করোনাভাইরাস এর কালে কেমন আছেন দেশের প্রায় বিচ্ছিন্ন দুর্গম দ্বীপচরের হতদরিদ্র মানুষগুলো? তারা কী খেয়ে আছেন, নাকি না খেয়ে আছেন? জনপ্রতিনিধিরাই বা তাদের অসহায়ত্বের খবর কতোটা রাখছেন? এটি আমাদের কারো অজানা নয় যে, দুর্গম দ্বীপচরে বসবাসরত মানুষের বড় অংশ, যারা হতদরিদ্র বলে পরিচিত তারা সারাবছর ধরেই খাদ্যসংকটে ভুগে থাকেন।
লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নীলফামারী, জামালপুর, রংপুর, গাইবান্ধা জেলার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ চরভূমি। এর বাইরে উপকূলীয় অঞ্চলেও রয়েছে অনেক চর। এই সব চরের বড় অংশ দুর্গম দ্বীপচর বলে পরিচিত। যে সব চরে মূলভূমি থেকে যেতে কয়েকঘণ্টা সময় লাগে। দুর্গম চরগুলো অনেকটাই বিচ্ছিন্ন জনপদ। মূলত নদীপথেই এসব চরে যেতে হয়।
এসব চরে যারা বসবাস করেন তাদেরকে বছর জুড়েই নানামূখি সমস্যার মোকাবিলা করতে হয়। মূলত কৃষিজীবী ও মৎস্যজীবী পরিবারের বেশি বসবাস চরগুলোতে। জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রথম শিকারও এসব চরের মানূষ। বন্যা, নদীভাঙ্গন, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, প্রচন্ড শীতসহ সকল প্রকার দুর্যোগে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্থ ও দুর্ভোগের শিকার হয় এই মানুষগুলো। স্বভাবতই খাদ্যনিরাপত্তার অভাবও ভয়াবহ রুপে দেখা যায় চর জনগোষ্ঠীর মধ্যে। যে কোনো দুযোগকালীন সময়ে এই দুর্ভোগ আরও চরম আকার ধারণ করে।
সবমিলিয়ে চরাঞ্চলে প্রায় এককোটি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে একটি বড় অংশ হতবা অতিদরিদ্র বলে চিহ্নিত। চরের হত বা অতিদরিদ্ররা খাদ্য বঞ্চনার পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানসহ সব ধরনের মৌলিক অধিকার প্রাপ্তি থেকেই বঞ্চিত। সংবিধানে খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষাসহ যেসব মৌলিক অধিকার অনুসৃত রয়েছে তার কোনো অধিকারই সঠিকভাবে পান না চরবাসী।
ফলে নিরন্তর দুঃখ-কষ্টের এক বঞ্চনাময় জীবন অতিবাহিত করতে হয় তাদের। এই বঞ্চনা নতুন নয়, দীর্ঘদিনের। ফসল উৎপাদনের সুযোগ কম থাকা, উৎপাদিত ফসলের সঠিক মূল্য না পাওয়া, দুর্গম যোগাযোগ ব্যবস্থা, সরকারি সকল ধরনের মৌলিক সেবার অপর্যাপ্ততা, কর্মসংস্থানের স্বল্পতা, পর্যাপ্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড না থাকা, ঋণসুবিধা না পাওয়া, খাদ্যাভাব এবং বহুমুখী দুর্যোগপ্রবণ হওয়ার কারণেই দ্বীপচরে বসবাসরত মানুষকে সংগ্রাম করে বেঁচে থাকতে হয়। এ সংগ্রাম জন্মাবদি বললেও ভুল হবে না।
‘করোনা কালে কেমন আছেন চরের হতদরিদ্ররা?’ ফোনে সে কথাই জিজ্ঞেস করেছিলাম চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার দুর্গম পাকা ইউনিয়নের চর দশরশিয়ার বাসিন্দা লাল মোহাম্মদকে। লাল মোহাম্মদ ‘শিবগঞ্জ উপজেলা চর অ্যালায়েন্স‘-এর সদস্য, চরের মানুষের জন্য কাজ করছেন স্বেচ্ছায় । দীর্ঘদিন ধরে তিনি চরের মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াই-এ নিবেদিত। শিবগঞ্জ উপজেলার মূল ভূমি থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় চড়ে চর পাকাতে যেতে দুই থেকে তিন ঘণ্টা সময় লাগে। ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার অংশের সাথে একেবোরে লাগোয়া একটি ইউনিয়ন চর পাকা। পুরো পাকা ইউনিয়নই পদ্মাবক্ষের এক চর। এই ইউনিয়নেই ওয়াহেদপুর, ফতেপুরসহ বেশ কয়েকটি বিওপি রয়েছে।
এই চরের শ্রমিকদের বড় অংশ দেশের বিভিন্ন স্থানে কাজ করে থাকে। ফোনে লাল মোহাম্মদ জানালেন চরে খাদ্যসংকট থাকলেও দুর্গম হওয়ার কারণে এখন পর্যন্ত চরে কোনো রিলিফ কার্যক্রম বা কোনো ধরনের সহায়তা দেখা যায়নি। হতদরিদ্র পরিবারগুলো ধারদেনা করে সংসার চালাচ্ছেন। জনপ্রতিনিধিরাও তাদের খবর একটা রাখছেন না। প্রায় একই ধরনের অভিযোগ করেন পাবনা এলাকার চরাঞ্চলে কর্মরত উন্নয়ন সংগঠন যমুনা সমাজকল্যাণ সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মো. মনজেদ আলী। মনজেদ আলী দীর্ঘদিন ধরে পাবনা জেলার সুজানগর ও বেড়া উপজেলার দুর্গম চরে বসবাসরত হতদরিদ্র মানুষের জীবনমান উন্নয়নে নিজেকে নিবেদিত রেখেছেন। অনেকটা ক্ষোভের সাথেই তিনি বললেন, করোনা মহমারির কারণে চরের বিশাল অংশের মানুষ এখন বেকার। মৌসুমী শ্রমিক হিসেবে যারা বিভিন্ন জায়গাতে কাজ করতে যেতো তারাও আর যেতে পারছেন না।
এ ছাড়া প্রতিদিন যারা মূল ভূমিতে এসে দিনমজুরিসহ বিভিন্ন ধরনের কাজ করতেন তারাও সেটা করতে পারছেন না। ফলে অনেক পরিবারই খাদ্য সংকটে পড়েছে। অনেক পরিবারকেই দু:সহ জীবনযাপন করতে হচ্ছে। মনজেদ আলী বলেন, বর্তমান অবস্থা চলমান থাকলে চরের মানুষকে আরও বিপদে পড়বে। এ কারণে তাদের জন্য অবশ্যই বিশেষভাবে খাদ্যসহায়তা দেওয়া প্রয়োজন। একই কথার প্রতিধ্বণি শোনা গেছে ফরিদপুর থেকেও। ফরিদপুর জেলার বড় অংশ চরভূমি। নদী ভাঙ্গনের তীব্রতাও এখানে বেশি। এরমধ্যে করোনার কারণে নতুন সংকট তৈরি হয়েছে চরাঞ্চলে। ফরিদপুর জেলা চর অ্যালায়েন্স-এর সদস্য সচিব আনম ফজলুল হাদী সাব্বির। বিএফএফ নামের একটি উন্নয়ন সংগঠনের নির্বাহী পরিচালকও তিনি।
ফজলুল হাদী সাব্বির জানান, ফরিদপুরের চর মাধবদিয়া, ডিক্রির চর, নর্থ চ্যানেলসহ বেশ কয়েকটি চরে স্থানীয় উন্নয়ন সংগঠন এফডিএ, বিএফএফ, পিডাব্লিউও নিজস্ব উদ্যোগে কয়েকশত হতদরিদ্রদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। কিন্তু চরাঞ্চলে যে পরিমাণ হতদরিদ্র রয়েছে সেখানে প্রচুর ত্রাণের প্রয়োজন রয়েছে। তিনি বলেন, অনেকেই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। চরের মানুষের জন্য অবশ্যই সরকারকে আলাদা মনোযোগ দিতে হবে। যে প্রণোদনার কথা বলা হচ্ছে সেখানে চরের মানুষ, চরের কৃষকের কথা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। কারণ দেশের কৃষি অর্থনীতিতে চরের কৃষকের বড় অবদান রয়েছে।
অন্যদিকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের চর এলাকাতে বসবাসকারী বাউল গায়ক, বাঁশিবাদক, তবলা বাদক, ঢোল-দোতারা বাদক, যাত্রাশিল্পীরাও করোনা সংকটকালে বেশ বিপদে পড়েছেন। অনুষ্ঠান না থাকার কারণে তাদের এখন কোনো আয় নেই। অনেকেই তাই মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কয়েকদিন আগে ফোনে কথা হয় গাইবান্ধা জেলার ফুলছড়ি উপজেলার চরের বাসিন্দা হাশেম বয়াতীর সাথে। হাশেম বয়াতি জানান, তাঁর পরিবারের সদস্য সংখ্যা ছয়। গানই তার পেশা। কিন্তু করোনা মহামারীর পর তিনি আর কোথাও গান গাওয়ার আমন্ত্রণ পাচ্ছেন না। বেকার জীবনযাপন করছেন। আর কোনো কাজ পারেন না বলে তার সংসার চালানো দায় হয়ে পড়েছে। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমানের উদ্যোগে ‘রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ’ থেকে তিনি দুই হাজার টাকা সহায়তা পেয়েছেন। জানা গেছে রবীন্দ্র সঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ গাইবান্ধা, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, ফরিদপুর, রংপুর অঞ্চলের চরে বসবাসরত বেশ কিছু দরিদ্র লোকশিল্পীদের সহায়তা করেছেন।
চরের মানুষের উন্নয়ন নিয়ে যারা কাজ করেন তারা মনে করছেন সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন সেখানে চরের মানুষ অনেকটাই উপেক্ষিত বা দৃশ্যমান নয়। যেখানে চরের কৃষক, চরের হতদরিদ্রদের সম্পর্কে কিছুই বলা হয়নি। জাতীয় পর্যায়ে চরের মানুষের স্বপক্ষের জোট ‘ন্যাশনাল চর অ্যালায়েন্স’-এর অন্যতম সদস্য মেহরাব উল গণি এবং আসিফ ইমরান খান। এ দুজনই অনেকদিন ধরে নীতি-নির্ধারণী পর্যায়ে চরের মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছেন। মেহরাব উল গণি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংগঠন প্র্যাকটিক্যাল অ্যাকশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, অন্যদিকে আসিফ ইমরান খান সেভ দ্যা চিলড্রেনে কাজ করছেন। এ দুজনই মনে করেন করোনার কারণে দেশে এখন যে অবস্থা চলমান সেখানে অবশ্যই চরের মানুষের দিকে সরকারকে আলাদা নজর দিতেই হবে।
তাঁরা মনে করেন চর এলাকার জন্য নিন্মোক্ত প্রণোদনা প্রস্তাবসমূহ বিবেচনায় নিতে হবে। ১. উইমেন হেডেড হাউজহোল্ডের জন্য ত্রাণ ও মাসিক আর্থিক ভাতা নিশ্চিত করা; ২. বয়স্ক নারী-পুরুষের জন্য নিয়মিতি ভাতা ও চিকিৎসা সহায়তা নিশ্চিত করা; ৩. চরের কৃষক ও কৃষাণী ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ০% সুদে কৃষিঋণ সহায়তা দেওয়া; ৪. চরে উৎপাদিত সকল কৃষিপণ্য বাজারজাতকরণে সরকারের সহায়তা নিশ্চিত করা; ৫. চরের নারী ও শিশুদের খাদ্যসহায়তা প্রদানে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
চরের মানুষের খাদ্য বঞ্চনা মেটাতে এইমুহূর্তে এই উদ্যোগগুলো খুবই জরুরি। নীতি-নির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলবো করোনার এই দুঃসময়ে চরাঞ্চলে বসবাসরত মানুষের দিকে নজর দিন। তাদের জন্যেও প্রণোদনার ব্যবস্থা করুন। তাদের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করা হলে চরে এক ইঞ্চিও জমি পড়ে থাকবে না। কেননা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন আগামীর খাদ্যসংকট মেটাতে আমাদের প্রতিটি ইঞ্চি জায়গা কাজে লাগাতে হবে। চরের মানুষদের সহায়তা দিন, প্রতিটি ইঞ্চি জায়গায় তারা ফসলে ভরে তুলবে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)