করোনা নিয়ন্ত্রণে অনেক বড় বড় দেশ ব্যর্থ হলেও অনেক ছোট দেশই সফল হয়েছে। ভারতের কেরালা রাজ্য, কিউবা, ভিয়েতনাম, দক্ষিণ কোরিয়ার পাশাপাশি তাইওয়ানও এ ব্যাপারে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তাইওয়ানের আয়তন ৩৬ হাজার বর্গ কিলোমিটার, বাংলাদেশের অর্ধেকের চেয়ে একটু বেশি। আর লোকসংখ্যা আড়াই কোটির মতো। এই ছোট দেশটিতে শুধু ২০১৯ সালেই এসেছিলেন এক কোটির ওপর পর্যটক।
ফেব্রুয়ারির শুরুতেও রাজধানী তাইপে আর চীনের মধ্যে ছিল লক্ষ লক্ষ মানুষের যাতায়াত। সেই হিসেবে এত দিনে দেশটি করোনাভাইরাসে বিধ্বংসী হয়ে ওঠার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি।
১৬ এপ্রিল, যখন সারা পৃথিবীতে ২১ লাখের বেশি লোক সংক্রমিত, মৃত প্রায় ১ লাখ ৩৬ হাজার, তাইওয়ানে সংক্রমিত মোটে ৩৯৫ জন আর মৃত ৬! পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশ তাইওয়ানের প্রশংসায় পঞ্চমুখ, নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় ভারত সরকারকে তাইওয়ানের মডেল অনুসরণ করতে পরামর্শ দিয়েছেন। তাইওয়ানের এই সাফল্যের পেছনে আছে, দেশের প্রতিটি নাগরিকের স্বাস্থ্যের দিকে নজর আর নিখুঁত পরিকল্পনা।
তাইওয়ানের প্রতিটি নাগরিককে দেওয়া হয় জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা কার্ড, যাতে অতি কম খরচে অত্যাধুনিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার সুবিধে পাওয়া যায়। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা অনুযায়ী, তাইপেই শহরের স্বাস্থ্য সূচক পৃথিবীতে এক নম্বর। তা সত্ত্বেও তাইওয়ান কিন্তু ঘরপোড়া গরু। ২০০৩ সালে সার্স কোভ (SARS-CoV, করোনার সমগোত্রীয়) রোগে ৭৩ জন মারা যায়, যাতে মৃত্যুহার ছিল ২১ শতাংশ। তা থেকেই শিক্ষা নিয়ে তাইওয়ান ঢেলে সাজিয়েছিল তার স্বাস্থ্য অবকাঠামো ও কেন্দ্রীয় রোগ নিয়ন্ত্রণ সংস্থা (সিডিসি)।
তাই উহানে করোনা সংক্রমণের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তাইওয়ান সিডিসি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু-কে ৩১ ডিসেম্বর একটি চিঠি লিখে এই অজানা ভাইরাসের ব্যাপারে জানতে চায়। বিশেষ করে এটি মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হয় কি না, সে ব্যাপারে। হু সেই চিঠির প্রাপ্তি স্বীকার করলেও কোনও উত্তর দেয়নি, কারণ তাইওয়ান হু-র সদস্য রাষ্ট্র নয় এবং চীন তাইওয়ানকে আলাদা রাষ্ট্র বলে মনে করে না।
জানুয়ারির প্রথমেই তাইওয়ানের সিডিসি আগের ১৪ দিনে উহান ভ্রমণকারী সমস্ত ব্যক্তি— যাদের জ্বর বা শ্বাসনালীর সংক্রমণের লক্ষণ ছিল এবং কোভিড পজ়িটিভ ধরা পড়ে, তাদের আলাদা করে রেখে পর্যবেক্ষণ শুরু করেছিল। দ্রুততার সঙ্গে সিডিসি সক্রিয় করেছিল সেন্ট্রাল এপিডেমিক কমান্ড সেন্টার (সিইসিসি)। সরকারি সাহায্যে ব্যাপক ভাবে চালু করেছিল মাস্কের উৎপাদন, সামরিক কর্মীদের একত্রিত করে তাদের কাজে লাগাতে শুরু করেছিল।
ফেব্রুয়ারির প্রথমেই সারা দেশব্যাপী মাস্কের রেশনিং শুরু করা হয়, যাতে কেউ তা মজুত না করতে পারে। জাতীয় স্বাস্থ্য বিমা কার্ড, বা এলিয়েন রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট (বহিরাগত কর্মীদের যা দেওয়া হয়) দেখিয়ে সকলেই বিভিন্ন ফার্মেসি থেকে এই মাস্ক কিনে ব্যবহার শুরু করেন। প্রতিটি ফার্মেসিকে জিপিএসের মাধ্যমে সংযুক্ত করা হয় এবং যে কেউ একটি মোবাইল অ্যাপের সাহায্যে, কোথায় কত মাস্ক পাওয়া যাবে, জানতে পারছিলেন।
এই সবই এমন সময়ে, যখন হু কোভিডকে অতিমহামারি হিসাবে ঘোষণাই করেনি। তাইওয়ান এটা করেছিল অত্যন্ত সচেতন ভাবে, নাগরিকদের উদ্বুদ্ধ করে। বিস্ময়কর হচ্ছে, এই কিছু দিন আগে অবধি হু মাস্ক পরাকে, বিশেষ করে জনবহুল জায়গায়, অত্যাবশ্যক বলে ঘোষণা করেনি।
ফেব্রুয়ারি থেকেই তাইওয়ানের প্রতিটি জায়গায় শুরু হয়ে যায় থার্মাল স্ক্যানিং। ২৪ মার্চ থেকে সমস্ত আন্তর্জাতিক বিমান উঠা-নামা বন্ধ করে দেওয়া হয়। কিন্তু বিদেশ থেকে আগত প্রতিটি যাত্রীকে বাধ্যতামূলক স্ব-পৃথকীকরণ (সেলফ কোয়ারেন্টিন) করা হয়। এবং তা করা হয় এক অভূতপূর্ব পদ্ধতিতে।
সিইসিসি এবং সিডিসি ইমিগ্রেশন এবং শুল্ক বিভাগের ডেটাবেসকে জাতীয় স্বাস্থ্য ডেটাবেসের সঙ্গে সংযুক্ত করে ফেলে। বিমানবন্দরে অবতরণের পরেই যাত্রীর মোবাইল ফোনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় একটি সিম কার্ড। অ্যাপের মাধ্যমে সিইসিসি শুরু করে সক্রিয় যোগাযোগের সন্ধান, পৃথককরণ এবং পরীক্ষার। সরকার জরিমানার বিধান চালু করে- কোয়ারেন্টিন ভেঙে বাইরে বেরুলেই এক মিলিয়ন তাইওয়ানিজ় ডলার।
তাইওয়ানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রতি দিন নিয়ম করে সাংবাদিকদের সামনে কোভিডের সমস্ত তথ্য দিয়ে যাচ্ছেন: প্রতিটি রোগীর তথ্য, তার উৎস, সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে। কারণ তাইওয়ান বিশ্বাস করে, তথ্যের স্বচ্ছতাই কোভিডের বিরুদ্ধে লড়ার একমাত্র উপায়।
বাংলাদেশের তুলনায় তাইওয়ান ছোট কিন্তু সমৃদ্ধ দেশ। হয়তো বাংলাদেশের মতো ক্ষুদ্র সামর্থ্য আর বিশাল জনসংখ্যার দেশে এত কিছু সঠিক সময়ে করা সম্ভব নয়। কিন্তু তাইওয়ানের অভিজ্ঞতা দেখায় যে, জনস্বাস্থ্যের ব্যাপারে সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টা হওয়া উচিত নিরন্তর আর তাতেই গড়ে ওঠে সরকারের ওপর নাগরিকের বিশ্বাস।
তাইওয়ানে লকডাউন নেই। এখনও স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটি খোলা। প্রতি দিনের জিনিসপত্র কেনার কোনও আতঙ্ক নেই, স্টোর এবং সুপারমার্কেটগুলোতে দৈনন্দিন জিনিসপত্র পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। সেখানে লকডাউন না থাকলে কি হবে, নিয়ম-কানুন অত্যন্ত কড়া। বাইরে মাস্ক পরে না বেরলেই ১৫ হাজার ডলার জরিমানা। করোনা প্রতিরোধে সম্ভাব্য যা কিছু করার তার সবই তাইওয়ানে হচ্ছে। কিন্তু সবই হচ্ছে খুব নীরবে, কোথাও নিজের প্রশংসা ও আত্মতুষ্টি নেই, নেই হাজার অনুযোগ।
কিন্তু আমাদের দেশে একেবারেই বিপরীত চিত্র। এখানে সরকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সব ব্যবস্থা পাকা, করোনা মোকাবিলায় কোনো কিছুতেই ঘাটতি নেই। সব কিছুই ভালোভাবে হচ্ছে। করোনা পরীক্ষার কিট, পিপিই, হাসপাতাল, বেড, চিকিৎসক, চিকিৎসাকর্মী, ভেন্টিলেটর-কোনো কিছুরই ঘাটতি নেই। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, এখানে কোনো হাসপাতালেই পূর্ণাঙ্গ কিছু নেই। হাসপাতালে নার্স-ডাক্তারের খাবার নেই, পর্যাপ্ত পরীক্ষার কিট, পিপিই নেই। অনেক জায়গায় নকল পিপিই সরবরাহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। এদিকে বেশিরভাগ হাসপাতালে আইসিইউ সুবিধা নেই, ভেন্টিলেটর নেই, প্রয়োজনীয় দক্ষ কর্মী নেই, টেকনিশয়ান নেই। এমনকি শারীরিক দূরত্ব মেনে চলার বা মানানোর বাধ্যবাধকতাও নেই!
এখানে সব কিছুই চলছে ফ্রি-স্টাইলে। কর্তাব্যক্তিদের কথার সঙ্গে কাজের মিল নেই। একের পর এক ডাক্তার-নার্সসহ চিকিৎসাকর্মীরা আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ মারাও যাচ্ছেন। করোনা চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় চলছে চূড়ান্ত অরাজকতা। কোথাও কোনো শৃঙ্খলা নেই। সুষ্ঠু পরিকল্পনা নেই। যে যার মতো কথা বলছে, পথ চলছে। প্রধানমন্ত্রীকে সব ঠিক চলছে বলে বুঝ দিচ্ছে।
দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার ৪০ দিন পরও দেশে প্রতি ১০ লাখ মানুষের মধ্যে গড়ে মাত্র ৮০ জনের কোভিড-১৯ শনাক্তকরণের পরীক্ষা হচ্ছে। অথচ করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা পরীক্ষার ওপর জোর দিয়ে আসছে। সংস্থাটির সর্বশেষ করোনাভাইরাস প্রতিরোধবিষয়ক কৌশলপত্রে বলেছে, এখন পর্যন্ত এ রোগের কোনো টিকা বা সুনির্দিষ্ট ওষুধ নেই। পরীক্ষার মাধ্যমে দ্রুত রোগী শনাক্ত করা এবং তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করা গেলে এই ভাইরাসের দ্রুত সংক্রমণ ঠেকানো সম্ভব হবে। তাই সাধারণ জনগণের মধ্যে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করতে দেশগুলোকে সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
কিন্তু আমরা এখনও সেই সক্ষমতা বাড়াতে পারিনি। পরীক্ষার সংখ্যা বাড়াতে হলে করোনা শনাক্তকরণ কিটের প্রয়োজন হবে। ১১ এপ্রিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বুলেটিনে জানানো হয়, দেশে করোনা শনাক্তকরণ কিটের মজুত রয়েছে ৭১ হাজার। এরপর আর কিটের মজুত কত, তা জানানো হয়নি। কিট কেনার চেষ্টা হচ্ছে কিনা, সস্তায় কিট তৈরির গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের উদ্যোগটি কেন আলোর মুখ দেখছে না, এসব ব্যাপারে কারো মুখে কোনো কথা নেই। এদিকে আক্রান্ত আর মৃত্যুর সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে।
গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, মাঠপর্যায়ে যাঁরা নমুনা সংগ্রহ করছেন, তাঁরা যথেষ্ট প্রশিক্ষিত নন। ফলে পর্যাপ্ত নমুনা পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে সঠিক প্রক্রিয়ায় সংগ্রহ না করায় নমুনা নষ্টও হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে যে পদ্ধতি (পিসিআর) ব্যবহার করে শনাক্তকরণের পরীক্ষা করা হচ্ছে, সেটিও বেশ জটিল। এই পরীক্ষা করার মতো দক্ষ টেকনিশিয়ানেরও সংকট রয়েছে। আবার সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়ে অনেকে নমুনা দিতে চাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারি উদ্যোগ সামগ্রিক হতাশাই কেবল বাড়িয়ে চলেছে।
১৭ কোটি মানুষের এই দেশে ইতিমধ্যে করোনাভাইরাসের স্থানীয়করণ ঘটেছে। প্রতি জেলায় অসংখ্য মানুষ করোনার লক্ষণ নিয়ে বসে আছেন। তাদের পরীক্ষার ব্যবস্থা নেই। গত তিন মাসেও সরকার দেশে হাজার হাজার মানুষের করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে পারেনি। এতে করে শনাক্ত না হওয়া ব্যক্তিরা আরও বেশি মানুষকে সংক্রমিত করছেন।
বর্তমান সরকারের ‘উন্নয়ন’ নামক স্লোগানটা যে কত ফাঁপা, সেটা পরিষ্কার হয়ে গেছে দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণার একদিন পরই। কাজকর্ম বন্ধ হওয়ায় মানুষ খাদ্য-ত্রাণ-সহায়তা পাবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। যে দেশে লাখ লাখ মানুষের একদিনের সঞ্চয় নেই, একদিন কাজ না করলে যাদের অনাহারে থাকতে হয়, সে দেশে আসলে কিসের উন্নয়ন, কার উন্নয়ন হয়েছে? এদিকে আমাদের অর্থমন্ত্রী বিশ্বব্যাংকের উপর গোস্বা হয়েছেন। কারণ বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনার কারণে দেশের জিডিপি তিন শতাংশে নেমে আসতে পারে! এতে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর আঁতে ঘা লেগেছে। তিনি তো এখনও ৭-৮% জিডিপির স্বপ্নে বিভোর!
শহরাঞ্চলের বেকার শ্রমজীবীরা ক্রমেই বেতন, ত্রাণ খাদ্যের দাবিতে ক্রমেই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন। একদিকে ক্ষুধার্ত মানুষের ক্ষেপে উঠা, অন্যদিকে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর হার বৃদ্ধি ভয়াবহ পরিণতিরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সরকার তো পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে শোচনীয় রকম ব্যর্থ, আপাতত ঈশ্বরের কৃপা প্রার্থনা ছাড়া অন্য কোনো ভরসা দেখা যাচ্ছে না!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)