চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

করোনাযুদ্ধে নিজেকেই হতে হবে প্রকৃতযোদ্ধা

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে এর উপসর্গগুলো দেখা যাওয়ার আগেই ভিতরে ভিতরে তা মারাত্মকভাবে সংক্রমিত হয়ে থাকে এবং এই সংক্রমণ ও আক্রান্তের মাত্রা পূর্ব থেকে জানারও কোনো সুযোগ থাকে না। তাই করোনা উপসর্গ নিয়ে যখন আক্রান্তের বিষয়ে জানার জন্য টেস্ট করা হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তি নিশ্চিত হন, তখন বস্তুত পক্ষে অনেক দেরি হয়ে যায়।

আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে উপসর্গগুলো গোপন থাকার এই সময়কালটা সত্যিই উদ্বেগের। যা ভাইরাসজনিত একটি রোগকে অন্যমাত্রায় নিয়ে গিয়েছে। সাধারণ সর্দি, কাশি, জ্বর, গায়ে ব্যথারমতো বিষয়গুলো হয়ে উঠেছে মরণব্যাধি। কোনো উন্নত চিকিৎসা এবং কোনো ওষুধেও সহজে কাজ হচ্ছে না। তাই করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর হার অনেক বেশি। আর এই রোগটি এতটাই ছোঁয়াচে যে, অল্পসময়ের মধ্যে অনেকের দেহে ছড়িয়ে যেতে পারে। এই সময়কালটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।

আমেরিকা, ইউরোপ এবং আমাদের দেশের সর্বশেষ পরিসংখ্যান এই কথাই বলছে। করোনা ভাইরাসের এই মহামারী থেকে নিজে ও অন্যকে বাঁচানোর এবং সর্বোপরি এ দেশ, জাতি ও বিশ্বকে বিপন্নের হাত থেকে রক্ষা করার একমাত্র পথ হচ্ছে যেকোন মূল্যে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে চলাফেরা ও সকল ধরনের কর্মসম্পাদন করা, যার সহজ উপায় হচ্ছে ‘ঘরে থাকা’। ইতোমধ্যে এটাও প্রমাণিত হয়েছে যে, যারা এই কাজটা যতটা সফলভাবে করতে পেরেছে তারাই ততটা সফলতার সাথে করোনা সংকট মোকাবেলা করতে পারছে।

‘ঘরে থাক, ঘরে থাক এবং ঘরে থাক’ যত সহজে বলা যাচ্ছে তা নিশ্চিত করা ঠিক ততটাই কঠিন হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের মতো বিশাল জনগোষ্ঠীর একটি দেশে যেখানে আর্থ-সামাজিক অবস্থার পার্থক্য অনেক বেশি, সামাজিক সুরক্ষার বিষয়টি এখনও প্রাতিষ্ঠানিকরূপ লাভ করেনি এবং সরকারি নির্দেশ মানার প্রবণতা কম, সেখানে কোনোভাবে জীবন ধারণের উপকরণগুলোর যোগান বাইরে থেকে দিয়ে, মানুষকে ঘরে রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করা মোটেই সহজ নয়।

বাংলাদেশে গত ২৫শে মার্চ থেকে এপর্যন্ত কোভিড-১৯ এর তীব্রতা যে হারে বেড়েছে তাতে এটা নিশ্চিত, মানুষ যে কোনও অজুহাতে ঘর থেকে বের হচ্ছে। হয়তো অনেক ক্ষেত্রে বাধ্য হচ্ছে সাপ্লাই চেইনের সংকটের কারণে। যার কেনার সার্মথ্য রয়েছে সে উপকরণ সংগ্রহের জন্য বের হচ্ছে আর যার একেবারেই কেনার সার্মথ্য নেই সেও বের হচ্ছে হয়তোবা কোন কাজের সন্ধানে অথবা খাদ্য সাহায্য পাওয়ার আশায়।

এর বাইরেও রয়েছে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ছোট পরিসরে বসবাস এবং দীর্ঘদিন ধরে ঘরে আটকে থাকার জন্য আবসাদগ্রস্ত হওয়ার বিষয়গুলো। এর বাইরেও অনেকগুলো সামাজিক বিষয় রয়েছে। রয়েছে কাজের সমন্বয়হীনতা। দায়িত্ব পালনকারীদের পেশাগত দক্ষতার অভাব। সুতরাং কেন মানুষকে ঘরে রাখা যাচ্ছে না এই সংকটের কারণের সরলীকরণের সুযোগ নেই। এতে করে ব্যর্থ হচ্ছে সরকারি, বেসরকারি ও সামাজিক উদ্যোগগুলো। লকডাউনের মতো কঠিন সিদ্ধান্তেও সফলতা আসছে প্রত্যাশার চেয়ে কম। প্রতিদিনই আমরা হেরে যাচ্ছি। আশংকাজনক হারে বাড়ছে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। বিগত কয়েকদিনের পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক।

সেবা দিতে গিয়ে আক্রান্ত হচ্ছে ফ্রন্টলাইনের যোদ্ধারা। দায়িত্ব পালনরত চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। করোনাযুদ্ধে আমরা হারতে পারি না। এই যুদ্ধে জয়লাভের জন্য আমাদের দরকার প্রকৃৃতযোদ্ধা। আর হ্যাঁ, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে জয়লাভ করার জন্য আমরা প্রত্যেকই হতে পারি একেকজন প্রকৃতযোদ্ধা।

এজন্য দেশপ্রেমিক, সৎ, দক্ষ ও সাহসী নেতা, সমাজকর্মী, নিবেদিত প্রাণ স্বাস্থ্যকর্মী, কর্মঠ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, নির্ভীক সংবাদকর্মী ও উদয়াস্ত স্বেচ্ছাসেবক হওয়ার প্রয়োজন নেই। শুধুমাত্র দরকার ‘ঘরে থাকা, ঘরে থাকা এবং ঘরে থাকা’। শব্দ দুটো খুব সহজ হলেও কাজটি মোটেই সহজ নয়। তবে কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। এজন্য প্রয়োজন নিজেকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করা। নিজের বিরুদ্ধে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হবে। বেশ কিছুদিন ঘরে থাকার জন্য কঠিন প্রতিজ্ঞা করতে হবে। আর তা করতে হবে এখন থেকেই। আগামীদিনের জন্য কোনোভাবেই দেরি করা যাবে না, কারণ আগামীদিন কখনও আসবে না। কিভাবে ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা যায় তার উপায় নিজকেই বের করতে হবে। আমরা কি একবারও চিন্তা করে দেখছি যে বিষয়টি কত নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক। আমি নির্দেশ অমান্য করছি বলেই আমার নিজের জীবন, আমার চারপাশের ভালবাসার মানুষগুলোর জীবন আজ হুমকির সম্মুখীন। আমি ঘর থেকে বের হচ্ছি বলেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও মাঠ পর্যায়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সারাক্ষণ বাইরে থাকতে হচ্ছে আমাকে ঘরে ফেরত পাঠানোর জন্য।

আমি আক্রান্ত হচ্ছি বলেই আমাকে সেবাদানের জন্য চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের জীবন আজ আমিই বিপন্ন করে তুলছি। আমি ঘরে থাকছি না বলেই দেশে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা হু হু করে বাড়ছে, প্রলম্বিত হচ্ছে লকডাউন। চরমভাবে সঙ্কটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। তাই, এক্ষেত্রে আমকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে। ১৯৭১ সালে এদেশের মানুষ স্বাধীনতার জন্য শুধু সীমাহীন কষ্টই স্বীকার করেন নি, নিজের জীবনও উৎসর্গ করেছেন। আজ দেশ মাতৃকার এই ক্রান্তিলগ্নে আমাদের শুধু একটু কিছুদিনের জন্য ঘরে থাকতে হবে। তাহলে, আমি হবো সেই প্রকৃতযোদ্ধা যার হাতেই পরাজিত হবে বিশ্ব মহামারী করোনাভাইরাস। আসুন যেভাবেই হোক ঘরে থাকি এবং এই মরণব্যাধিকে পরাজিত করি।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)