‘করোনার দ্বিতীয় ঢেউ নয়, এটা এখন সুনামির ঢেউ’, এমন শঙ্কা প্রকাশ করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন: দেশের করোনা পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হয়ে ওঠার আগেই কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করা প্রয়োজন।
একইসাথে তারা মনে করেন: জরুরি ভিত্তিতে তবে সুনির্দিষ্ট টার্গেট করে, কোথায় কোথায় মানুষ বেশি সংক্রমিত বেশি হচ্ছে সেটা বের করতে হবে। এর পাশাপাশি সরকারের ঘোষিত ১৮টি সিদ্ধান্তকে অবশ্যই পালনীয় নির্দেশ হিসেবে নিয়ে তা পালনে যা যা করার দরকার সরকারকে তা করতে হবে। বিশেষ করে এবার ‘সীমিত আকারে’ শব্দটি উচ্চারণ করা যাবে না মোটেও।
দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ভয়াবহরূপে ছড়িয়ে পড়েছে। দেশে গড় শনাক্তের হার ২৩ শতাংশে পৌঁছে গেছে। রাজধানীর কোনো কোনো আরটিপিসিআর ল্যাবে শনাক্তের হার ৬০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।
ইতোমধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৩১ জেলাকে অধিক ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করেছে। এসব জেলায় সংক্রমণের হার ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। শনাক্ত ও মৃত্যুর হার প্রতিদিন নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করছে।
ঝুঁকিপূর্ণ বাকি জেলাগুলোতে কঠোরভাবে সরকার নির্দেশিত ১৮ দফা বিধিনিষেধ প্রতিপালন করতে হবে। অন্যথায় আসছে সপ্তাহে দৈনিক আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
করোনা নিয়ন্ত্রণে তিনভাগে কাজ করতে হবে
সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: ‘করোনা নিয়ন্ত্রণের জন্য তিনভাগে কাজ করতে হবে। এক, যারা সংক্রমিত হয়েছেন তাদের স্বাস্থ্য বিভাগের চিকিৎসা সেবায় আনতে হবে। পাশাপাশি সরকারী আইসোলেশনে সেন্টার খুলে সেখানে রাখতে হবে। তাদের নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তাতে করে আইসিইউয়ের ওপর চাপ পড়বে না। এছাড়া পরিবারের সদস্যদের জন্য কোয়ারেন্টাইন কেন্দ্র খুলতে হবে। যা কিনা আইসিইউ খরচের চাইতেও অনেক কম।
দুই, যারা অলক্ষ্যে সংক্রমিত হচ্ছে, যাদের সম্পর্কে আমরা জানি না তাদের স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্যবিধির মধ্যে নতুন করে গুরুত্ব দিতে হবে যে, বদ্ধ পরিবেশে মানুষ বেশি একত্রে থাকছে, সে সব জায়গায় ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করতে হবে। আর যেখানে ভেন্টিলেশন ব্যবস্থা করা যাবে না যেমন (সেবাদান কেন্দ্র, ব্যাংক, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট) সেসব জায়গায় বেশিক্ষণ থাকা যাবে না। সেখানে কম জনসমাগম যাওয়া আসা নিশ্চিত করতে হবে।
তিন, ভ্যাকসিন দিতে হবে। যদিও এখন ভ্যাকসিন সরবরাহ অনেকটা কম, তবুও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষদের যতো আমরা ভ্যাকসিন দিতে পারবো মৃত্যুর হার ততো কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
এই তিনভাগে কাজ করলে পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।’
এবার ‘সীমিত আকারে’ শব্দটি উচ্চারণ করা যাবে না
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) করোনা ল্যাবের ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: সময়টা এখন আবারও সচেতন হওয়ার। করোনা সংক্রমণে দেশে মার্চ ২০২০ এবং মার্চ ২০২১-এর মধ্যে বেশ সাদৃশ্য লক্ষণীয়। আমরা যারা সরাসরি ভাইরাসটি নিয়ে ল্যাবে সময় কাটাই, সবার আগে আমরাই দেখতে পাই ভাইরাসের এর ক্রমহ্রাস বা ক্রমবৃদ্ধি। তবে এবার তারাই বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন যারা গতবার আক্রান্ত হননি। সাম্প্রতিক সাধারণ মানুষের মধ্যে যেমন গা-ছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে তাতে পরিস্থিতি গতবারের চেয়ে খারাপ হবে, সেটা অনুমেয়।
তিনি বলেন: প্রতিদিন সংক্রমণ আর মৃত্যুর যে ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, তাতে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহের আগেই হয়তো ভয়াবহ রুপ নিতে যাচ্ছে করোনা। কঠোর সিদ্বান্ত নিতে বা হার্ডলাইনে যেতে ধীরগতি সরকারের জন্য বিব্রতকর পরিস্থিতি বয়ে আনতে পারে এবার। পর্যবেক্ষণে না থেকে ঘোষিত ১৮টি সিদ্বান্ত ১৮টি অবশ্যই পালনীয় নির্দেশ আর তা পালনে যা যা করার দরকার সরকারকে তাই করতে হবে। বিশেষ করে এবার ‘সীমিত আকারে’ শব্দটি উচ্চারণ করা যাবেনা মোটেও।
ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন: ‘এবারে করোনার ব্যাপকতায় সাধারণ মানুষও দায় এড়াতে পারবে না। যেভাবে এখনও সামাজিক অনুষ্ঠানসহ বিভিন্ন ফেস্টিভালে অংশ নিচ্ছে, তাদের মধ্যে কোন ভয়ভীতির লক্ষণ নেই। মানুষের মধ্যে ভয়টা একেবারেই উবে গিয়েছে বিশেষ করে ভ্যাকসিন মানুষকে অলীক দুঃসাহসী করে তুলেছে।’
যেসব জায়গায় সংক্রমণ বেশি
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন: ‘মানুষ কিন্তু রাস্তাঘাটে সংক্রমিত হয় না, খেলার মাঠে সংক্রমিত হয় না। মানুষ সংক্রমিত হচ্ছে ছোট ছোট রেস্টুরেন্টে যেখানে মাস্ক ছাড়া খাবার খাওয়া হচ্ছে, কোনো ভেন্টিলেশন নেই। গণপরিবহনে গাদাগাদি করে ওঠে সংক্রমিত হচ্ছে। এই যে মেডিকেল পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলো এখানে হলরুমে কেউ সংক্রমিত না হলেও যারা বাইরে অপেক্ষামাণ ছিল তারা যদি স্বাস্থ্যবিধি না মানে তাহলে সংক্রমিত হবে। তাছাড়া আমাদের পাবলিক টয়লেট, সেখানে যদি সাবান না থাকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় সেটা যদি পরিষ্কার করা না হয় তাহলে সেখান থেকে মানুষ সংক্রমিত হবে।’
নতুন স্টেইনে করোনার আগের লক্ষণ নেই
নিপসমের ভাইরোলজিস্ট ডা. মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন বলেন: করোনার লক্ষণগুলো আর আগের মতো নেই, আক্রান্তরা অনেকাংশে বিভ্রান্ত। করোনা সংক্রমণে আর ব্যতিক্রমী ভাব নেই, সব বয়সের আর সব শ্রেণীর মানুষ এবার আক্রান্ত হচ্ছে যা সহসাই ভয়াবহ রুপ নিতে পারে। এটা ধনীদের রোগ গরীবকে ছোঁয় না বলে আর আস্ফালনের সুযোগ নেই।
তিনি বলেন: করোনার পরিবর্তিত রুপ বা স্ট্রেইন এ পরিবর্তন আমাদের সহজাত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বা শারীরিক প্রতিবন্ধতাকে উতরিয়ে ব্যাপক সংক্রমণ ঘটাতে পারে এবার যা সংক্রমণের গতিবিধি দেখে সহজেই অনুমেয় আর এটা এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহেই দৃশ্যমান হতে যাচ্ছে হয়তো।
সবকিছু লকডাউনের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মোশতাক হোসেন বলেন: আমাদের লকডাউনে যেতে হবে হয়তো, তবে সুনিদিষ্ট টার্গেট করে, কোথায় কোথায় মানুষ সংক্রমিত বেশি হচ্ছে সেটা বের করতে হবে।
তিনি বলেন: লকডাউনের প্রতি জনমনে একটা ভীতি রয়েছে, সেখান থেকে তাদের বোঝাতে হবে যে এটা আমার বাঁচার জন্য জনস্বাস্থ্যের ব্যবস্থা। লকডাউনে আমাদের যেতে হবে, তবে সেটা সুখকর নয়। সুনির্দিষ্ট জায়গাগুলো যদি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারি, সবকিছু লকডাউনের ওপর ছেড়ে দিলে হবে না।
ডা. মোশতাক হোসেন বলেন: তথাকথিত লকডাউনে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসবে, লকডাউন খুলে যাবার পর আমরা আবার আগের মতো ঝুঁকিপূর্ণ চলাফেরা শুরু করি। যা আমরা ফেব্রুয়ারিতে করেছি, এখন আর করোনার সংক্রমণকে দ্বিতীয় ঢেউ বলা যাবে না, এটা একটা সুনামির ঢেউ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘‘তাই আমাদের সুনিদিষ্ট জায়গা চিহ্নিত করে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সেখানে স্বাস্থ্যবিধি মানতে হবে। আর যদি সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে লকডাউনে আমাদের যেতে হবে। সেটা সারা দেশ হলেও করতে হবে। লকডাউন একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে বিশেষ ব্যবস্থা। এরআগে আমাদের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের জন্য সব কিছু করা উচিত। এটা অসম্ভব না, তবে কষ্টকর। একটু কষ্ট করে যদি বাঁচার জন্য চেষ্টা করি তাহলেও সংক্রমণ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে আসবে।’’
প্রতিদিনই শনাক্তে নতুন রেকর্ড হচ্ছে
গত ২৯ মার্চ থেকে ২ এপ্রিল পর্যন্ত পাঁচদিনে দেশে করোনায় আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তের হিসাব যথাক্রমে পাঁচ হাজার ১৮১, পাঁচ হাজার ৪২, পাঁচ হাজার ৩৫৮, ছয় হাজার ৪৬৯ ও ছয় হাজার ৮৩০।
প্রতিদিনই বাড়ছে মৃত্যু ও আক্রান্তের সংখ্যা। আজ করোনা শনাক্তে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। এদিন মৃত্যুও হয়েছে ৫০ জনের।
রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ জানায়, বৃহস্পতিবার তাদের পিসিআর ল্যাবে কোভিড পজিটিভ রোগীর শনাক্তের হার ৫৮ দশমিক ৫১ শতাংশ। যা এযাবৎকালের মধ্যে সর্বোচ্চ। গতকাল নিপসমের পিসিআর ল্যাবে সংক্রমণ শনাক্তের হার ছিল শতকরা ২০ শতাংশ।
বর্তমান পরিস্থিতি প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন: যেভাবে প্রতিদিন করোনা সংক্রমণের হার বাড়ছে, এভাবে চলতে থাকলে দেশে কোনো হাসপাতালেই রোগী রাখার জায়গা থাকবে না।