রাজধানী উত্তরার জসীমউদদীনে একটি বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত অবস্থায় ব্যাংকটির সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার গওহর জাহান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। ওই মৃত্যুর দৃশ্য ব্যাংকের সিসি ক্যামেরায় ধরা পড়ে। পরবর্তীতে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
অফিসগুলোতে কাজের পরিবেশ, কাজের চাপ, চাকরি হারানোর ঝুঁকি, বেতন, চাকরিতে যথেষ্ট সুযোগ সুবিধার অভাব, পারিবারিক নানা বিষয়ে মানসিক চাপ নিয়ে নানা রকম সমস্যার মধ্য দিয়েই চলছে চাকরিজীবীদের প্রতিদিনের জীবন। এর ফলে আমাদের আশেপাশে ঘটে চলা এমন অকাল মৃত্যু প্রায়ই খবরের শিরোনাম হতে দেখা যায়।
এরকম মানসিক ও শারীরিক ছোটখাটো অসুবিধা হলে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিতে কর্পোরেট অফিসগুলোতে আদৌ কোনো প্রস্তুতি থাকে কি না? না থাকলে কী কী ধরণের প্রাথমিক সেবা বা প্রশিক্ষণ দেয়া যায়?
চ্যানেল আই অনলাইনের এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুলাহ শাহরিয়ার বলেন: কর্পোরেট অফিসগুলোতে এ ধরণের ঝুঁকি থেকে কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের মুক্ত রাখতে প্রথমেই প্রতিটি অফিসে অন্তত একজন করে মেডিক্যাল অফিসার থাকা দরকার। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ওষুধ, প্রেশার মাপার যন্ত্র, রক্ত গলাতে সাহায্য করে এমন কিছু বিশেষ ওষুধ অফিসে সার্বক্ষণিক রাখা দরকার। কারণ, রক্তের প্রেশার বাড়ার ফলেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়। অফিসে কেউ অসুস্থ থাকলে তার প্রতি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা উচিৎ।
![](https://i0.wp.com/www.channelionline.com/wp-content/uploads/2024/02/Channeliadds-Reneta-16-04-2024.gif?fit=300%2C250&ssl=1)
ডা. আব্দুলাহ শাহরিয়ার বলেন: প্রতিটি কর্পোরেট অফিসে জরুরি সেবায় একটি অক্সিজেন সিলিন্ডার, শ্বাস কষ্টের জন্য নেবুলাইজার, রক্তচাপ মাপার জন্য একটি স্টেথোস্কোপ রাখা উচিৎ। এগুলোর দাম কিন্তু বেশি না, শুধু সদিচ্ছার ব্যাপার।
তিনি বলেন: আমাদের ইচ্ছা থাকলে কর্পোরেট অফিসে অনেক কিছুই সম্ভব। যার উদাহরণ আমাদের গার্মেন্টসের পরিবেশ। গার্মেন্টস মালিকরা বর্তমানে কর্পোরেট অনেক ভালো অফিসের চেয়ে তাদের কর্মীদের স্বাস্থ্য নিয়ে বেশি সচেতন। কারণ তারা জানে একজন কর্মী মারা গেলে তাদের বায়ার চলে যাবে, ব্যবসা শেষ হয়ে যাবে। তাই আমার কাছে মনে হয়, কর্পোরেট অফিসগুলোর কর্মীদের প্রতি মালিকপক্ষের আরো দায়িত্ববান ও সচেতন হওয়া দরকার।
অফিসে হঠাৎ কেউ হৃদরোগে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক পর্যায়ে সিপিআর দেয়াটা কতটা জরুরি? অফিসগুলোতে সিপিআর নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার বলে আপনি মনে করেন?
চ্যানেল আই অনলাইনের এমন প্রশ্নের জবাবে ডা. আব্দুলাহ শাহরিয়ার বলেন: সিপিআর দেয়ার আগেতো আমাদের আগে বুঝতে হবে রোগীটি আসলেই হৃদরোগে আক্রান্ত কি না? অনেক সময় আমরা চোখ, হার্টের পালস্ দেখেই বলে দেই হৃদরোগ হয়েছে।তবে হ্যাঁ, কারো হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে হৃৎস্পন্দন ও শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হয়ে গেলে কার্ডিও পালমোনারি রিসাসিটেশন (সিপিআর) পদ্ধতিতে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে জীবন বাঁচাতে পারেন যে কেউ। এমনকি ফুসফুসের সমস্যা হলেও এ পদ্ধতি খুব কাজে দেয়। সিপিআর দেয়ার আগে প্রয়োজন কিভাবে দিতে হয় তা আগে শেখা। প্রতিটি কর্পোরেট অফিসগুলোকে সরকারি হাসপাতাল থেকে ট্রেনিং দেয়া গেলে খুবই ভালো হয়।
সরকারি হাসপাতালগুলোর এ ধরণের ট্রেনিং দেয়ার কোনো উদ্যোগ আছে কি না? না থাকলে ভবিষ্যতে এ উদ্যোগ নেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেয়া হবে কি না?
এ বিষয়ে ডা. আব্দুলাহ শাহরিয়ার বলেন: এ ধরনের কোনো উদ্যোগ এখনো নেই। তবে প্রথম দাবিটা কর্পোরেট অফিসগুলো থেকে আসতে হবে। কারণ কর্পোরেট অফিসের কর্মীদের এক সঙ্গে করে ট্রেনিং করানোটা নির্ভর করে ওই অফিসের ওপর। তারা দাবি জানালে অবশ্যই এটা নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত আসবে।
তবে ট্রেনিংয়ের ব্যাপারগুলো নিয়ে ইতোমধ্যে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) তে আলোচনা হয়েছে। তবে কর্পোরেট অফিস থেকে যদি বিএমএ এবং স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে এমন অনেক এনজিও রয়েছে তাদেরকে তাগিদ দেয় তাহলে এটা খুব দ্রুত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
অফিসগুলোতে সচেতনতা বৃদ্ধিতে আমাদের করণীয় কী? এ বিষয়ে প্রচার মাধ্যমগুলো কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে কি না?
এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন: অফিসগুলোতে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য প্রথমেই দরকার হলো প্রত্যকের জন্য স্বাস্থ্য বীমা করা। নিজের প্রতি সচেতন হওয়া। এছাড়া প্রচার মাধ্যমগুলো অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। অফিসের এই বিষয়গুলো নিয়ে বিজ্ঞাপন, নাটক, সচেতনতামূলক তথ্য এগুলো অন্তত প্রতি মাসে একবার করে প্রচার করে মানুষকে সচেতন করা যায়।
সিপিআরের নিয়ম
প্রথমে রোগীকে চিৎ করে শোয়াতে হবে। তারপর রোগীর পালস আছে কি না এবং শ্বাস নিচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। এরপর একটি হাত প্রসারিত করে অন্য হাতের আঙুল দিয়ে লক তৈরি করতে হবে। হাতের তালুর উঁচু অংশটি বুকের পাজরের নিচের অংশে ঠিক মাঝ বরাবর রেখে প্রতি সেকেন্ডে ২ বার করে জোরে চাপ দিতে হবে। তবে, খেয়াল রাখতে হবে দুই হাত যেন ভাজ না হয়। এমন ভাবে চাপ দিতে হবে যেন দেড় থেকে ২ ইঞ্চি দেবে যায়। এভাবে ৩০ বার চাপ দেয়ার পর, রোগীর কপাল এবং থুঁতনিতে হাত দিয়ে মুখটি খুলতে হবে। এরপর মুখ দিয়ে মুখে জোরে জোরে দুইবার শ্বাস দিতে হবে। আবার সেই একই পদ্ধতি অনুসরণ করে ৩০ বার বুকে চাপ দিয়ে ২ বার শ্বাস দিতে হবে। হাসপাতালে নিতে নিতে এই পদ্ধতি একজন ৫ বার অনুসরণ করতে হবে।
অফিসে নেই তাৎক্ষণিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ
অফিসগুলোর কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করে থাকে মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগ। আর বিভিন্ন অফিসে মানব সম্পদ উন্নয়ন বিভাগে কর্মরত প্রায় তিন হাজার পাঁচ শ’র বেশি সদস্য নিয়ে গড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বাংলাদেশ সোসাইটি ফর হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (বিএসএইচআরএম) দক্ষতা উন্নয়নে নানা রকম প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে।
অফিসে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিয়ে কোনো ধরণের প্রশিক্ষণ দেয়া হয় কি না এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিএসএইচআরএম এর অফিস সেক্রেটারি নিগান হোসেন জানান: স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন হিসেবে তারা শুধু কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি নিয়ে কাজ করে থাকেন। তবে অফিসে তাৎক্ষণিক চিকিৎসা সংক্রান্ত তেমন কোনো প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। অগ্নিনির্বাপনের জন্য কিছু কিছু প্রশিক্ষণ তারা দিয়ে থাকেন।
সোমবার দুপুরে অফিসে কর্মরত অবস্থায় প্রাইম ব্যাংক উত্তরা শাখার সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার গওহর জাহান হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। কর্মরত অবস্থায় হৃদরোগে আক্রান্ত হলে সহকর্মীরা তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়েছে।
ওই ভিডিওতে দেখা যায়, গওহর জাহানের ডেস্কে একজন নারী গ্রাহক এসে বসেছেন। গ্রাহকের কাজ করার সময় তিনি একাধিকবার পানি পান করেন। এর মধ্যে পানি পান করতে গিয়ে তিনি টেবিলে ঢলে পড়েন। পরে তাকে ধরতে গেলে নিচে পড়ে যান। সহকর্মীরা তাকে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।