বাংলাভাষার অন্যতম প্রধান কবি’ প্রয়াত শামসুর রাহমান শুধু কবিতা নয়, গীত রচনার ক্ষেত্রেও নিজের অনন্য প্রতিভার সাক্ষর রাখেন। তবে তার লেখা গান নিয়ে খুব একটা গবেষণা হয়েছে বলে মনে হয়নি। অগ্রসর কবি শামসুর রাহমান খুব বেশি গান রচনা করেননি সত্য, তবে যতগুলো গান রচনা করেছেন সেখানে রোমান্টিকতা এবং প্রবল দেশপ্রেম পরিস্ফুটিত হয়েছে। অবশ্য তার রচিত বেশিরভাগ গানই দেশাত্ববোধক, দেশপ্রেমকেই তিনি আপন মহিমায় তুলে ধরেছেন।
সবমিলিয়ে একশ’রও বেশি গান তিনি রচনা করেছেন এমন তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সেই ষাট ও সত্তর দশক থেকে রেডিও, টেলিভিশনের জন্য তিনি গান লেখা শুরু করেন। এমন কী কিছু সিনেমার জন্যও তিনি গান রচনা করেন। তবে তিনি যতগুলো গান লিখেছেন তার বেশিরভাগই যৌবনেই। পরের দিকে তিনি গান লেখায় সেভাবে আর উৎসাহিত হননি। তবে স্বাধীনতার পর তার লেখা কয়েকটি দেশাত্ববোধক গান বাংলা গানের ভুবনকে ভীষণ সমৃদ্ধ করেছে। তার গান কণ্ঠশিল্পী মাহমুদুন নবী থেকে শুরু করে জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী রুনা লায়লা পর্যন্ত গেয়েছেন। আবার তার গানে সুর করেছেন দেশের স্বনামধন্য সব সুরকার। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন-প্রয়াত সুরকার আব্দুল আহাদ, সত্য সাহা এবং সৃজনশীল সুরকার বলে খ্যাত খোন্দকার নুরুল আলমের মতো সঙ্গীত ব্যক্তিত্ব। উল্লেখিত তিন সুরকারই প্রয়াত হয়েছেন।
শেষদিকে কবি শামসুর রাহমানের লেখা বেশিরভাগ গানের সুর করেছেন খন্দকার নুরুল আলম। জানা যায়, কবি যৌবনে সুরকার নুরুল আলমের অনুরোধেই মূলত গান রচনায় উৎসাহিত হন। ব্যক্তিগত জীবনে সুরকার খোন্দকার নুরুল আলমকে তিনি দারুণ পছন্দও করতেন। কয়েক বছর হলো সুরকার খোন্দকার নুরুল আলম প্রয়াত হয়েছেন।
কবি শামসুর রাহমানের লেখা দেশাত্ববোধক গানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানটি হলো- স্মৃতি ঝলমল সবুজ মাঠের কাছে, আমার অনেক ঋণ আছে…। জনপ্রিয় গায়িকা রুনা লায়লা এই গানটিতে কণ্ঠ দেন। শামসুর রাহমান ৭৮ সালের দিকে এই গানটি রচনা করে সুরকার খন্দকার নুরুল আলমকে দেন। মাতৃভূমিকেন্দ্রীক এই গানটি দারুণ কাব্যময়তায় পরিপূর্ণ। খন্দকার নুরুল আলম এই গানটিতে এতোটা যত্নে সুর তুলে দেন যে রুনা লায়লা গানের কথাগুলো একেবারে হাওয়ায় ভাসিয়ে দিয়ে গানটির অমরত্ব দান করেন। আর এ কারণেই গানটি বাজলেই আমাদের হৃদয় আপনাআপনিই এই গানটির সাথে মিশে একাকার হয়ে যায়। সন্দেহ নেই আমাদের দেশে এ যাবৎকাল যত দেশপ্রেমমূলক গান রচিত হয়েছে তার মধ্যে এটিও অন্যতম সেরা একটি গান। এই গানটি ছাড়াও কবি শামসুর রাহমানের লেখা- ফসলের মাঠে মেঘনার তীরে, ধূ ধূ বালুচরে তুমি-আমি লিখি প্রাণের বর্ণমালা-এটিও একটি অসাধারণ দেশপ্রেমের গান। এই গানটিতেও কণ্ঠ দেন প্রখ্যাত শিল্পী রুনা লায়লা।
এসব গানের বাইরে তার লেখা অপরাপর দেশাত্ববোধক গান হলো- এ দেশ আমার, জননী আমাকে দিয়েছ অন্ন জল, শ্যামল কোমল শান্ত ছায়ায়, তোমরা ঘুমাও আমি জেগে থাকব, এ দেশ আমার চোখের আলোয়, আলো ছড়াও ভালোবেসে, যখন আকাশে পায়রা উড়ে, এ স্মৃতিসৌধে শিশির ঝরে, নদীটির কাছে নদী এসে বলে গল্প শোনায় বলো, আমার সবাই একাত্তরের শহীদের সন্তান, আগুনের অক্ষরে লেখা নাম নজরুল, অঙ্গে আমার কী মধুর বাজে অনাদিকালের হাসি, কৃষ্ণচূঁড়ার হাসি আমার প্রিয়, অনেকদিনের মতো এ গান-ইত্যাদি। এসবগুলো গানেরই সুরকার হলেন খোন্দকার নুরুল আলম।
শামসুর রাহমানের লেখা আধুনিক গানের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেযোগ্য হলো-প্রয়াত সুরকার সত্য সাহার সুরে রফিকুল আলমের কণ্ঠে- কখনও আমার মাকে গাইতে শুনিনি কোনো গান। আসলে এটি কবিতাই। সুরকার সত্য সাহা চমৎকার সুরারোপ করে এই গানটি মানুষের হৃদয়ের কাছে নিয়ে যান সত্তর দশকে। তবে ষাট দশকে তার লেখা ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠে গাওয়া-মধুময় পৃথিবীকে নীল আকাশ ডাকবেই, সাগরের পরিচয় ফের মনে রাখবেই- এই গানটি শুনলে মন জুড়িয়ে যায়। কণ্ঠশিল্পী ফেরদৌসী রহমান তার আরো একটি উল্লেযোগ্য গান গেয়েছেন সেটি হলো-তুমি কে এমন বুঝিনাতো। এসবের বাইরে তিনি বেশ কয়েকটি সিনেমার জন্যেও গান লিখেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সিনেমা হলো- মাটির পাহাড়। পরিচালক মহিউদ্দিন পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৫৯ সালে। এর পরে তিনি আরো গান লেখেন-এইতো জীবন, বাঁধন হারা, রাজবাড়িসহ আরো বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে। কবি শামসুর রাহমানের লেখা গানের মাঝে খুঁজে পাওয়া যায় তার ব্যক্তিসত্তা আর চিন্তাভাবনার প্রকাশ।
কবি শামসুর রাহমানের লেখা গান সম্পর্কে বছর চারেক আগে কথা বলি সুরকার খোন্দকার নুরুল আলমের সাথে। সেসময় স্মৃতিচারণে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও গুণী সুরকার খন্দকার নুরুল আলম বলেছিলেন, ৫৬ সালের দিকে তিনি যখন জগন্নাথ কলেজে পড়তেন তখন তিনি নিজেও টুকটাক কবিতা লিখতেন। একসময় কবি শামসুর রাহমানের সাথে দেখা করে নিজের লেখা কবিতাগুলো তাকে দেখানোর প্রবল ইচ্ছে জাগে। এই ধারাবাহিকতায় বন্ধু ইকবাল আহমেদ (যিনি পরবর্তীতে ভয়েস অফ আমেরিকাতে খবর পড়তেন)-এর বড় ভাই মুশতাক আহমেদ (যিনি ছিলেন শামসুর রাহমানের ঘনিষ্ট বন্ধু)-এর সহযোগিতায় একদিন শামসুর রাহমানের সাথে তার দেখা হয় এবং নিজের কবিতাগুলো কবিকে একটু দেখার অনুরোধ জানান। কবি শামসুর রাহমান তার কবিতা পড়ে দেখেন। ঐসময় তিনি শামসুর রাহমানকে গান লিখতে অনুরোধ করেন। এর মধ্যে খন্দকার নূরুল আলম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে যোগাযোগ খানিকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু ৫৮ সালের দিকে শামসুর রাহমান কিছু গান লিখে ভয়েস অফ আমেরিকাতে পাঠালে ঐ গানগুলো সুর করার জন্যে পাঠান খন্দকার নুরুল আলমের কাছে। ফলে দুজনের মধ্যে একটা ভালো নৈকট্য তৈরি হয়। এরপর একাত্তর পরবর্তী সময়ে খোন্দকার নুরুল আলম নিয়মিত দৈনিক বাংলা পত্রিকাতে যেতেন এবং সবসময়ই কবি শামসুর রাহমানকে গান লিখতে তাড়া করতেন এবং সবমিলিয়ে দুজনের মধ্যে কথা ও সুরের একটা বন্ধন গড়ে উঠে।
শামসুর রাহমানের প্রতিটি গানেই উচ্চারিত হয়েছে, ভাষা-স্বাধীনতা এবং দেশপ্রেমের কথা। প্রতিটি গানেই দেশের প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা, মমত্ববোধ ফুটে উঠেছে। তার গানে গ্রামবাংলার বহুমাত্রিক প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। গানগুলো নিরবিচ্ছিন্নভাবে বাংলার কথাগুলো বলে যায়।
কবি শামসুর রাহমান গান কম লিখলেও যা লিখেছেন তার ঐতিহাসিক মূল্য অনেক। কিন্তু অনেকের কাছেই শামসুর রাহমানের গান এখনও অজানা অধ্যায়ই। আসলে তার গান তার কাব্যসমগ্রের কাছে কিছুই নয়। তারপরেও যে গানগুলো তিনি রচনা করে গেছেন সেগুলো বেশ সমৃদ্ধ করেছে বাংলা গানের জগতকে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)