প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী ১৯৬১ সালে ঢাকা কলেজের ছাত্র থাকাকালীন ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পড়েন। আব্দুর রাজ্জাক ও শহীদুল হক মুন্সীর মাধ্যমে ফজিলাতুন নেছা মুজিবের সাথে মোদাচ্ছের আলীর পরিচয় পর্ব থেকেই ঘনিষ্ঠতা হয়। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গেলেই নিয়মিত চা-বিস্কুট ও অন্যান্য খাবার দিয়ে আপ্যায়ন করতেন নেতাদের। ছাত্রলীগের প্রত্যেকটি নেতাকর্মীর খোঁজখবর আন্তরিকভাবেই নিতেন, সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে চাইতেন কিন্তু নিজের পরিবারের খারাপ অবস্থার চিত্র কাউকে বুঝতে দিতেন না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জেলা শাখার সভাপতি হওয়ায় মোদাচ্ছের আলীর নিয়মিত যাতায়াত ছিল বাঙালির আন্দোলনের তীর্থস্থান ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। মোদাচ্ছের আলীর বর্ণনামতে পাওয়া যায়, বঙ্গবন্ধু জেলে থাকাকালীন ও ফজিলাতুন নেছা মুজিব স্বামীর হাতে কিছু টাকা তুলে দিতেন। ছাত্রলীগের বেশ কয়েকজন নেতা বিষয়টি বুঝতেন যে ফজিলাতুন নেছা মুজিব নিজের গহনা বিক্রি করে এই টাকা সরবরাহ করতেন। কেবলমাত্র ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা নয় আওয়ামী লীগের অনেক নেতারাই ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিয়েছেন।
মোদাচ্ছের আলীর লেখনির মাধ্যমে আরো জানা যায়, আন্দোলনের সময় রেণুর প্রদত্ত দিক-নির্দেশনা ছিল চুম্বকের ন্যায়। তিনি কখনো কাউকে আদেশ-উপদেশ, সংকেত দিয়ে কিছু বলতেন না; কিন্তু তার বাচনভঙ্গি এবং প্রকাশের ভঙ্গি অস্ফূট ভঙ্গিমায় রাজনৈতিক নির্দেশনাগুলোকে নেতাকর্মীরা পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে পালন করতেন। ফজিলাতুন নেছা মুজিব যে অর্থ সাহায্য প্রদান করতেন সে টাকা হতে দলের লিফলেট, পোস্টার, দেওয়াল লিখন ইত্যাদি করা হত। এই মহিয়সী নারীর নির্দেশনাগুলো দলের প্রত্যেক নেতাকর্মীর কাছে পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে মনে হতো। সবাই নিজ দায়িত্ব মনে করে যথাসময়ে কাজগুলো সম্পন্ন করতেন এই মহিয়সী নারীর অসাধারণ ব্যক্তিত্বে গুণমুগ্ধ হয়ে। শান্ত-শিষ্ট নরম স্বভাবের ফজিলাতুন নেছা বাঙালি জাতির নিকট মহিরুহের ন্যায় আবির্ভূত হয়েছিলেন নিজস্ব মেধা আর দূরদর্শিতার সাপেক্ষে।
রাজনৈতিক কর্মীদের ন্যায় সাংবাদিকদেরকেও গুরুত্ব দিয়ে মূল্যায়ন করতেন ফজিলাতুন নেছা মুজিব। সে সময়টাতে সাংবাদিকদের কলমের শক্তি রাজনীতিবিদদের রাজনীতিটাকে মসৃণ করে তুলেছিল। প্রখ্যাত সাংবাদিক কামরুল হুদার জবানির মাধ্যমে জানা যায়, ১৯৬২ সালের কোন একদিন ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে যাওয়ার পর দেখেন শেখ সাহেব বাসায় নেই। একজন কাজের লোকের মাধ্যমে নাম পরিচয় দিয়ে ভেতরে সংবাদ পাঠানো হলো। ভেতর থেকে ফজিলাতুন নেছা কামরুল সাহেবকে দেখেই বললেন, রোদে তোমার মুখ পুড়ে গেছে, যাও হাতমুখ ধুয়ে এসো। হাত মুখ ধুয়ে আসতে না আসতেই ফজিলাতুন নেছা মুজিব নাস্তা-পানি তৈরি করে বসে ছিলেন কামরুল হুদার জন্য। শরবত খাওয়ার পর কামরুল হুদাকে উদ্দেশ্য করে ফজিলাতুন নেছা মুজিব বললেন, তোমার ভাই আসলে তার সাথে আজ দুটি ভাত খেয়ে যেতে হবে। বঙ্গমাতা নিজ হাতে সন্তানের মতো আদর করে আপ্যায়ন করতেন সাংবাদিকদের।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ যেমন ছাত্রছাত্রীরা ঠিক তেমনি রাজনীতির মাঠে প্রাণ এনে দেন রাজনৈতিক কর্মীরা। ফজিলাতুন নেছা মুজিব রাজনৈতিক কর্মীদের নিজ পরিবারের সদস্যদের মতো আপনজন মনে করতেন। রেণুর মমতাময়ী বন্ধনে রাজনৈতিক কর্মীরা প্রাণের স্পন্দন পেতেন, আন্দোলনের রসদ পেতেন, পেতেন অনুপ্রেরণা। রাজনীতিটাকে শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে এসেছিলেন ফজিলাতুন নেছা। তিনি স্বামীর অবর্তমানে কঠোর হাতে রাজনীতির লাগামটাকে পরিচালনা করতেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজনীতির মাধ্যমেই যদি বাঙালির মুক্তি আসে তাহলে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পাশপাশি মানুষও ব্যক্তিগতভাবে বিবেকবান হয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি তথা সার্বিক উন্নয়নকল্পে কাজ করতে পারবেন।
রাজনৈতিক কর্মীদের প্রতি ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ভাবাবেগ প্রকাশ করেন তার কন্যা শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘আমার মাকে দেখেছি বাবার রাজনৈতিক সাথী হিসেবে এবং বাবার অনুপস্থিতিতে পর্দার আড়াল থেকে অন্য নেতৃবৃন্দের সাথে দলকে নেতৃত্ব দিতে দলীয় নেতৃত্বকে এগিয়ে নিয়ে যেতে।’ স্বামীর অনুপস্থিতিতে ফজিলাতুন নেছা দায়িত্বটাকে আরো আপন মনে করে পরিচালনা করতেন এবং সকলকে দিক নির্দেশনা দিতেন।
ড. আবদুল মান্নান চৌধুরীর ভাষ্যমতে, তখনকার সময়ের আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ছাত্রনেতারা নিজেদের পকেটের পয়সা খরচ করতেন, বৃত্তির টাকা ও নাস্তার টাকা বাঁচিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করে তুলতেন। বিত্তশালীরা চাঁদা দিয়ে দলকে সহায়তা করতো না বরঞ্চ চাঁদা এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতেন। বাঙালির মুক্তি আন্দোলনে সাধারণদের অবদান ছিল চোখে পড়ার মতো যেখানে ধনবানরা ছিলেন ম্রিয়মান। এমনি পরিস্থিতিতে রাজ্জাক সাহেব ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে এসে উপস্থিত হলেন। ইতস্তত হয়ে ফজিলাতুন নেছাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘ভাবী লিফলেট ছাপাতে গোটা পঞ্চাশেক টাকা প্রয়োজন।’ এমতাবস্থায় ফজিলাতুন নেছা মুজিবের কাছে বাজারের খরচের জন্য ৫০ টাকা অবশিষ্ট ছিল এবং পুরো টাকাটাই তিনি রাজ্জাক সাহেবের হাতে তুলে দেন। কর্মী থেকে শুরু করে সেই সময়ের প্রভাবশালী নেতারা আর্থিক বিষয়ে টানাপোড়েনে ফজিলাতুন নেছার দ্বারস্থ হতেন এবং তিনি সাধ্যমতো সাহায্য করার চেষ্টা করতেন এবং কখনো কাউকে খালি হাতে ফেরত পাঠাতেন না।
১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলনের পরে নেতাকর্মীদের ধরপাকড়, অত্যাচার, নির্যাতন ও কারাবরণের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল। এ সময়টায় রাজনৈতিক কাজকর্মের গতি অন্যান্য সময়ের তুলনায় কিছুটা শ্লথ হয়ে পড়ে। নেতাকর্মীরাও সঠিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অভাবে হতাশায় ভুগছিলেন। সে সময়টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সকলেই ফজিলাতুন নেছার সাথে সাক্ষাৎ করে সান্তনার বাণী খুঁজতেন, বেঁচে থাকার প্রয়াস পেতেন। নেতাকর্মীদের সান্তনা দিয়ে ফজিলাতুন নেছা বলতেন, তোমাদের নেতা আসুক সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন কর্মীবান্ধব ছিলেন ফজিলাতুন নেছা, নেতাকর্মীদের তাদের প্রিয় নেতার অভাব কখনো অনুভব করতে দেননি। ফজিলাতুন নেছার মমত্ববোধ ও স্নেহশীলতা ইত্যাদি কতিপয় গুণের কারণেই শেখ মুজিব বাংলার বঙ্গশার্দুল, বঙ্গবন্ধু হতে পেরেছিলেন।
ঢাকা শহর আওয়ামী লীগের সহ সম্পাদক রাশেদ মোশাররফকে বিয়ের পূর্বে (বিয়ের কার্ডও ছাপানো হয়ে গিয়েছিলো) গ্রেপ্তার করে মোনায়েম সরকার। এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতার উদ্বিগ্নতার চিত্র ফুটে উঠেছে তাদের মধ্যকার আলাপচারিতায়। বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যমতে; “রেণু দুঃখ করে বলল, সে তো বিবাহ নিয়াই ব্যস্ত ছিল, তাকে যে কেন ধরে এনেছে! এদের গ্রেপ্তারের কোন তাল নাই। ছোট ছোট দুধের বাচ্চাদের ধরে নিয়ে এসেছে রাস্তা থেকে, রাতভর মা মা করে কাঁদে। একজন মহিলা এক ভদ্রলোকের বাড়িতে কাজ করে। এরই মাধ্যমে সংসার চালায়, বড় গরীব। তার ছয় বৎসরের ছেলেকে নিয়ে সেই বাড়িতে কাজ করতো। গাড়ি থামাইয়া পুলিশ ডাক দেয়, এই ছেলে শোন। ছেলেটি এগিয়ে গেছে, তাকেও গাড়িতে উঠাইয়া নিয়েছে। মহিলাটি চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করেছে। কে কার কথা শোনে! একেবারে জেলে নিয়ে এসেছে। এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে মোনায়েম খান সাহেবের দৌলতে।”
অর্থাৎ ভয়ের সংস্কৃতি শুরু হয়েছিলো যদিও কার্ফিউ জারি করা ছিলো না তবে এমন একটা অস্থির অবস্থার সৃষ্টি করেছিলো যাতে কোনক্রমেই মানুষ ৬ দফা সমর্থন কিংবা কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে না পারে। সংবাদপত্রের মুখ বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সাহসী এবং বিচক্ষণ সাংবাদিকদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় যেন সত্য ঘটনা সংবাদপত্রে ছাপা না হয়। শেখ মুজিব মুক্তি আন্দোলন যেন সহসাই রুদ্ধ হয়ে যায়। এ রকম শত সহস্র ঘটনা ঘটিয়ে পূর্ব বাংলার মানুষকে দমিয়ে রাখতে চেয়েছিলো পশ্চিম পাকিস্তানি লর্ডরা। পূর্ব পাকিস্তানে শাসক নিয়োগ করা হতো আনুগত্যতার ভিত্তিতে যোগ্যতার মাপকাঠিতে নয়। তাই তো বাংলার মুক্তি আন্দোলনকে দমনের জন্য মোনায়ম খানের মতো অথর্বকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিলো।
চলবে…