লোপার মেয়ের বয়স ১৩। এ বছর রমজানে সে প্রথম রোজা রাখছে। তাকে নিয়ে পরিবারের সবাই উদগ্রীব। বাচ্চা মানুষ রোজা রাখছে। তার কতই না কষ্ট হচ্ছে! লোপা ইফতারের জন্য মেয়ের পছন্দের খাবারগুলোই বানানোর চেষ্টা করে। রান্না-বান্নার সময়ে লোপা অবচেতনে নিজের কৈশরে চলে যায়।
লোপা যখন রোজা রাখা শুরু করে তখন তারও বয়স এমনই, ১২ বা ১৩ বছর। যে বছর সে রোজা রাখে, সে বছরও প্রচণ্ড খরা ছিল। তখনও এই মে বা জুন মাস। লোপার মনে আছে, দুপুরের পর আর সে নড়তে পারছিল না।
মা বারান্দায় মাদুর পেতে দিয়েছিলেন। লোপা সেখানে বিকেল পর্যন্ত শুয়ে থেকেছে। ইফতারির প্রস্তুতির সময় মা এসে এসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করে গেছে। মফস্বল শহরের বাড়িতে লোপাদের বাসায় তখন বৈদ্যুতিক পাখা ছিল না। মা যে সময়টুকু বাতাস করতে পারেননি, বাবাকে পাখা হাতে বাতাস করতে বসিয়ে রেখেছিলেন।
এসব স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে লোপার সম্বিত ফিরে আসে। মফস্বল শহরে মা এখন একা। মায়ের জন্য লোপার বড্ড মন কেমন করে। মন ছুটে যায় মায়ের কাছে। কিন্তু ছুটে যাবার সুযোগ নেই।
সারা বিশ্বের মানুষই তো একেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের বাসিন্দা এখন! কেউ কারো সামনে যেতেও সঙ্কোচ করছে। কাছে গেলে, একটু ছুঁয়ে দিলেই বুঝি করোনাভাইরাস ধরে ফেললো! বা আমিই হয়তো কাউকে করোনায় সংক্রমিত করে ফেললাম! এত দ্বিধা সংকোচ নিয়ে মানুষ কতদিন সুস্থভাবে বাঁচতে পারে?
লোপার মন এতোকিছু বুঝতে চায় না। তার মার কাছে যেতে মন চায়। মা যেভাবে সেই প্রথম রোজার সময় আদর, স্নেহ-যত্ন দিয়ে কষ্ট ভুলিয়ে দিতে চেয়েছে লোপারও এখন মাকে সেভাবে যত্ন করতে ইচ্ছা করছে। মাকে তার পছন্দের খাবারটি রেঁধে খাওয়াতে ইচ্ছা করছে খুব। কবে তা পারবে লোপা?
তানিম বৌ-বাচ্চা নিয়ে চট্টগ্রাম থাকে। পেশায় সে একজন ডাক্তার। করোনা মহামারীতে দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত তানিম। গত ৫ দিন ধরে সে নিজের বাসাতেই আইসোলেশনে আছে।
তানিমের জটিল কোনো উপসর্গ নেই। কেবল জ্বর। তাও ছেড়ে গেছে। ১৪ দিন পার করাই কষ্টের। তানিমের মা তার বড় ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকেন।
তানিমের করোনা সংক্রমণের খবর পেয়ে মা জায়নামাজে বসেছেন। রোজার মধ্যে মায়ের খাওয়া-দাওয়া নামমাত্র। তিনি প্রতিদিন অসংখ্যবার ফোন করে, ভিডিও কল দিয়ে তানিমের আপডেট নিচ্ছেন আর ছটফট করছেন। অসুস্থতার সময়ে ছেলেকে একটু সেবাও করতে পারছেন না।
মা বার বার মনে করছেন তার সন্তানদের শৈশবের কথা। তাদের যে কোনো অসুুস্থতায় এক হাতে সেবা করেছেন। কাউকে সন্তানের কাছে ভিড়তে দেননি। এই করোনা কী এমন ভাইরাস যে নিজের সন্তানের শুশ্রুষা করারও সুযোগটাও পাবেন না!
কোনো বাধাই মানতে চান না তানিমের মা। চট্টগ্রাম যেতে চান। বড় সন্তান যেতে দিবে না মায়ের বয়সের কথা বিবেচনা করে। মায়ের অ্যাজমা আছে। আর যেতে চাইলেও যাবেন কীসে? সব গণপরিবহন বন্ধ!
আজকে মা দিবসে তানিম মাকে খুব বেশি মিস করছেন। কারণ করোনাভাইরাস যদি আগ্রাসী হয়ে ওঠে! আর যদি মায়ের মুখটা ছুঁয়ে দেখার সুযোগ না হয়! নিজের অজান্তে তানিমের চোখ ঝাপসা হয়ে ওঠে!
এক সেকেন্ডের কম সময়ে তানিম নিজেকে সামলে নেয়। চোয়াল শক্ত করে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করে, করোনাকে পাত্তা দেয়া যাবে না।
দরজার ওপাশে তিন বছর বয়সী মেয়ে আছে। দিনের মধ্যে হাজারবার তানিমের দরজার ওপাশ থেকে ফিরে যাচ্ছে। ওপাশে আছে প্রিয়তমা স্ত্রী। দূর শহরে অপেক্ষায় আছেন মা। মায়ের অপেক্ষার অবসান ঘটাতেই হবে।
অন্য বছরের মতো এবারও সামাজিক মাধ্যম ভেসে যাচ্ছে মা-সন্তানের ছবি দিয়ে। তানিম নিজের মোবাইল ঘেঁটে মায়ের ছবি শেয়ার করলো। সবার ছবি দেখছে খুব মন দিয়ে।
তানিম ভাবতে থাকে, মা দিবস উদযাপন এ তল্লাটের চর্চা না। এসেছে পাশ্চাত্য থেকে। পাশ্চাত্যের বৃদ্ধাশ্রমে মায়েরা এ দিবসটির জন্য উদগ্রীব থাকেন। অন্তত এ দিনটিতে তার বাছা সাক্ষাৎ করতে আসবে। এ বছর সেই মায়েদের কেমন কাটছে?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)