বিশ্বকে স্থবির করে দেয়া করোনা ভাইরাসের প্রভাব বাংলাদেশে পড়া শুরু হয়ে গেছে। দেশে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে- এমন সংবাদের পর থেকে মানুষ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।
দর কষাকষি আর ভালোমন্দের বিচার না করেই প্রয়োজনের তুলনায় অতিরিক্ত জিনিসপত্র কিনছেন সবাই। এতে বেচাবিক্রি বেড়েছে ৪ থেকে ৫ গুণ। ফলে কিছু কিছু পণ্যের দাম বেড়ে গেছে।
মঙ্গলবার রাজধানীর বড় পাইকারি পণ্যের বাজার কারওয়ান বাজারসহ পাড়া-মহল্লার কয়েকটি বাজার ঘুরে ও খোঁজ নিয়ে এসব তথ্য জানা গেছে।
কারওয়ান বাজারে গিয়ে দেখা গেছে, কিচেন মার্কেটে মানুষের ঢল নেমেছে। প্রত্যেক দোকানদার বেচাকেনায় ব্যস্ত। সেখানে নেই কোনো দর কষাকষি। দেখার সুযোগ নেই ভালোমন্দের। ক্রেতারা আসছেন আর কিনছেন। যাদের প্রয়োজন এক কেজি তারা কিনছেন ৫/৬ কেজি। প্রায় সব ধরের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্ষেত্রেই দেখা গেছে বেচাকেনার এই চিত্র।
কাঁঠালবাগান ও হাতিরপুলসহ কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিপত্রের দোকানেও খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গতকাল (সোমবার) রাত থেকেই মানুষ জিনিসপত্র কেনা শুরু করেছেন। মঙ্গলবার সকালে বেচাকেনার পরিমাণ বেড়ে গেছে অন্য সময়ের চেয়ে ৫ থেকে ৬ গুণ।
হঠাৎ বেচাকেনা বেড়ে যাওযার বিষয়ে বিক্রেতারা বলছেন: করোনায় বাংলাদেশ মারাত্মকভাবেই আক্রান্ত হবে, এটা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। মানুষের মধ্যে এখন এই আতঙ্ক চরম আকার ধারণ করেছে। সামনে হয়তো বাহিরে চলাফেরায় নিয়ন্ত্রণ আসতে পারে। সেজন্য এক-দেড় মাসের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে মজুদ করে রাখছেন সবাই।
তবে ভোক্তারা বিক্রেতাদের সাথে এই আশঙ্কা প্রকাশের পাশাপাশি অভিযোগও করেছেন। বলছেন: সারাবিশ্বের মতোই করোনায় বাংলাদেশ অচল হয়ে যেতে পারে। ভাইরাস পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়লে হাঁট-বাজারে যাওয়া অনিরাপদ হয়ে পড়বে। তাই কয়েকদিনের জিনিসপত্র অগ্রিম নিয়ে রাখছেন তারা। কিন্তু বেচাবিক্রি বেড়ে যাওয়ায় এই সুযোগকে অন্যায়ভাবে কাজে লাগাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। তারা কিছু কিছু পণ্যের দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন।
এ বিষয়ে এখনই সরকারের মনিটরিং জোরদারের দাবি জানান ভোক্তারা।
তবে সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে জানিয়েছে, দেশে কোনো পণ্যের ঘাটতি নাই। সব ধরনের পণ্য পর্যাপ্ত রয়েছে। ক্রেতাদের অতিরিক্ত চাপেই বিক্রেতারা দাম বাড়াচ্ছে। শিগগিরই দাম নিয়ন্ত্রণে অভিযান চালানো হবে।
বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশি বিক্রি হওয়ার তালিকায় রয়েছে স্যানিটাইজার পণ্য ও কিছুটা আমদানি নির্ভর পণ্য যেমন- মশুর ডাল, চিনি, তেল ইত্যাদি। আর দামও বেড়েছে এসব পণ্যেরই। কেজিপ্রতি ৫ থেকে ৬ টাকা বেড়েছে।
কারওয়ান বাজার কিচেন মার্কেটের রাব্বি ট্রেডার্সের বিক্রয়কর্মী মাকসুদুর রহমান চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: গতকাল রাত থেকেই মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়েছে জিনিসপত্র কেনার জন্য। আজ (মঙ্গলবার) সকাল থেকেই ক্রেতাদের ভিড় ছিল অনেক বেশি। সবাই আসছে আর কিনছে। অন্য সময়ের মতো মূলামুলিও (দর কষাকষি) করছে না তেমন। অন্য দিনের তুলনায় কিনছেনও বেশি। কিন্তু ঠিক কী কারণে কিনছে, তা আমরা বলতে পারছি না। তবে হয়তো সামনে রমজান আসছে। সেজন্য বেশি বেশি কিনছে।
ইউসুফ জেনারেল স্টোরের মালিক ইউসুফ বলেন: মানুষ দুই-তিন মাসের বাজার একসাথে নিয়ে যাচ্ছে। ক্রেতাদের এত বেশি চাপ যে কথা বলার সুযোগ নেই।
তিনি বলেন: স্যানিটারি আইটেম যেমন, হ্যান্ডওয়াশ, সেভলন, ডেটলজাতীয় পণ্যগুলো এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে পরিণত হয়েছে। মানুষ এগুলোই বেশি কিনছে।
কেন এত বেশি জিনিসপত্র এক সাথে কিনছেন এমন প্রশ্নের কিছুটা ব্যাখ্যা করে জবাব দিলে রাজধানীর মনিপুরী পাড়া থেকে কারওয়ান বাজারে বাজার করতে আসা অ্যাডভোকেট কাজী মাকসুদা বেগম।
তিনি চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: করোনা ভাইরাসে কী হবে বা হবে না তা জানি না। তবে এটা ঠিক এই ভাইরাসের আতঙ্ক বাজারে প্রভাব পড়েছে। তাই আমি কিনছি। চাল, ডাল এবং তেল কিনেছি বেশি।
“আমার মনে হয়, সামনে হয়তো দেশের সাথে আন্তর্জাতিক এবং দেশের ভেতরেও সার্বিক কার্যক্রম আরো স্থবির হয়ে পড়তে পারে। তখন পণ্যের সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিতে পারে। এতে দাম বাড়তে পারে। তাই বেশি করে কিনে রাখছি।”
মাকসুদা বেগম বলেন: যেভাবে মানুষ হুমড়ি খেয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনছে, তাতে অচিরেই যে দাম বাড়বে তা অনুমান করা যায়। ইতিমধ্যে চাল-ডাল-তেলে ৬ থেকে ৭ করে করে বেড়ে গেছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে এখনই পণ্যের দামের বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।
আব্দুর রহিম নামের একজন ক্রেতা বলেন: সরকারের উচিত হবে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহের সঠিক চিত্র তুলে ধরে সময়মতো সব ধরনের পদক্ষেপ নিয়ে রাখা। অন্যথায় সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়বে।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন: আমি বলবো ভোক্তাদের কারণেই পণ্যের দাম বাড়ছে। কারণ এত ক্রেতা একসাথে হুমড়ি খেয়ে পড়বেন কেন বাজারে? দেশে তো এখনো এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি যে পণ্যের ঘাটতি দেখা দিতে পারে।
তিনি বলেন: করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে, এটা সত্য। কিন্তু এতে পণ্যের বাজারে প্রভাব পড়ার মত কোনো কারণ নেই। দেশে প্রচুর পরিমাণে পণ্য মজুদ রয়েছে। এমনকি কিছুটা আমদানি নির্ভর যেসব পণ্য সেগুলোও প্রচুর পরিমাণে আমদানি করা হয়েছে। মজুদও রয়েছে। তাই রমজানেও কোন পণ্যের ঘাটতি হবে না। কেউ অতিরিক্ত পণ্য কিনবেন না।
“ভোক্তাদের আতঙ্ক হওয়ার কোনো কারণ নাই। অকারণে কেউ দাম বাড়ালে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব। আমি আজই ভোক্তা অধিদপ্তরকে বলবো বাজারে অভিযান জোরদার করতে।”
নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে নিয়মিত অভিযান করে আসছেন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারি পরিচালক মো: আব্দুল জব্বার মন্ডল।
পণ্যের অতিরিক্ত দাম এবং বাজার মনিটরিংয়ে ভোক্তাদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন: বাজার আমরা নিয়মিত মনিটরিং করছি। এটা চলমান প্রক্রিয়া।
তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।