মহামারী কোভিড-১৯’র সংকটময় সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেমিট্যান্স আয় যেখানে কমছে সেখানে বাংলাদেশে এই আয়ে হচ্ছে একের পর এক রেকর্ড। চলতি নভেম্বরের ১৫ দিনেই রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১২২ কোটি ডলার। যা দেশের ইতিহাসে রেকর্ড রেমিট্যান্স আহরণ।
রেমিট্যান্স আহরণের এই রেকর্ডকে অর্থনীতিবিদরা ইতিবাচক মনে করলেও পাশাপাশি এর সঠিক হিসাব নিয়ে তাদের কিছু সন্দেহ রয়েছে। তবে সন্দেহ থাকলেও এই রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে ধীরে ধীরে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, চলতি নভেম্বর মাসের ১৫ দিনেই ১২১ লাখ ৬০ কোটি ডলার রেমিটেন্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। এর আগে দুই সপ্তাহে এত বেশি রেমিটেন্স কখনই আসেনি।
এই রেমিট্যান্স আয়ে ভর করে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরের সাড়ে ৪ মাসেই (১ জুলাই থেকে ১৫ নভেম্বর) ১ হাজার ৪ কোটি ১৬ লাখ (১০ দশমিক ৪ বিলিয়ন) ডলার রেমিটেন্স এসেছে। যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে প্রায় ৩ বিলিয়ন ডলার বা ৪২ শতাংশ বেশি। গত বছরের এই সাড়ে ৪ মাসে রেমিট্যান্স এসেছিল ৭০৭ কোটি ৩০ লাখ ডলার। অর্থাৎ দেশের ইতিহাসে সাড়ে ৪ মাসে এত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আর কখনই আসেনি।
গত ২০১৯-২০ অর্থবছরের পুরো সময়ে রেমিটেন্স এসেছিল ১৮ দশমিক ২০ বিলিয়ন ডলার। এ হিসাবে গত অর্থবছরের ৫৫ দশমিক ১৬ শতাংশ রেমিটেন্স এসেছে এই সাড়ে ৪ মাসেই।
কিভাবে এত বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে? দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব কতটুকু? এসব বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইন জানতে চেয়েছে কয়েকজন শীর্ষ অর্থনীতিবিদের কাছে।
তারা বলছেন, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে করোনার কারণে প্রবাসী শ্রমিকেরা তাদের জমানো অর্থ সঙ্গে না রেখে দেশে স্বজনদের জন্য পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এ কারণে প্রবাসী আয়ে রেকর্ড হচ্ছে।
রেমিট্যান্স শক্তিশালী হলে রিজার্ভ বাড়ে। আর তাতে অর্থনীতি অবশ্যই শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়ায় বলে মনে করেন তারা।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর এ বিষয়ে চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, বর্তমানে এজেন্ট ব্যাংকিং ও মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সরাসরি টাকা পাঠানো যায়। এছাড়া ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠালে অতিরিক্ত ২ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পাওয়া যায়। এসব কারণে সরকারের খাতায় আয় বাড়ছে। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে খুব বাড়েনি। কারণ যারা আগে হুন্ডিতে পাঠাতো তারা এখন ব্যাংকে পাঠায়। আগে হয়তো সরকারে হিসাবে যোগ হতো না, এখন হয়। এটুকুই পার্থক্য।
তিনি আরও বলেন, এটাও হতে পারে যে, করোনা ও বন্যার কারণে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে আত্মীয়-স্বজনদের নিরাপদ রাখতে জমানো সব অর্থই পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া পৃথিবীর অনেক দেশেই ব্যাংকে সুদের হার কমে গেছে। কোনো দেশে সুদ হার শুন্য, কোনো দেশে নেগেটিভ। কিন্তু তুলনামূলক এখনো বাংলাদেশে বেশি। তাই অনেকেই বিদেশে না রেখে দেশে পাঠাচ্ছেন। বিনিয়োগ করছেন।
এসব কারণে রেমিট্যান্স বাড়ছে বলে মনে করার পাশাপাশি রেমিট্যান্সের রেকর্ড নিয়ে তার সন্দেহ রয়েছে বলে জানান তিনি।
এ বিষয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, করোনার কারণে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক বিভিন্ন দেশ থেকে চলে এসেছেন। তাদের সিংহভাগ শ্রমিকই আর গন্তব্যস্থলে অর্থাৎ কর্মস্থলে ফিরে যেতে পারেননি। তবুও কেন রেমিট্যান্স আহরণে একের পর এক রেকর্ড হচ্ছে, তা আমার বোধগম্য নয়। এছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রেমিট্যান্স কমছে। কিন্তু বাংলাদেশে বাড়ছে, এই বৃদ্ধি ইতিবাচক। কিন্তু এখানে কোনো গড়মিল আছে কি না, জানি না। কারণ বিদেশে এখন শ্রমিক কম যাচ্ছে। বরং ফিরছেন বেশি। তবে রেমিট্যান্স বাড়লে অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। কিন্তু এই রেমিট্যান্স তাতে কতটা ভূমিকা রাখছে তা এই মূহুর্তে অনুমান করা যাচ্ছে না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, অন্য কোনো কারণ নাই। প্রবাসীদের যারা চলে আসছে তাদের কিছু টাকা জমানো ছিল। সেসব নিয়েই তারা চলে আসছেন। বা পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এছাড়া আগে মানুষ হুন্ডিতে পাঠাতো। এখন নগদ প্রণোদনা পাওয়ার আসায় ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠায়। তাই প্রবাসী আয় বাড়ছে।
তিনি বলেন, রেমিট্যান্স রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মূলত পণ্য রপ্তানি নয় জনশক্তি রপ্তানি ভাল হওয়ায় রিজার্ভ বাড়ছে। সর্বোপরি এই রেমিট্যান্স ও রিজার্ভ দেশের অর্থনীতিকে একটি শক্তিশালী ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। অর্থনীতি চাঙা হচ্ছে।
রেমিট্যান্সে সরকারের নগদ প্রণোদনার উদ্যোগই সবচেয়ে সফল বলে মনে করেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক গবেষণা পরিচালক ও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখ্ত।
ড. জায়েদ বলেন, রেমিট্যান্স শক্তিশালী হলে রিজার্ভ বাড়ে। অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ে। লেনদেনে গতি থাকে। এতে অর্থনীতির চাকা সচল থাকে। অতএব এই প্রবাসী আয় অর্থনীতিকে শক্তিশালি করে তুলছে। এতে সন্দেহ নেই।
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবমতে রিজার্ভ বর্তমানে চার হাজার কোটি ডলারের বেশি। বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় তিন লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকার কাছাকাছি (প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ধরে)।