করোনাকাল: একা হয়ে যাও……
মহাদেব সাহার এই কবিতাটির ব্যাপক সমালোচনা করতাম। অন্য দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। কেনো মানুষে মানুষে ইতরামির কারণে হানহানির কারণে নষ্টামির কারণে একা হয়ে যেতে হবে? একা হবো না আমরা দ্বিগুন হবো প্রতি ফাগুণে। আমরা মানুষে মানুষে মিলনের জয়গান গাইব।সম্মিলিত ভালোবাসায় প্রতিহত করবো এই পৃথিবীর সমস্ত অন্যায় অসাম্য অন্যায্যতা। কিন্তু হায়! এই শতকের শুরুতেই এক প্রাকৃতিক ভাইরাস মোকাবেলায় ব্যর্থ আমরা বলছি এখন -একা হয়ে যাও!
একা হয়ে যাও, নিঃসঙ্গ বৃক্ষের মতো
ঠিক দুঃখমগ্ন অসহায় কয়েদীর মতো
নির্জন নদীর মতো,
তুমি আরো পৃথক বিচ্ছিন্ন হয়ে যাও
স্বাধীন স্বতন্ত্র হয়ে যাও
খণ্ড খণ্ড ইওরোপের মানচিত্রের মতো;
একা হয়ে যাও সব সঙ্গ থেকে, উন্মাদনা থেকে
আকাশের সর্বশেষ উদাস পাখির মতো,
নির্জন নিস্তব্ধ মৌন পাহাড়ের মতো
একা হয়ে যাও।
এতো দূরে যাও যাতে কারো ডাক
না পৌঁছে সেখানে
অথবা তোমার ডাক কেউ শুনতে না পায় কখনো,
সেই জনশূন্য নিঃশব্দ দ্বীপের মতো,
নিজের ছায়ার মতো, পদচিহ্নের মতো,
শূন্যতার মতো একা হয়ে যাও।
একা হয়ে যাও এই দীর্ঘশ্বাসের মতো
একা হয়ে যাও।
দীর্ঘশ্বাসের মত একা হয়ে যাও শব্দটি আজ বড় নির্মম সত্য হয়ে বাজছে এই রুগ্ন ধরনীর মাঝে। খণ্ড খণ্ড ইউরোপের মানচিত্রের মতো একা হয়ে যাও সব সঙ্গ থেকে- প্রায় বিশ বছর পর কবির এই উচ্চারণ যেনো আমাদের বাস্তব জীবনের চিত্র। এই যে সামাজিক দূরত্ব তা কী মানুষে মানুষে আরও বিভেদের দেয়াল তুলে দেবে? আমরা কি মানবজাতি ক্রমশ দূরে যেতে যেতে একেবারে দূরে চলে যাব। পৃথিবী ও আমাদের মাঝখানে লক্ষ আলোকবর্ষ ব্যবধানেও কি ধরনী সুস্থ হয়ে ওঠবে? ধরনীর সুস্থতার জন্য আমাদের আসলে এখন একা হয়ে যাওয়ার দিন।
তবে এই দূরত্ব বলতে এখন আমরা মানুষ থেকে মানুষের দূরত্ব বলছি। বলছি সামাজিক দূরত্ব নয়। কিন্তু হায় অদৃশ্য জীবাণুর আক্রমণ না হলে আমরা জানতামই না আমরা নিজেরা কতোটা সামাজিক দূরত্বে আছি। বিত্ত ব্যবধান না হয় বাদ দিলাম। সমমনাদের দূরত্ব কী আগে ছিল না? ছিল বলেই একটি ভাইরাস মোকাবেলা করতে গিয়ে তারা এখন দেখতে পেলেন তারা যোজন যোজন দূরে। তাদের সমাজ বলে কিছু ছিল না। ফেসবুক নামে নতুন সমাজের বাসিন্দা তারা। যেখানে কেউ কাউকে না দেখলেও চলে। তারা সেখানেই পরস্পর পরস্পরকে দেখে। তবু এত ভয়? মৃত্যুর ভয়। ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ভয়। তারপর আর তারা সম্মিলিত হয়ে প্রতিরোধে নামতে পারে না রোগ শোক জ্বরার বিরুদ্ধে।
শুধু মানবজাতির বিপর্যয়ের সময় নয়, বহু আগে থেকে মানুষ তার অস্তিত্বের বিপন্নতা নিয়ে ভেবেছে। তার নশ্বরতা, তার না থাকা, পৃথিবীতে তার অসহায় আর্তনাদ সমস্ত সৃজনযজ্ঞে প্রতিফলিত হয়েছে। শিল্প সাহিত্য দর্শন সবক্ষেত্রে মানুষ তার অস্তিত্বহীনতার সংকটে ভুগেছে। শুধু মৃত্যু নিয়েই মানবজাতি থেমে থাকেনি। বেঁচেছে নিজেদের আনন্দে। কেবল যুদ্ধ মহামারী সংকটে একটু বিচলিত হয়। তারপর পুনরায় ভুলে যায় তার বিনাশের ভবিষ্যত।
জীবননান্দ দাশ মানুষের সভ্যতা নিয়ে বড়াই করা অহংকে করেছেন তীব্র শ্লেষে বিদ্রুপে আক্রমণ। তার মিতভাষণ কবিতার শেষাংশে বলেছেন-
মানুষের সভ্যতার মর্মে ক্লান্তি আসে;
বড়ো বড়ো নগরীর বুকভরা ব্যথা;
ক্রমেই হারিয়ে ফেলে তারা সব সংকল্প স্বপ্নের
উদ্যমের অমূল্য স্পষ্টতা।
তবুও নদীর মানে স্নিগ্ধ শুশ্রূষার জল, সূর্য মানে আলো
এখনো নারীর মানে তুমি, কত রাধিকা ফুরালো।
এই যে কবিতায় জীবনের জয়গান। সেটাও অস্তিত্ব সংকটের গল্প। এভাবেই মানবজাতি টিকে আছে হাজার বছর ধরে। এইসব ধ্বংসলীলা মানবসভ্যতারই অংশ। মাড়ী ও মড়কের মাঝে মানুষ বাঁচে তার মত করে আমৃত্যু। তবু ভয়হীনতার বা সাহসের প্যারামিটার মাঝে মাঝে একদম নড়বড়ে হয়ে পড়ে। তখন মনে হয় প্রকৃত দুঃসময়।
আবুল হাসানের এই উচ্চারণ এখন মনে হয় সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য-
ইঁদুরের তবু পালাবার পথ রয়েছে গর্ত আমাদের তাও নেই হে ময়ূর … এটাই মনে হয় এখন সবচেয়ে বড় বাস্তবতা মানুষের।
জগতের সকল প্রাণী সুখী হয় না। তবু বলি আমরা -সুখী হোক। কেউ অমর হয় না। তবু বলি- বেঁচে থাকুক মানুষ। তারপর কী বন্ধ হবে মানুষের এই অসভ্য প্রতিযোগিতা? নিজেকে হাস্যকর উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার প্রবল চোটপাট? মানুষ কী এখন সামান্য থামবে? মানুষ কী মানবজাতির জন্য বাঁচবে ? না নিজের জন্য বাঁচবে? পুনরায় মানুষ ফিরে যাবে তার হাস্যকর দেখানোপনার প্রতিযোগিতায়। বিলাসিতার প্রতিযোগিতায়। অথচ এই ধর্মে দুনিয়া চলে।
কবি আবুল হাসান দিয়ে শেষ করছি-
মারী ও বন্যায় যার মৃত্যু হয় হোক। আমি মরি নাই-শোনো
লেবুর কুঞ্জের শস্যে সংগৃহীত লেবুর আত্মার জিভে জিভ রেখে
শিশু যে আস্বাদ আর নারী যে গভীর স্বাদ
সংগোপন শিহরণে পায়-আমি তাই….
কিন্তু এই আবুল হাসানই আবার বলে গেছেন-
অবশেষে জেনেছি মানুষ একা!
জেনেছি মানুষ তার চিবুকের কাছেও ভীষণ অচেনা ও একা !
এটাই মানবজনম। আমি মরি নাই। আমরা মরবো না। অথচ আমরা মরি। আমরা বেঁচে থাকি না। চরম দ্বান্দ্বিকতার নামই হয়ত হোমোস্যাপিয়েন্স। জগত ফিরে পাক তার স্বাভাবিক চঞ্চলতা। হোক সেটা অসভ্য দর্শনের তবু মানুষ বেঁচে থাক।