাঁতের যন্ত্রনায় খুব কষ্ট পেতে দেখেছে।তখন ভারতে কোখাও ডেন্টাল সার্জারী পড়ার সুযোগ ছিল না।সে হতে চায় খুব ভালো একজন দাঁতের ডাক্তার, তাহলে পড়তে যেতে হয় ইংলন্ডে। সে তো অনেক দূর, অনেক খরচ!
সেই সময়ে তার পকেটে রয়েছে মাত্র একশত চল্লিশ টাকা, জাহাজের সর্বনিম্ন ভাড়া সাড়ে তিনশ টাকা।সে ভাবে আর ভাবে। তাকে তো ইংল্যান্ডে যেতেই হবে। সে জাহাজ ঘাটায় ঘোরে আর খোঁজ করে। জাহাজ ছাড়ার আগে অপ্রত্যাশিত ভাবে তার কাছে একটা সুযোগ এলো, তার টিকিট লাগবে না তাকে জাহাজের রসুই ঘরে আলু ছুলতে হবে। সে প্রস্তাব পেয়েই জাহাজে উঠে এলো। কাজ শুরু করে দেখে কাজ মোটেই সহজ নয়,জাহাজের প্যাসেঞ্জার আর বিভিন্ন শ্রেনীর কর্মচারির সংখ্যা অনেক। তার সারা দিন কেটে যায় আলু ছুলতে। আস্তে আস্তে অভ্যস্থ হয়ে গেলে সে সময় পায়, জাহাজের সাধারণ শ্রমিকদের একটা অংশ বাঙালি। নোয়াখালি চট্রগ্রাম অঞ্চলের, তাতের বেশীরভাগ পড়ালেখা জানে না। তাদের সাথে ভাব হয়ে যায়। তাদের হয়ে চিঠি লিখে দেয়। তার ইচ্ছার কথা তারা জেনে গেছে, চিঠি লিখলে খুশি হয়েই সম্মানী দেয়। প্রতিদিনই তার দু’চারটা চিঠি লিখতে হয়। এক্সট্রা ইনকাম মন্দ হয় না। রফিউদ্দীন আশাবাদী হয়ে ওঠে।
এক সময় জাহাজ বন্দরে ভেঁড়ে বর্ধনপাড়া গ্রামের রফিউদ্দীন স্বপ্নের লন্ডনে নামে। মেডিক্যাল কলেজে খোঁজ-খবর করে হতাশ হয়। টিউশন ফি খুব বেশী, জীবন যাত্রার ব্যয়ও খুব বেশী।মেডিক্যালে পড়ে পার্টটাইম কাজ করার সুযোগও খুব কম। এই সময়ে একটা তথ্য জেনে আবার আশান্বিত হয়ে ওঠে। আমেরিকায় নাকি টিউশন ফি বেশ কম।
রফিউদ্দীন আবার ঘোরাঘুরি শুরু করে আমেরিকাগামী জাহাজ-বন্দরে। এখন তার ঝুলিতে রয়েছে চট্রগ্রাম-সিঙ্গপুর-হংকং এবং বোম্বাই-লন্ডন সমুদ্রগামী জাহাজে কাজের অভিজ্ঞতা। তারওপর সে তো শিক্ষিত। আমেরিকাগামী জাহাজে তার চাকরি জুটে যায়।
আমেরিকা পৌঁছে খোঁজ করতে যেয়ে একজন সদাশয় প্রিন্সিপালের সাক্ষাত পান। তিনি সব শুনে খুব আশ্চর্য্য হন এবং রফিউদ্দনের ডেন্টাল পড়ার তীব্র আকাঙ্খা দেখে তার দায়িত্ব নেন। রফিউদ্দীন ভর্তি হয় ইউনিভার্সিটি অব আইওয়া সাইন্স অব ডেনটিসট্রিতে। প্রথম মহাযুদ্ধ অব্যাহত থাকায় তার দেশে ফেরা বিলম্বিত হয়।
দেশে ফিরে এসে তিনি প্রাকটিস শুরু করেন এবং একদম সময় নষ্ট না করে পর বৎসরে ১৯২০ সালে ক্যালকাটা ডেন্টাল কলেজ শুরূ করেন। ১৯২০ থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত ছাত্র সংখ্যা ছিল মাত্র ১১ জন। কলেজেরে সকল ব্যয় নির্বাহ হতো তার মালিকাধীন নিউইয়র্ক সোডা ফাউন্ডেশন ও আইসক্রিম পার্লার থেকে। ১৯২৮ সাল থেকে পূর্ণাঙ্গ ডেন্টাল কলেজ হিসাবে পরিচালিত হতে থাকে।
তিনি ১৯২০ সাল থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ছিলেন এই কলেজের প্রিন্সিপাল। ১৯৪৯ সালে তিনি তার প্রতিষ্ঠিত ক্যালকাটা ডেন্টাল কলেজটিকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে দান করে দেন। এটিই উপমহাদেশের প্রথম ডেন্টাল কলেজ এবং রফিউদ্দীন আহম্মদ সাহেবকে সম্বোধন করা হয় ’ফাদার অব ইন্ডিয়ান ডেনটিস্ট্রি’।
তিনি রাজনীতির সাথেও জড়িত হন। ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬ পর্যন্ত কোলকাতা কর্পোরেশনর নির্বাচিত কাউন্সিলর ছিলেন। ১৯৪২ তেকে ১৯৪৪ পর্যন্ত ছিলেন কলকাতা কর্পোরেশনের অল্ডারম্যান।
১৯৪৭ সালে ইংলন্ডের রয়াল কলেজ অব সার্জন ফেলোশিপ পান। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মন্ত্রিসভার একজন সন্মানিত সদস্য ছিলেন। তিনি ইন্ডিয়ান ডেন্টাল কাউন্সিলের প্রথম নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হন এবং ১৯৫৪ থেরক ১৯৫৮ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
ভারত সরকার তাকে ১৯৬৪ সালে পদ্মভূষণ উপাধিতে সম্মানিত করেন। ডেন্টাল সার্জনদের মধ্যে একমাত্র তিনিই এই সম্মান প্রাপ্ত হয়েছেন।
সংকল্পে অটুট এবং লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতীজ্ঞ এক সফল ও মহৎপ্রাণ মানুষটি ১৯৬৫ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরন করেন। তার মৃত্যুর পর কলেজটির নামকরণ করা হয় ডা: আর আহম্মদ ডেন্টাল কলেজ এন্ড হসপিটাল কলকাতা।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)