দেশের সিনেমার অবস্থা এমনিতেই নিভু নিভু করছে। তারমধ্যে মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে মহামারি করোনা! বাধ্য হয়েই ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ রাখা হয়েছে দেশের সব সিনেমা হল। কিন্তু হল বন্ধের বিষয়টি দীর্ঘ মেয়াদি হওয়ায় বিপাকে পড়েছে ঢাকা ও ঢাকার বাইরের হলগুলোতে নিয়োজিত হাজারো কর্মচারী! ভালো নেই তারা।
সিনেমা হলগুলো চালু থাকলে তবু কিছু উপড়ি রোজগার সম্ভব হয়, কিন্তু করোনার কারণে মাস খানেকের বেশি সময় ধরে সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে পথটিও বন্ধ তাদের। তারউপর হল বন্ধের কারণে বেশিরভাগ কর্মচারির মাসিক বেতনও আটকে গেছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের বেশ কয়েকটি প্রসিদ্ধ সিনেমা হলের কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
বেতন আটকে যাওয়ায় পরিবার নিয়ে সীমাহীন কষ্টে দিন পার করছেন রাজধানীর আনন্দ সিনেমা হলের কর্মচারীরা। পরিস্থিতি এমন ভয়াবহতায় রূপ নিয়েছে যে, এক কর্মচারী উপায় না পেয়ে আত্মহননেরও চেষ্টাও করেছিলেন!
আনন্দ সিনেমা হলের ম্যানেজার শামসুদ্দিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, আনন্দ ও ছন্দ সিনেমা হল মিলিয়ে ৩৫ জন কর্মচারী শ্রমিকের বেতন গত ফেব্রুয়ারি মাস থেকে বাকি। করোনা প্রার্দুভাবে হল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দিতে পারিনি। এরমধ্যে একজন কর্মচারী আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন! আরেকজন পয়সায় অভাবে কিডনি বিক্রির চেষ্টা করে। বিষয়গুলো জানতে পেরে দৌড়াদৌড়ি করে তেজগাঁও পুলিশের ডিসি মাহমদু খানের কাছ থেকে ৩৫ জন স্টাফের জন্য সীমিত ত্রাণ ম্যানেজ করি। ১৫ এপ্রিল পুলিশ মহোদয় বিতরণ করেন।
তিনি বলেন, এর পাশাপাশি রাজধানীর ২৯ নম্বর ওয়ার্ড কমিশনারের কাছে সহায়তার জন্য কর্মচারীদের লিস্ট পাঠালেও কোনো লাভ হয়নি। তবে ওই ওয়ার্ডের মিরাজ নামে একজন আওয়ামিলীগ নেতা ৩৫ জন কর্মচারীর জন্য ৫০ কেজি চাল দিয়েছেন নিজ উদ্যোগে। পাশাপাশি কিছু তরকারি, ডাল দিয়েছেন।
বিষয়টির সত্যতা জানতে তেজগাঁও বিভাগের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. মাহমুদ খানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে চ্যানেল আই অনলাইনকে তিনি বলেন, আনন্দ ও ছন্দ, এই দুটি সিনেমা হলের মেহনতি মানুষদের বেতন আর কতো, সরকারের ঘোষিত সাধারণ ছুটির আওতায় থাকাকালীন সময়ে হল বন্ধ, তারা করোনা পরিস্থিতিতে অনাহারে জীবন যাপন করছিল। মানবিক মূ্ল্যবোধ থেকেই ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগ তাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।
তিনি বলেন, তেজগাঁও বিভাগের উপ কমিশনার (ডিসি) বিপ্লব বিজয় তালুকদারের সার্বিক তত্ত্বাবধানে আমরা পুরো তেজগাঁও বিভাগের নিম্ন আয়ের মানুষসহ মেহনতি মানুষদের দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। যেহেতু ফার্মগেটের ছন্দা ও আনন্দ হল তেজগাঁও বিভাগের অধীনে পড়েছে তাই ওই দুই হলে কর্মরত নিম্ন আয়ের মানুষদের আমরা সহায়তা করেছি।
সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আনন্দ সিনেমা হলের ম্যানেজার শামসুদ্দিন বলেন, সরকার অন্যান্য শিল্পখাতে প্রণোদনা দিচ্ছে। অন্যান্য শিল্প সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য এ অবদান রাখে, আমরাও অভ্যন্তরীণ রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সরকারকে প্রতিটি টিকেট থেকে ভ্যাট ও পৌর কর দিয়েছি। তাহলে সিনেমা হল কেন সরকারের প্রণোদনার বাইরে থাকছে? তিনি বলেন, আমাদের অবস্থা এতোটাই খারাপ বলে বোঝাতে পারবো না। সিনেমা হল যদি না থাকে তাহলে প্রযোজক, শিল্পী, পরিচালক ওনারা কোথায় ছবি চালাবেন? আমাদের দুঃখ কেউ দেখছে না। সরকার সিনেমা হলে সুদ্মুক্ত ঋণ দিলে হয়তো সিনেমা অঙ্গন কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।
টিকাটুলির মোড়ের ঐতিহ্যবাহী অভিসার সিনেমাটি করোনার কারণে ১৮ মার্চ থেকে বন্ধ। আগামীতে আদৌ খুলবে কিনা সেই নিশ্চয়তা দিতে পারলেন না কর্মকর্তা খাইরুল কবির। তিনি বলেন, ৭২ জন স্টাফের প্রতিমাসে ৪ লাখ টাকা বেতন বহন করার সাধ্য মালিকের নেই। কারণ, সিনেমার এখন ব্যবসা নেই। তবে বন্ধের সময় একমাসের বেতন দেয়া হয়েছে। ব্যবসা না হওয়ায় আগামীতে এত বেতন সম্ভব না। সরকারি ঋণ না পেলে আগামীতে অভিসার নাও খুলতে পারে।
রাজধানীর মিরপুর অঞ্চলের প্রসিদ্ধ সিনেমা হল এশিয়া। এই হলের কর্মচারী কাজী আনিস জানান, সেখানে ১৮ জন কর্মচারী গত মার্চের বেতন পাননি। বলেন, গত একমাসে বন্ধ থাকা লক্ষাধিক টাকা লোকসান হয়েছে। বেতন চাইলেও মালিক কিছু বলছে না। এভাবে কতোদিন চলবে কোনো ঠিক নেই। সরকার যদি স্টাফদের প্রতি সদয় হয়ে প্রণোদনার ব্যবস্থা করেন তাহলে দেশে সব সিনেমা হল টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে।
দেশের অন্যন্য সিনেমা হলগুলোর অবস্থাও প্রায়ই একই। যশোরের মণিহার সিনেমা হলের ম্যানেজার তোফাজ্জেল হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, হল বন্ধ। আমাদের ৪৫ জন স্টাফের ফেব্রুয়ারি থেকে বেতন আটকে আছে। দেখি, মালিক আমাদের বেতন পরিশোধ করে কিনা। এমন অবস্থায় কেউ যদি আমাদের দিকে না তাকায়, তবে কদিন পরে না খেয়ে মরার মতো অবস্থা হবে আমাদের!
করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পর সিনেমা হলের ভবিষ্যৎ নিয়েও শঙ্কায় আছেন মণিহার সিনেমা হলের এই কর্মকর্তা। তিনি বলেন, এমনিতেই কোনোরকমে চলছিলো দেশের ইন্ডাস্ট্রি, করোনার কারণে ছেদ পড়ায় ভবিষ্যতে কী হয়, তা সময়েই বলে দিবে! তবে আমরা সিনেমা হলের ভবিষ্যত নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
চট্টগ্রামের ঝুমুর ও সিনেমা প্যালেস হলের মালিক আবুল হোসেন তার দুই সিনেমা হলের ৩০ জন কর্মচারী মানবেতর জীবনযাপন করছে উল্লেখ করে বলেন, প্রতিমাসে তাদের বেতন ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে ২ লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। লোকসান গুণেও এতদিন হল চালু রেখেছিলাম। এখন করোনার কারণে বন্ধ। কবে খুলবে তাও জানিনা। হল বন্ধ থাকলেও ঠিকই স্টাফদের ব্যয় বহন করতে হচ্ছে। কিন্তু আগামীতে আয় ছাড়া প্রতিমাসে ২ লাখ টাকা ব্যয় বহন করা সম্ভব নয়। তাই এই শিল্প টিকাতে সরকারি সুদৃষ্টির বিকল্প নেই।
চলচ্চিত্র প্রদর্শক সমিতির সাবেক সভাপতি ও মধুমিতা সিনেমা হলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইফতেখার নওশাদ বলেন, ৪০ জন কর্মচারীর ফেব্রুয়ারির মাসের বেতন দেয়া আছে। মার্চের বেতন হয়নি। কোথা থেকে এনে দেব তাও জানিনা। আমাদের অন্যন্য ব্যবসা বন্ধ। ভাড়া পেলে না হয় অন্যদিক থেকে এনে ম্যানেজ করতাম।
তিনি বলেন, বর্তমানে সিনেমা হল মালিকদের কোনো কমিটি নেই। সরকারি একজন প্রশাসক দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। তার কাছে সরকারিভাবে সহায়তার জন্য আবেদন জানাবো। সরকারি ঋণ বা প্রণোদনা ছাড়া আমাদের করুণ অবস্থা কোনোভাবেই দূর করা সম্ভব হবে না।
করোনার প্রকোপে দেশের সিনেমা হলের কর্মচারীদের মধ্যে তুলনামূলক ভালো আছে স্টার সিনেপ্লেক্সের তিন শাখার মোট ৩০০ কর্মী। সেখানকার জৈষ্ঠ্য বিপণন কর্মকর্তা মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, আমাদের সব মাসের বেতন ক্লিয়ার আছে। সারাবিশ্ব করোনায় কাবু হয়েছে, জীবন বিপন্ন হচ্ছে। এদিক বিবেচনা করে ম্যানেজমেন্ট কর্মীদের প্রতি আন্তরিক। জাতীয় এই ক্রাইসিসেও ম্যানেজমেন্ট আমাদের নিয়মিত খোঁজ নিচ্ছে। আমরাও দ্বিতীয় পরিবার হিসেবে প্রত্যেক সহকর্মীকে মিস করছি। আমাদের নিয়মিত দর্শক ছিল প্রচুর। ২০ মার্চ থেকে স্টার সিনেপ্লেক্স বন্ধ। এই একমাসে লোকসানও হয়েছে মোটা অংকের অর্থ।
ছবি: ইন্টারনেট