চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ

করোনাভাইরাস: পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য ‘এলএনওবি’ চায় বিশেষ উদ্যোগ

করোনাভাইরাস পুরো বিশ্বকে কাবু করে ফেলেছে। অন্যান্য দেশের মতো করোনার প্রভাবে ভয়াবহ সংকটের মুখোমুখি বাংলাদেশও। এটা কেবল মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকেই থামিয়ে দেয়নি, গত কয়েক দশকে উন্নয়নের পথে অগ্রযাত্রাকেও একেবারে বিপরীত দিকে ঠেলে দিয়েছে। তবে এই মহামারী বাংলাদেশের অতিদরিদ্র ও প্রান্তিক মানুষকে সবচেয়ে বেশি আঘাত করবে।

এমতাবস্থায় সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণের দাবি জানিয়েছে  ‘লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড’ (এলএনওবি) নামক সংগঠন।

লিভ নো ওয়ান বিহাইন্ড প্লাটফরম মূলত নয়টি জাতীয়-আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থার জোট সমন্বিত একটি প্লাটফর্ম। বাংলাদেশে ব্র্যাক এর সচিবালয়ের দায়িত্ব পালন করছে। এই প্লাটফর্মের অন্য সংস্থাগুলো হলো: সেভ দ্যা চিলড্রেন, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল, একশন এইড বাংলাদেশ, টিআইবি, সিবিএম, ইসলামিক রিলিফ এবং ভিএসও।

ব্র্যাকের এডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেঞ্জ পলিসি এনালিস্ট ইজ্জাত তানজিলা ইভানা ও সেভ দ্যা চিলড্রেন এর এডভোকেসি এন্ড ক্যাম্পেইন এর আসিফ ইমরান খান সাক্ষতির বিজ্ঞপ্তিতে প্লাটফর্মটি জানায়, এই ভাইরাসের বিস্তাররোধে এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি যে ব্যাস্টিক ও সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তা প্রশংসার যোগ্য। এই জোট সংকট মোকাবেলায় সরকার গৃহীত সময়োপযোগী ও প্রয়োজনীয় এসব পদক্ষেপের প্রতি সর্বাত্মক সংহতি প্রকাশ করেছে।

তবে এই জোট মনে করে যে, সংকট মোকাবিলায় সরকার যে সব উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, সেখানে সমাজের সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া দুর্বল, প্রান্তিক ও দরিদ্রতম জনগোষ্ঠীর চাহিদার কথা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ।

এলএনওবি প্ল্যাটফর্মের বিশ্লেষণ বলছে: প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, তৃতীয় লিঙ্গের জনগোষ্ঠী, মাদক গ্রহণকারী ব্যক্তি (পিডব্লিউআইডি); যৌনকর্মী এবং বিভিন্ন যৌনবাহিত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা  সবচেয়ে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী। এছাড়া বাংলাদেশের হাওর ও চরাঞ্চলে বসবাসকারী দরিদ্র জনগোষ্ঠীসহ সার্বিকভাবে গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলে ১১.৩% চরম দরিদ্র জনগোষ্ঠীর চাহিদার প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া দরকার। বিশেষ করে সহায়সম্বলহীন দুর্বল জনগোষ্ঠীর নারী ও শিশুদের প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া দরকার। তা না হলে এই মহামারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব তাদের জীবনকে মারাত্মক সংকটের মুখে ঠেলে দিতে পারে।

এলএনওবি প্ল্যাটফর্মের পক্ষ থেকে দেশের সরকার, উন্নয়ন সংস্থা, নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম, এবং দেশের নাগরিকদের প্রতি অতিদরিদ্র প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিক, ব্যাপক, প্রবেশগম্য ও দূরদর্শী ব্যবস্থা গ্রহণ করার বিষয়ে কিছু সুপারিশ উপস্থাপন করেছে। তা হলো-

• স্বাস্থ্যব্যবস্থা সবার জন্য প্রবেশগম্য এবং প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ নিশ্চিত করে কোভিড-১৯ প্রতিরোধ এবং তাৎক্ষণিকভাবে গৃহীত বিভিন্ন উদ্যোগে সর্বাধিক পিছিয়ে পড়া এবং দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত জনগোষ্ঠীর চাহিদার উপর বিশেষ জোর দেওয়া উচিত। লক্ষিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য কোভিড-১৯-এর কার্যকর পরীক্ষার সুযোগ, কোয়ারেন্টিন ও বিচ্ছিন্ন থাকার পৃথক কেন্দ্রগুলো প্রবেশগম্য করা, ঔষদের সরবরাহ ও বিতরণ নিশ্চিত করাসহ অস্থায়ী স্বাস্থ্যসেবার সুযোগগুলোর সম্প্রসারণ করতে হবে;

• শহরের ভাসমান জনগোষ্ঠীর জন্য প্রবেশগম্য টেস্টিং বুথ তৈরি করা উচিত। হাওর ও চরাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য সহজে প্রবেশগম্য নৌ-অ্যাম্বুলেন্স চালু করতে হবে, বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী ব্যক্তির চিকিৎসার জন্য বিশেষ নির্দেশনা এবং ডাক্তারদের জন্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম সরবরাহ করতে হবে;

• বিশেষ সার্ভিস সেন্টার, যেমন- জেলা এইচআইভি কেন্দ্র, প্রতিবন্ধী পরিষেবা কেন্দ্রগুলোতে পিপিই এবং অন্যান্য সুরক্ষামূলক উপকরণ সরবরাহ করা দরকার। কারণ কোভিড-১৯ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি এবং এইচআইভি আক্রান্ত ব্যক্তিদের, বিশেষ করে দুর্বল রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা, শ্বাস কষ্ট, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিস রোগীদের স্বাস্থ্য-ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে;

• রোগ সংক্রমণ ও স্বাস্থ্যঝুঁকি প্রতিরোধে বাংলাদেশ সরকারের যে সেসব সচেতনতামূলক যোগাযোগ উপকরণ আছে, সেগুলো আঞ্চলিক ভাষায় পরিষ্কার, সহজবোধ্য, লিঙ্গ সংবেদনশীল, শিশুবান্ধব এবং প্রতিটি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য উপযোগী করে ব্যাপকভাবে প্রচারের জন্য একটি বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে ক্ষুদে বার্তা হিসেবে এসব স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক বার্তা প্রেরণ করা যেতে পারে;

• বিভিন্ন পরিষেবা, স্বাস্থ্য সচেতনতামূলক বার্তাসহ সকল সরকারি বার্তা শ্রবণ ও বাকপ্রতিবন্ধীদের জন্য প্রবেশগম্য করে প্রেরণ করতে হবে। এ জন্য তাদের উপযোগী ভাষা বা ইশারা ভাষা ব্যবহার করতে হবে;

• প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শিশু ও পরিবারসদস্যদের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পর্যাপ্ত কমিউনিটিভিত্তিক হাত-ধোয়ার ব্যবস্থা, পানি সরবরাহ, স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কে সচেতনতা ও স্যানিটেশন সুবিধা দিতে হবে;

• বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা জাল, যেমন-ভিজিএফ, ভিজিডি বর্মসূচি এবং খাদ্য রেশন কার্ডগুলোকে গ্রাম ও শহরের প্রান্তিক এবং অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষভাবে উৎসর্গীকৃত হতে হবে এবং বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে যাতে করে তারা উপকৃত হয়;

• যৌনকর্মীদের জন্য জরুরিভিত্তিতে খাদ্য সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের প্রতিশ্রুতি অবশ্যই প্রশংসনীয়। সরকারিভাবে অনুমোদিত পতিতালয়গুলোর পাশাপাশি দেশের সমস্ত পতিতালয়কে ম্যাপিংয়ের মাধ্যমে টেস্টিং সুবিধা, চিকিৎসা সুবিধা দিতে হবে এবং ওষুধ সরবরাহ করতে হবে। একইসঙ্গে যৌনকর্মীদের সরকারের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় সাহায্য প্রদানের কর্মসূচি অব্যাহত রাখতে হবে;

• অবিলম্বে লক্ষিত জনগোষ্ঠীর হাতে সরাসরি নগদ টাকা স্থানান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। মোবাইল মানি ট্রান্সফারের মাধ্যমে শহুরে ভাসমান লোকদের কাছে টাকা পৌঁছানো যাচ্ছে না, কারণ জাতীয় পরিচয়পত্র না থাকার কারণে অনেকেই মোবাইল মানি সিস্টেমে অ্যাকাউন্ট খুলতে পারে না;

• শিশুদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষার জন্য প্রস্তুতি এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা জোরদারের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের শিশুদের উপযুক্ত যত্ন নিশ্চিত করতে হবে। এর মধ্যে বিদ্যালয়ের বাইরে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য দূরবর্তী সমন্বিত শিখন কার্যক্রমে সক্ষম করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং প্রাপ্তবয়স্কদের পরিচর্যার জন্য হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হলে উপযুক্ত যত্ন ও প্রবেশগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে;

• প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর সংগঠনগুলো (ডিপিও) এবং কমিউনিটিভিত্তিক সংস্থালোকে সকল স্তরে কোভিড-১৯ সম্পর্কিত কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে;

• অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত বিভিন্ন তরুণ যারা ইতিমধ্যে চাকরি হারিয়েছেন, তাদের জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। দক্ষতা বিকাশ কর্মসূচির আওতাধীন যুবদের অনলাইন প্রশিক্ষণ প্রদান এবং প্রয়োজনীয় অনলাইন উপকরণ প্রস্তুত করা যেতে পারে;

• কোভিড-১৯-এর কারণে দোকানপাট, অফিস-আদালত, যানবাহন, চলাচলসহ সব কিছু বন্ধ করে দেওয়ার পর থেকে মেয়েশিশু এবং নারীর প্রতি পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা বেড়ে গেছে। এই নির্যাতনের ঘটনা প্রতিরোধ ও প্রতিকারে সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে;

• প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য যে সব মানবিক সহায়তামূলক উদ্যোগ ও ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুতি সরকার গ্রহণ করছে, সে বিষয়ে একটি সাপ্তাহিক প্রতিবেদন তৈরি ও প্রকাশ করা যেতে পারে;

• মহামারী চলাকালীন এবং পরে সরকারকে মেয়েশিশু ও নারীর বিরুদ্ধে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ঝুঁকি থেকে সুরক্ষা দিতে হবে। এ জন্য রেফারেল পরিষেবা চালু, দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির ব্যবস্থা, মানসিক সহায়তা প্রদানসহ সুরক্ষামূলক কার্যক্রম, বিশেষ করে পারবিারিক নির্যাতন, যৌন নিপীড়ন, বাল্যবিবাহ রোধ কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে এবং সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায়ের মধ্যে এসব কার্যক্রম পরিচালনায় অগ্রাধিকার প্রদান করতে হবে।

এছাড়াও কোভিড-১৯ মোকাবিলায় সরকার গৃহীত বিভিন্ন মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনায় স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের উপর গুরুত্বারোপ করেছে প্লাটফর্মটি, যেন কোনো ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতি না হয়।

মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করার জন্য সরকার এবং অন্যান্য স্টেকহোল্ডারদের প্রতি আহ্বানও জানিয়েছে এই প্লাটফর্ম।