কোভিড-১৯ যা এখন করোনাভাইরাস নামেই বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে অত্যাধিক সুপরিচিত। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে প্রথম চীনে শনাক্ত হয় করোনা ভাইরাস। যার অল্প কিছুদিনের মধ্যে এটি ছড়িয়ে পরে বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোতে, ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা এবং বড় হতে থাকে মৃত্যুর মিছিল। ফলে করোনা ভাইরাস অল্প কিছুদিনের মধ্যেই রুপ নেয় বৈশ্বিক মহামারীতে। করোনা সংক্রমণের ১০৩তম দিনে আক্রান্তের তালিকায় কানাডাকে পেছনে ফেলে বিশ্বে ১৭ নম্বর স্থান দখল করেছে বাংলাদেশ।
গত ২৩ জুন, ২০২০ইং পর্যন্ত দেশটিতে মোট ১,১৯,১৯৮ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে আর মৃত্যু হয়েছে মোট ১,৫৪৫ জনের। বাংলাদেশের স্বাস্থ্য অধিদফতরের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিসংখ্যান অনুসারে, গত ৬ জুন, ২০২০ইং পর্যন্ত দেশের মোট আক্রান্তের শুধুমাত্র ঢাকা জেলায় ২০ হাজার ৭০৭ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন। এর মধ্যে ঢাকা মহানগরীতে আক্রান্ত ১৯ হাজার ৩২৭ জন। নগরীর মধ্যে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি করোনা সংক্রমিত রোগী পাওয়া গেছে মিরপুর এলাকায়। সেখানে ৯৬৯ করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছেন।
অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি তুলে নেয় বাংলাদেশ সরকার। এর পরপরই করোনার বড়সড় সংক্রমণ শুরু। বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে উন্নত দেশই হোক আর উন্নয়নশীল অর্থনীতিই হোক, কোনো দেশই অজানা অথবা অনির্দিষ্টকালেএ জন্য সম্পূর্ণ লকডাউনে থাকা সম্ভব নয়। অন্যদিকে কার্যকরী প্রতিষেধক আবিস্কারের পূর্বে সম্পূর্ণরুপে পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়াও অসম্ভব। তাই ধীরে ধীরে যতটাসম্ভব স্বাভাবিকীকরণের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি লক্ষ্য রাখতে হবে যেসব স্থানে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় ভাইরাসের সংক্রমণ এখনো বিদ্যমান, অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের চালু হলে কিন্তু সংক্রমণ অনেক গুনে বেড়ে যাবার সম্ভাবনা থাকবে। এটা ঠিক যে বাংলাদেশে জীবন ও জীবিকার মধ্যে একটা সাংঘর্ষিক অবস্থা বিরাজ করছে। ইতিমধ্যে সরকার অনেক প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।
তারপরও আমাদের মতো দেশ দীর্ঘদিন লকডাউন করে রাখার সামর্থ্য রাখে না। তাই, দুইমাসের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি থাকার পর গত ৩০ মে’র পর থেকে আর ছুটি বাড়ানো হয়নি। অফিস, গণপরিবহন ও দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। কিন্তু অর্থনীতির চাকা চালু রাখতে গিয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেয়ার পর দেখা যাচ্ছে কোনভাবেই সংক্রমণ এর সংখ্যা কমছে নাহ৷ বরং টানা কয়েকদিন ধরেই বাংলাদেশে প্রতিদিন দুই হাজারের বেশি কোভিড-১৯ রোগী শনাক্ত হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আগেই সতর্কবার্তা দিয়েছিল, লকডাউন তুললে করোনার ভয়াবহ হামলা হবে। তারপরেও অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে টানা ৬৬ দিনের সাধারণ ছুটি তুলে নেয় বাংলাদেশ সরকার। এর পরপরই করোনার বড়সড় সংক্রমণ শুরু।
তাই, সংক্রমণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির পরিপেক্ষিতে আবার ও কঠোর পদক্ষেপ নেয়ার সুপারিশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি এলাকাভিত্তিক লকডাউনের প্রস্তাব ও দেয়া হয়। তাই করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় শেষ পর্যন্ত পুরো দেশকে রেড, ইয়েলো ও গ্রিন-এই তিন জোনে ভাগ করে লকডাউনে যাচ্ছে সরকার। করোনা আক্রান্তের হার কোন এলাকায় কেমন-তার উপর ভিত্তি করে এই তিন জোনে ভাগ বা ম্যাপিংয়ের কাজটি করছে আইসিটি মিনিস্ট্রি। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় করণীয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে জোনভিত্তিক লকডাউনসহ বিকল্প প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাৎক্ষনিক নির্দেশনা প্রদান করলে ঢাকায় করোনা আক্রান্ত হার বিবেচনায় নিয়ে বিভিন্ন এলাকাকে রেড জোন হিসেবে লকডাউন ঘোষণা করা হতে পারে। আর এ সপ্তাহের মধ্যেই পুরো দেশকে জোন ভিত্তিক রেড ইয়েলো ও গ্রিন এলাকায় বিভক্তের কাজ সম্পন্ন করে আগামী সপ্তাহের মধ্যেই সেভাবেই ব্যবস্থা নেয়ার কাজ সম্পন্ন করবে সরকার।
বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য একান্তই যদি পুরোপুরি লকডাউনে যাওয়া না সম্ভব হয় সরকারের প্রতি জোর অনুরোধ অন্ততঃ যেনো সুস্পষ্ট নির্দেশনায় জোনভিত্তিক কঠোর লকডাউন/কারফিউ অতিদ্রুত বাস্তবায়ন করা হয়। অর্থাৎ যে এলাকায় লকডাউন ঘোষণা করা হবে, সেই এলাকার মেইন সড়ক খোলা থাকবে কি না, তা সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে। মেইন সড়ক বন্ধ থাকলে কোন গলিপথ খোলা থাকবে, তা চিহ্নিতকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। লকডাউন এলাকায় কিভাবে দরিদ্র মানুষের খাবার ঘরে পৌঁছে দিবে এবং কাদের দ্বারা স্বেচ্ছাসেবী টিম প্রস্তুত করা হবে তাও ঠিক করতে হবে অতিদ্রুত। এই টিম জরুরি ওষুধসহ যাবতীয় প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছাবে। সাথে সাথে জরুরি সেবায় যারা নিয়োজিত থাকবেন, তারা লকডাউন অবস্থায় কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে নিজেকে সুরক্ষিত রেখে ডিউটি করবেন, সেটাও থাকতে হবে সুস্পষ্ট। একইভাবে কাঁচাবাজার ও ওষুধের কোন কোন দোকান খোলা থাকবে, তা উল্লেখ করতে হবে।
অন্যদিকে মাস্ক পরা নিয়ে নিজেদের উপদেশ পরিবর্তন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এখন তারা বলছে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থামাতে পাবলিক প্লেসে মাস্ক পরা উচিত। সংস্থাটি বলছে মাস্ক পরলে ‘জীবাণু বহনকারী ড্রপলেট’ থেকে সুরক্ষা পাওয়া সম্ভব বলে নতুন গবেষণায় প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের বেশ কিছু দেশ এর মধ্যেই প্রকাশ্য স্থানে মাস্ক পরার উপদেশ দিয়েছে। কিছু দেশে মাস্ক পরা বাধ্যতামূলকও করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এখনো রাস্তা-ঘাটে অনেক মানুষই মাস্ক পরছে নাহ। এমনকি সামাজিক দূরত্বের কথা বললেও সে ব্যাপারে নেই কোনো কড়াকড়ি, তাই মানুষের মাঝে নেই সচেতনতার বিন্দুমাত্র বালাই। পাশাপাশি মানুষজনকে কাজের তাগিদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে যেতে হচ্ছে রাজধানীতে। একদিকে নেই পর্যাপ্ত যানবাহন অন্যদিকে যানবাহন ভাড়ার টাকা গুনতে গিয়ে এতদিন কর্মহীন মানুষের খুব কষ্ট হচ্ছে৷ এসব যানবাহনে নিরাপদ দূরত্ব তো দূরের কথা অনেক ক্ষেত্রেই যাত্রীর সংখ্যা হচ্ছে ধারণক্ষমতার অনেক বেশি (বিশেষ করে দক্ষিণবঙ্গ থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাওয়া লঞ্চগুলো)।
সবকিছু বিবেচনায় করোনা সংক্রমণ অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধির চরম ঝুঁকির মধ্যে থেকে অনিশ্চয়তার পথে বাংলাদেশ। তাই অতিদ্রুত সেন্ট্রাল থেকে লোকাল লেভেল পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী সকল মানুষের জন্য মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করা, রাস্তা-ঘাটে এবং সকল পাবলিক পরিবহনে সহ বাসার বাইরে বের হলেই সামাজিক দূরত্ব কঠোরভাবে নিশ্চিত করা, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা ইত্যাদি অতিদ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে।
যেহেতু অর্থনীতির চাকা সচল রাখার জন্য পুরো বাংলাদেশ কঠোর লকডাউন করা যাচ্ছে না, তাই অতিদ্রুত সুস্পষ্ট নির্দেশনায় জোনভিত্তিক কঠোর লকডাউনে যেতে হবে৷ নতুবা বাংলাদেশে অনিশ্চয়তা থেকে মহামারী করোনা পরিস্থিতি চলে যাবে চরম অনিয়ন্ত্রনে আর ভয়াবহ মৃত্যুপুরীতে পরিনত হবে দেশ, জন্ম দিবে বাংলার বুকে নির্মম এক ইতিহাসের।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)