চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

করোনাকালে “ভিআইপি” আবার কারা?

করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে মৃত্যুর মিছিলে আজ বিধ্বস্ত মানবতা। দেশ-জাতি-ধর্ম-বর্ণ সব মিলে মিশে একাকার। আতঙ্কিত বিশ্ব জনপদ, আতঙ্কিত প্রতিটি হৃদয় । তবুও স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন দেখতে চাই – কায়মনে চাই, বেঁচে থাকার স্বপ্নটা আসলেই অটুট থাকুক। সবার জন্যই থাকুক। সুদীর্ঘ ঘরবন্দী বাস্তবতায় বদলে গেছে অনেকটুকুই। আজকের এই অপরিচিত পৃথিবীতে, অনেক কিছুই এখন আর আগের মত নেই।

মানুষে মানুষে বৈষম্যের পৃথিবীতে বেঁচে থাকার লড়াইটা আমরা আজ সবাই করছি। মহাশক্তির পতন দেখলাম। বেশ অবলীলায় এটা উপলব্ধি করতে পারছি যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন আর বিশ্বের শীর্ষ ক্ষমতাবান দেশের অবস্থানে নেই। করোনা-কান্ডে টালমাটাল হয়ে পড়েছে দেশটি। যদিও বা সামলাতে পারে মৃত্যুসংখ্যা, অর্থনৈতিক মন্দার দুষ্ট চক্র ধেয়ে আসছে অতি দ্রুত গতিতে। বলতে গেলে, ক্ষমতার লড়াইয়ে দেশটির অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নির্ধারিত!

বাংলাদশও কি লড়ছে না? বেঁচে থাকার আকুতি আজ সবারই মাঝে। কেউই নিরাপদে নেই আমরা। মানুষে মানুষে আজ এক কাতারে দাঁড়িয়ে। শুধু “আমি” বাঁচলে হবে না। করোনা আমাদের শিখিয়েছে, “অন্য”কে বাঁচালে আজ “আমি” এবং “আমরা”ও বাঁচবো। তাহলে মানুষে মানুষে ভেদাভেদ ভুলে বেঁচে থাকার লড়াইটা এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে, নগরে আগুন লাগলে দেবালয়ও রক্ষা পায়না, ঘর পুড়লে উঠানও তপ্ত হয়।

কিন্তু এরই মাঝে, স্বাস্থ্য অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. আবু ইউসুফ ফকির গতকাল (২১ এপ্রিল ২০২০) জানান যে, বাংলাদেশে কোনো “ভিআইপি” যদি নভেল করোনাভাইরাসে (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হয় তবে তাদের চিকিৎসার জন্য আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা রাখা হচ্ছে। নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) সুবিধা আছে, এমন হাসপাতালেই তাদের চিকিৎসা করানো হবে।

ডা. আবু ইউসুফ ফকির আরও অবহিত করেন, বাংলাদেশে কোভিড-১৯ আক্রান্ত “ভিআইপি”দের চিকিৎসার জন্য শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালকে প্রস্তুত করা হচ্ছে। এছাড়া রাজধানীর অ্যাপোলো হাসপাতালেও চিকিৎসা দেওয়ার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আলোচনা চলছে। তাঁর তথ্য অনুসারে মন্ত্রী, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন “ভিআইপি”দের চিকিৎসা অ্যাপোলো হাসপাতালে দেওয়ার জন্য কথাবার্তা চলছে।

আমি স্তম্ভিত হয়ে গেছি এটুকু জেনেই যে নীতি-নির্ধারনী মহলে এধরণের চিন্তা-চেতনা বা আলাপ-আলোচনা চলছে! করোনা আক্রান্ত সাধারণ নাগরিক অর্থাৎ “এনআইপি” (নট ইম্পরট্যান্ট পারসন) দের মানসম্পন্ন চিকিৎসা সেবা দিতে আমরা নিজেদের ব্যর্থতা ইতিমধ্যেই নির্লজ্জের মত প্রমাণ করেছি। দোষ কার তা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক করতে চাইনা। আর এটা তর্ক-বিতর্কের সময়ও না। আমরা সেই বীর জাতি, যারা যা কিছু আছে তা নিয়ে ঝাঁপিয়ে বিপদ মোকাবিলা করতে জানি, শিখেছি এবং করে দেখিয়েছি। আমরা জাতির পিতার সন্তান। কিন্তু করোনার এই ক্রান্তি লগ্নে যেখানে কোন কিছুই নিশ্চিত না; কে বাঁচবো, কে মরবো তার কোন নিশ্চয়তা নেই; সেখানে আমরা শ্রেণী বৈষম্যের বাটখারা নিয়ে বসেছি? একজন সাধারণ মানুষের জীবনের কি কোনই মূল্য নেই এই দেশে? আমরা কি তবে “বিকিয়ে যাই মরীচীকার দামে?”

আমরা জানি, যেসব ব্যক্তি অবস্থান, দায়িত্ব ও মর্যাদার দিক দিয়ে বিশেষ গুরুত্ব বহন করেন এবং যাদের নিরাপত্তাহানি হলে দেশ ও জাতি গভীর সংকটে পতিত হয় তাদের “ভিভিআইপি” এবং “ভিআইপি” বলা হয়। রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা হলেন “ভিভিআইপি” (ভেরি ভেরি ইম্পর্টেন্ট পার্সন)৷ এর পরের ধাপের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের বলা হয় “ভিআইপি” (ভেরি ইম্পর্টেন্ট পার্সন)৷

প্রশাসনের কাছে একটি রেডবুক আছে। রেডবুক অনুযায়ী “ভিভিআইপি” হলেন রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী। আর “ভিআইপি” হলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার, মন্ত্রী পরিষদের সদস্য (মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী), সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট দুই বিভাগের বিচারপতি, সংসদ সদস্য, সচিব (অথবা সচিব পদ মর্যাদা সম্পন্ন), সিনিয়র সচিব (অথবা সিনিয়র সচিব পদ মর্যাদা সম্পন্ন), তিন বাহিনী প্রধান ও পুলিশের প্রধান। তবে সরকার প্রয়োজন অনুয়ায়ী অন্য যে কাউকে “ভিআইপি” মর্যাদা দিতে পারেন।

এই যে “ভিআইপি” চিহ্নিতকরণ তা হচ্ছে তাঁদের কাজের সুবিধার্থে, দেশের নাগরিকদের প্রতি দ্বায়িত্ব পালনে যেন তাঁরা অযথা বাধা-বিঘ্নের সন্মুখীন না হন বা নিরাপত্তাহীনতার সন্মুখীন না হন এই কারণে। কিন্তু করোনার এই কালবেলায়, নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে আমার দেশের ১৭ কোটি মানুষ। একজন রোগীও যতক্ষণ করোনা আক্রান্ত থেকে যাচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের “ভিআইপি”-রা কিন্তু কেউই নিরাপদ নন, স্বাস্থ্য ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। তাহলে শুধু “ভিআইপি”-দের শ্রেনীভেদ করে আলাদা হাসপাতালের ব্যবস্থা করার মানে কি?

জীবনের মৌলিক চাহিদা তো সবারই একই রকম। সেখানে আবার ভিআইপি আর এনআইপি কি? আমাদের সংবিধানের ১৫(ক) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দ্বায়িত্ব হলো, তার প্রতিটি নাগরিকের জন্য অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা। এক্ষেত্রে শ্রেণী বৈষম্য করা আসলে কতটা যৌক্তিক? আমাদের সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে অনুযায়ী, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। আমি মনে করি, জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে যখন কোন রাষ্ট্র নিষ্ঠুর বৈষম্য সৃষ্টি করে, তখন সেটা “মানবতার সংকট” ছাড়া আর কি-ই বা হতে পারে?

তবে হ্যাঁ, আজকের মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যেসব করোনা-যোদ্ধা রয়েছেন, চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা, শুধু তাঁদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করার পক্ষপাতি আমি। যেসব চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের সুরক্ষার জন্য আমাদের কৌশলী হতেই হবে। ডাক্তার মইন উদ্দিনের মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আমরা করোনা-যুদ্ধে হারিয়েছি আমাদের সন্মুখ সমরের এক সৈন্যকে। আমাদের এরকম আরো বহু সৈন্য কি ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা সেবা দান করে যাচ্ছে তা জানলে এক একটা উপাখ্যান লেখা যাবে। তাদের সুরক্ষার জন্য আসলে আমাদের পরিকল্পনা কি?

আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে যেসব চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্যকর্মীরা করোনার বিরুদ্ধে লড়ছেন, তাদের জন্য টাটা গ্রুপ অব কোম্পানী তাদের বিলাসবহুল তাজমহল প্যালেস সহ মোট সাতটি হোটেলের ২৩০৫টি রুম খুলে দিয়েছে। আমাদের কি এমন কোন পরিকল্পনা আছে? পিপিই আর মাস্ক নিয়ে যা কেলেঙ্কারী আর কূটঘাতের শিকার হলাম আমরা, তার বিচার একদিন আমরা করবো ঠিকই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর পূর্ণ আস্থা আছে। গুটিকয়েক ক্ষমতার অপব্যবহারকারী অমানুষদের আমরা ছাড় দিব না। কিন্তু শেষতক বাঁচতে তো হবে সবাইকে, তাই না?

আর বাঁচার লড়াইটা যদি শুধু “ভিআইপি” কেন্দ্রিক হয় তাহলে তো ভীষণ মুশকিল। লখিন্দরের বাসরঘরে করোনার মত মহাদানবের ঢোকার জন্য ছিদ্রের প্রয়োজন নেই। সবাইকে নিয়ে বাঁচার ব্যবস্থা না করলে, করোনা মহাদানব ভেঙ্গে-চুড়ে দুমড়ে-মুচড়ে সব শেষ করে দিবে। কেউ বাঁচতে পারবো না আমরা তখন। কোথায় যাবে “ভিআইপি”, আর কোথায় যাবে “এনআইপি”। অতএব, এই সব “ভিআইপি”-কেন্দ্রিক সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা-ভাবনা থেকে সরে আসতে হবে।

আমাদের সংবিধানের প্রস্তাবনায় বলা আছে –

“আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে;”

সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করাই যদি আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ঘাড় থেকে সিন্দাবাদের ভূতের মত সাম্রাজ্যবাদের ভূতকেও নামিয়ে ফেলুন। করোনা চিকিৎসায় “ভিআইপি” তোষণ বন্ধ করুন।

(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)