করোনা ভাইরাস মানবজাতির জন্য এক ভয়ঙ্কর ত্রাস হয়ে উঠেছে। তালেবান, আইএস মানুষের মধ্যে যতোটা ভীতি সৃষ্টি করেছিল, এটা তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। উৎসব বা উল্লাসের মতো আতঙ্কও এক ধরনের উত্তেজক (স্টিমুলেন্ট), যা আমাদের বাঁচতে সাহায্য করে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিসরে। উৎসব ও আতঙ্কের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে সমাজ ঝিমিয়ে পড়ে। বস্তুত দীর্ঘদিন কোনো ধরনের উত্তেজনা ছাড়া শান্তিতে থাকলে আমাদের শরীরও ঝিমিয়ে পড়ে এবং ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। মানুষ তাই এই দুয়ের যেকোনোটা পেলেই লুফে নেয়। আপাতত বিশ্বের মানুষ একটি অভিন্ন শত্রু পেয়েছে।
করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বর্তমানে যে বিপজ্জনক অবস্থানে রয়েছে, সেটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে, এর পরিণতি কী হবে, এ মুহূর্তে সেটাই সবার উদ্বেগের কারণ। মহামারি বিস্তারের অন্তর্নিহিত পদ্ধতি নিয়ে বেশ কিছু গাণিতিক মডেল রয়েছে। সুস্থ মানুষের সংক্রমিত হওয়ার, পুনরায় সুস্থ হওয়ার, কিংবা মারা যাওয়ার হারের সাংখ্যমান এ সব ক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ‘বেসিক রিপ্রোডাকশন নাম্বার’ (বিআরএন) অর্থাৎ এক জন আক্রান্ত গড়ে সংক্রমিত করে কত জনকে, সেটা মহামারি ছড়াবার একটা গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশক। ‘বিআরএন’ যত বেশি হবে, মহামারি ছড়াবে তত দ্রুত। আক্রান্তদের বিচ্ছিন্ন করে রাখার মূল উদ্দেশ্য এই ‘বিআরএন’-কে কমানো।
এক শতাব্দী আগে হয়েছে মানব-ইতিহাসে ফ্লু ভাইরাসের ভয়ঙ্করতম মহামারি। ১৯১৮ সালের ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। পৃথিবীর জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ আক্রান্ত হয় সেই ফ্লু-তে, মারা যায় ৫ কোটি লোক। দুই মহাযুদ্ধে যত লোক মারা গিয়েছে, তার চেয়েও বেশি। স্প্যানিশ ফ্লু-র ‘বিআরএন’ ছিল ২-৩, আর করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রে এখনও তা ২.২-৩.৯। স্প্যানিশ ফ্লু-এর মৃত্যুহারও (২.৫%) কিন্তু করোনায় এখন মৃত্যুহার প্রায় ১০%। তবে কি করোনাভাইরাসের প্রকোপে ধ্বংসের ছবিটা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাবে? এখনও এ ব্যাপারে স্পষ্ট করে কিছু বলা যাচ্ছে না। কারণ সংক্রমণের হার এবং মৃত্যুর মিছিল প্রতিদিনই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে।
গত দু’দশকেই দুনিয়া দেখেছে অনেকগুলি মহামারি। ২০১৪-র মার্স-এর ‘বিআরএন’ অনেক কম (০.৩-০.৮) হলেও, অন্য অনেক ক্ষেত্রেই ‘বিআরএন’-এর মান ছিল বেশ চড়া। ২০০২-০৩-এর সার্স মহামারির ‘বিআরএন’ ছিল ২-৪, ২০০৯-এর সোয়াইন ফ্লু-র ক্ষেত্রে তা ১.৩৩, ২০১৩-১৬’র ইবোলা-র ক্ষেত্রে ১.৫-২.৫, আর ২০১৮-র নিপা-র ‘বিআরএন’ ৪.৭। তাই করোনার সংক্রমণ-হার বাঁধন-ছাড়া নিশ্চয়ই নয়। আবার ‘আক্রান্তের মৃত্যুহার’ সোয়াইন ফ্লু-র ক্ষেত্রে বেশ কম (০.০১%-০.০৩%) থাকলেও, বেশির ভাগ সাম্প্রতিক মহামারির মৃত্যুহার ছিল অনেকটাই বেশি। সার্সে মৃত্যুহার ১০%, মার্সে তা ৩৯%, ইবোলায় ৫০%, নিপায় ৫০%-৭৫%। বিশ্বজুড়ে সার্সে আক্রান্ত হয়েছিল ৮,০৯৮ জন, মৃত্যু হয় ৭৭৪ জনের; সোয়াইন ফ্লুতে আক্রান্ত হয় দুনিয়ার ১১%-২১%, মৃত্যু হয় পৌনে ছয় লক্ষ মানুষের; আর ইবোলায় ২৮ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয়ে মারা যায় ১১ হাজারের বেশি। এই তুলনামূলক চালচিত্র থেকে করোনা ভাইরাস মহামারির সম্ভাব্য প্রভাব ও ফল সাম্প্রতিক অন্য মহামারিগুলোর থেকে অন্তত বেশি হবে বলে মনে হয় না।
তবু এক নজিরবিহীন আতঙ্কের করাল গ্রাসে আটকে পড়েছে বিশ্বজনতা। সেই সঙ্গে মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজারের আকাল দেখা দিয়েছে দেশে দেশে। কম পড়েছে মেডিক্যাল স্টাফ, কোয়ারেন্টাইন করার জায়গা। আমেরিকার মতো দেশে পর্যন্ত টেস্ট কিট অপ্রতুল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশই বিদেশ থেকে আসা লোকদের মেডিক্যাল পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই তা সার্বিকভাবে প্রয়োগ করতে গিয়ে দেরি করে ফেলেছে বেশ খানিক। তার মধ্যেই হয়ে গিয়েছে অনেকখানি সংক্রমণ। এই সঙ্কটকালে বিভিন্ন উন্নত দেশকেও মনে হয়েছে অপ্রস্তুত, হতভম্ব। ব্যতিক্রমও আছে, সিঙ্গাপুর। সার্সে ৩৩ জন মারা গিয়েছিল সে দেশে, সোয়াইন ফ্লু-তে আক্রান্ত হয়েছিল ৪ লক্ষ। এ বার কিন্তু কড়া পদক্ষেপ নিয়ে আক্রান্তের সংখ্যাটাকে এখনও পর্যন্ত দু’শোর নীচে রাখতে পেরেছে তারা।
করোনা ভাইরাস চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল, আমরা কী ভয়ানক রকমের অপ্রস্তুত এমন হঠাৎ অনিবার্য পরিস্থিতির সামনে। করোনা ভাইরাস কতটা ক্ষতি করবে, তা বলা এখনও কঠিন। বাংলাদেশের জিডিপিও নাকি এর ফলে কমে যাবে ১%।
করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে সরকারের দায়িত্বহীনতা ও এক শ্রেণির মানুষের কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ। গত এক মাসে কতজন করোনা ভাইরাস সংক্রমিত দেশগুলো থেকে বাংলাদেশে এসেছে, তাদের কতজন ওই ভাইরাস বহন করে এনেছে বা এখনও বহন করছে, তাদের স্বজন-বান্ধবরা ইতিমধ্যে কতজনকে সংক্রমিত করেছে, সেটা আমরা জানি না। কারণ সম্ভাব্য যারা ভাইরাস বহন করতে পারে, তাদের হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকার কথা থাকলেও তারা মনের আনন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি, তাদের আত্মীয়-স্বজন-বন্ধুবান্ধবরা বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছেন না এবং প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করছেন না। অনেক ব্যক্তিই অকল্পনীয় ও অমার্জনীয় দায়িত্ববোধহীনতার পরিচয় দিয়েছেন। এই দায়িত্বহীনতা এক বিপুল বিপদের সঙ্কেত বহন করছে।
কোভিড-১৯’এর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রামে প্রশাসনের দায়িত্ব প্রচুর। চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদেরও। কিন্তু এই দুর্বিপাক রোধ করতে তাদের প্রাণপাত চেষ্টাও বিফল হতে পারে, যদি না নাগরিকেরা নিজেদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করে।
দুর্ভাগ্য, আমাদের দেশের নাগরিকদের মধ্যে সেই সচেতনতার অভাব প্রকট। এমনকি বিপর্যয়ের এই চরমলগ্নেও। প্রতি দিনই সংবাদ আসছে, কেউ কোয়ারেন্টাইন এড়িয়ে পালিয়ে যাচ্ছে, সংক্রমিত অবস্থায় কেউ গণপরিবহণ ব্যবহার করেছে, কেউ আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষাতেই নারাজ। যারা এমন দায়িত্বজ্ঞানহীনতার প্রমাণ দিচ্ছে, তাদের বেশির ভাগই প্রথাগত অর্থে উচ্চশিক্ষিত, অনেকেই সমাজের উঁচুতলার বাসিন্দা। তাদের শুধু এই বোধটুকু নেই যে সংক্রমিত অবস্থায় তারা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানে, তবে আরও অজস্র মানুষকে তারা বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এটা শুধু স্বার্থপরতা নয়, নিতান্ত কাণ্ডজ্ঞানহীন আচরণ। চরম স্বার্থপর মানুষও জানে যে, স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর আয়তন সীমিত, একটি নির্দিষ্ট সীমার অধিক চাপ বহনে সেই পরিকাঠামো অক্ষম। নিজে সংক্রমিত অবস্থায় অনেকের সংস্পর্শে এলে তাদের সংক্রমণের সম্ভাবনাও বাড়বে, সীমিত স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর উপর চাপ বাড়বে। ফলে, ওই স্বার্থপর মানুষের নিজের যথাযথ স্বাস্থ্য পরিষেবা পাবার সম্ভাবনা কমবে। অতএব সংক্রমিত হলে স্বার্থবোধসর্বস্ব মানুষেরও চেষ্টা করা উচিত, যাতে অন্যদের মধ্যে সংক্রমণ না ছড়ায়।
স্বার্থবোধের ধারণাটি প্রকৃতপক্ষে সামাজিক মূল্যবোধ ও অভ্যাস থেকেই জন্মায় এবং তার দ্বারাই লালিত হয়। সঙ্কীর্ণ স্বার্থ থেকে বৃহত্তর স্বার্থে উত্তরণের জন্য যথাযথ সামাজিক আদর্শ ও নীতিবোধের অনুশীলন দরকার। দুর্ভাগ্যের কথা, আমাদের দেশে সেই অনুশীলনের লেশ মাত্র নেই। রাষ্ট্র যারা পরিচালনা করেন, তারাও নিজেদের যোগ্যতার প্রমাণ দিতে পারেন না। তাদের উদাসীনতা, উপেক্ষা, সত্যকে গোপন করার অভ্যাস, আত্মপ্রশংসা, আত্মতুষ্টি, অদূরদর্শিতা প্রবাদতুল্য। তারা আনুগত্য ছাড়া নাগরিকদের তেমন কিছুই শেখাননা। ফলে এদেশের নাগরিকরাও সরকারের প্রতি দায়বদ্ধ নয়। বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়েও নাগরিক জানে না তার কর্তব্য কী। তারা এইটুকুও বোঝে না যে এই কঠিন সময়ে প্রতিটি নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলতেই হবে। কোয়ারেন্টাইনে থাকতে যদি অসুবিধা হয়, তা মেনে নেয়াই একমাত্র কাজ। নাগরিকের মধ্যে এই প্রাথমিক দায়িত্ববোধটুকু গড়ে না উঠাটা রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের চরম ব্যর্থতা। আজ না হোক পরশুর পরের দিন করোনা ভাইরাসের প্রকোপ হয়তো কমবে। কিন্তু নাগরিকের দায়িত্ববোধ জাগ্রত হবে, সেই আশা ক্ষীণতর।
আমাদের জন্য করোনা ভাইরাস এক ভয়াবহ দুর্যোগ বয়ে আনতে পারে। এ ব্যাপারে এখনই সরকারকে গভীরভাবে ভাবতে হবে। দেশে একে একে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শ্রমজীবী মানুষের রুটি-রুজিতে ইতিমধ্যেই টান-পড়েছে। বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশি নাগরিক একবুক আতঙ্ক নিয়ে বিদেশের মাটিতে কাটাচ্ছে প্রত্যেকটা মুহূর্ত। কিন্তু সেটা আর কতদিন, জানেন না কেউ। জিনিসপত্র বাজার থেকে উধাও হয়ে যাচ্ছে। লাফিয়ে বাড়ছে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। শাট ডাউনের ভয়ে বাজার, সুপার মার্কেটের র্যাকগুলো শূন্য। যে যেমন পারছে চাল, ডাল, কাঁচা বাজার জমা করছে ঘরে। পুরোপুরি শাট ডাউন হলে খাবারও যে জুটবে না! তাই সাবধানের মার নেই।
ব্যক্তি থেকে সমষ্টি, আর তারপর বাজার অর্থনীতিতে ধস। ‘করোনা মহামারিতে’ এটাই এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আতঙ্ক-যা চোরাস্রোতের মতো প্রত্যেকটা দেশের অস্থি-মজ্জায় ছড়িয়ে যাচ্ছে। উৎপাদন নেই, পণ্যের চাহিদা নেই, সরবরাহ নেই। বাজারের মুখ থুবড়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। সেটাই হচ্ছে। আর এই মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ানোর কোনও দিশা নেই। প্রতিষেধক কিন্তু এখনও নাগালের অনেক দূর!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)