একান্তই কবি তিনি। চালচলনে পোশাকে আশাকে পুরোদস্তুর কবি তিনি। একজন শিশুও জানে ঐ যে কবি হেঁটে যায়। এখন ঋষিতুল্য তিনি। দীর্ঘদেহ। ঝাঁকড়া এক মাথা পক্ককেশ। শ্মশ্রুমতি চেহারা। পুরো ফ্রেমের চশমা। খুব বলিষ্ঠ চালচলন।
পরোয়াহীন। ভ্রুক্ষেপহীন এক ব্যক্তি। দেশের আপামর জনগণের কাছে কবি তিনি। বাংলা ভাষাভাষীদের অতিপ্রিয় কবি। তার কবিতার পঙক্তি মানুষের মুখে মুখে। জনপ্রিয় কবিও। খুব সাধারণ জীবন যাপন। কোনো আড়ম্বর কোনো ভড়ং নাই। নিরেট কাদামাটি কবিতামগ্ন জীবন তার।
আমরা প্রত্যেকেই বড় হয়েছি কবির কবিতা পড়ে। কবিও সম্পন্ন হয়েছেন। সাথে আমরাও। বাংলাদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু বিষয়ে তিনি আপোষহীন। সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বারবার। তাতে আর আক্ষেপ নেই।
তার জীবনের ব্যয় অতি কম। ইদানিং নেত্রকোণায় নিজ বাড়িতে সাংস্কৃতিক বলয় তৈরি করেছেন। পাঠাগার তৈরি করেছেন। নিজের অর্জিত টাকায়।
আমাদের সাথে তার অনেক স্মৃতি। কোনটা রেখে কোনটা বলি। সেই ছোটবেলায় তাকে দেখেছি। ১৯৭৬ সালে আমাদের পিতৃব্য কবি হাবীবুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। ঢাকায় দৈনিক আজাদে ষাটদশকে পিতৃব্য এই কবির প্রথমদিককার কবিতাগুলো ছেপে দিতেন। কবি এই বিষয় নিয়ে বিস্তারিত লিখেছেন ‘আমার কণ্ঠস্বর’ নামক তার বিখ্যাত স্মৃতিগ্রন্থে।
চাচার বাসা লালমাটিয়ায় কবি গেছেন অগ্রজ কবি হাবীবুর রহমানকে শেষবারের মতো দেখতে। লালমাটিয়ার ‘ই’ ব্লকের রাস্তা দীর্ঘদেহী কবি হেঁটে যাচ্ছেন। আমি তখন বালক। আমার চোখে সেই দৃশ্যটি এখনো উজ্জ্বল হয়ে আছে।
পরে আমি টুকটাক ছড়া লেখা শুরু করি। সেই সূত্রে আমাকে স্কুলের বড় ভাই ছড়াকার আহমাদ উল্লাহ আমাকে নিয়ে গেলেন শিখা সাহিত্য সংসদের এক সভায়। এই প্রথম আমার জীবনে কোনো সাহিত্য সভায় উপস্থিত হয়েছি। নাজমুল হাসান বা মঈনুদ্দীন খালেদ, আনা ইসলাম, নীরা লাহিড়ী, মনজুরুর রহমান প্রমুখ নিয়মিত ছিলেন।
লেখা পাঠ হতো। তারপর লেখা নিয়ে আলোচনা। বর্ধমান হাউসের সিঁড়িঘরের বারান্দায় এই সাহিত্য সভা চলতো। সেখানে মাঝে মাঝে আসতেন কবি। তার সঙ্গে খুব বন্ধুত্ব নীরা লাহিড়ী দুজনে একসাথে বেরিয়ে যেতেন। নীরা লাহিড়ী তখন ছোটোদের জন্য গল্প লিখতেন। চিকিৎসা বিদ্যা অধ্যয়ন করেন।
এই কবির একমাত্র কন্যার নাম মৃত্তিকা গুণ। অসম্ভব গুণী ও কৃতী নারী। সে নিজেও কবি ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। অসম্ভব শক্ত-সমর্থ। আর মৃত্তিকার হৃদয়ভরা ভালোবাসা। বাবা কবি নির্মলেন্দু গুণকে তিনি মাতৃময়ী ভালোবাসেন। কিছুদিন আগে গুণদা’ গুরুতর অসুস্থ হয়ে ছিলেন। হৃদযন্ত্রে বড় ধরনের অস্ত্রোপচার। তখন দেখেছি মৃত্তিকা ২৪ ঘণ্টা বাবার পাশে থেকেছে। বাবার আয়ু কামনার জন্য লৌকিক বিশ্বাস নিয়ে ছুটে গেছে মন্দিরে মন্দিরে। যদিও মৃত্তিকা ধর্মীয়ভাবে এসব বিশ্বাস করে না। সে গল্প অন্যত্র বলব।
এখন টুকটাক কিছু স্মৃতি বলে যাই।
জাতীয় কবিতা উৎসবে গুণদাকে নিয়ে লেখা একটি ছড়া পড়লাম গুণদা নির্বিকার। মঞ্চের বাইরে বলতে
জানে না ধুনপুন
নির্মলেন্দু গুণ …
গুণের সঙ্গে যে ধুনপুন মিল হয় সেটা জানতাম না। ছড়াটা ভালো লিখেছো আমীরুল।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের সেমিনার রুমে একবার নির্মলেন্দু গুণের ঘরোয়া কবিতা পাঠ। তখন মাত্র ‘নির্বাচিতা’ বইটা প্রকাশিত হয়েছে। আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ গুণদাকে অসম্ভব ভালোবাসেন। সায়ীদ স্যারের কাছে শুনে শুনে আমরা গুণদার একধরনের ছবি তৈরি করেছিলাম। এমন দৃঢ়চেতা ও সরল হৃদয়ের মানুষ বিরল। সায়ীদ স্যারের অবিরল ভালোবাসা সবসময় অক্ষুণ্ন গুণদার প্রতি।
গুণদা কবিতা পড়ছেন। আমরা মুগ্ধ হৃদয়ে শুনছি। সায়ীদ স্যার দুএকটা মন্তব্য করছেন। বলছেন,
গুণ … ঐ কবিতাটা পড়ো ঐ কবিতাটা শোনাও।
সে এক স্মরণীয় সন্ধ্যা।
একবার গুণদাকে আমন্ত্রণ জানালাম আমাদের মিরপুরের বাসায়। স্নেহভাজন বাদল চৌধুরী গুণদাকে শাহবাগ থেকে তুলে গোলারটেকে হাজির হলো। সেদিন সেই আড্ডায় মধ্যমণি ছিলেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ। কবি রফিক আজাদ ছিলেন। গুণদা আমাদের প্রতি খুব দরদী। দুদিন আগে দিল্লি ফেরত। আসার পথে বাকার্ডি রাম নিয়ে এসেছেন। উপহার হিসাবে সেই রামের বোতল নিয়ে এসেছেন। বোতলটা আর ভাঙা হয়নি। স্মৃতি হিসাবে রাখা আছে আমার সংগ্রহে।
একবার কবি নির্মলেন্দু গুণ এর সান্নিধ্যে ময়মনসিংহে
আয়োজিত এক বইমেলায় গিয়েছিলাম। সময় প্রকাশনের ফরিদ আহমেদ এর উদ্যোগে মাইক্রোবাসে সেই যাত্রা। আমি, নির্মলেন্দু গুণ, লুৎফর রহমান রিটন, আহমাদ মাযহার, ফরিদ আহম্মেদ। আনন্দে হাসি গানে পুরো রাস্তা সরগরম থাকলো। গুণদা কত গল্পই না করলেন। তার পরিবারের …. ভাইদের গল্প। গুণদার বোনদের গল্প। এক বোন থাকেন পশ্চিমবঙ্গে এক বোন থাকেন ময়মনসিংহে। বিকালে অনুষ্ঠান হলো। বইমেলা উদ্বোধন করলেন কবি নির্মলেন্দু গুণ। রাতে গুণদা চলে গেলেন ময়মনসিংহে বোনের বাসায়। আমরা গেলাম সরকার হোটেলে আমাদের বন্ধু সরকার জসীমের পারিবারিক হোটেল।
পরদিন সকালে গুণদার বোনের বাসায় আমাদের প্রাতঃরাশ। গুণদার মায়ের সঙ্গে আলাপ হলো। সম্ভবত গুণদার বাবা প্রথম স্ত্রী বিয়োগের পর দ্বিতীয়বার পরিগ্রহণ করেন। গুণদা’র মায়ের সঙ্গে অনেক আলাপ করলাম।
সেই ময়মনসিংহে যাত্রা নিয়ে গুণদা’ কলাম লিখেছিলেন। সেই কলামে আমাদের সপ্রশংস বাক্যালাপ ছিল।
মৃত্তিকার শাহবাগের ফ্ল্যাটে আমরা পার্টি করছি। মৃত্তিকার সাথে রান্নাবাড়া করছি। আমরা আড্ডা দিচ্ছি। হয়তো গভীর রাত করে গুণদা এলেন। সাথে হুইস্কির বোতল। আমরা খাব। মেয়ের বাসায় অড্ডায় মেতে উঠলেন। একবার মনে আছে, সেই আড্ডায় গুণদা পরিহাস করে বললেন,
তোমাদের স্যার- আমার সায়ীদ ভাই আমার প্রেমিকাকে ছিনতাই করে নিয়ে যায়।
হা । হা । হা।
তারপর বললেন,
আমিও একবার সায়ীদ ভাইয়ের প্রেমিকাকে ছিনতাই করেছিলাম।
মৃত্তিকা খাবার টেবিলে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে তারপর গুণদা বলেন, আমার মেয়েকেও তো সায়ীদ ভাই পটিয়ে ফেলেছে। সায়ীদ ভাইয়ের সঙ্গে তো পারা গেল না।
আমি মৃত্তিকার দিকে তাকালাম। সায়ীদ স্যার মৃত্তিকাকে খুব পছন্দ করেন মৃত্তিকার কবিতা স্যারের পছন্দ। মৃত্তিকাও সায়ীদ স্যার এর স্নেহ আদরের এই উত্তাপ খুব ভালোভাবেই টের পায় বিষয়টা গুণদা খুব সুন্দরভাবে উপভোগ করেন। মৃত্তিকার সঙ্গে আমাদেরও খুব ভালো সম্পর্ক। গুণদা মৃত্তিকাকে একবার বলেছিলেন, আমীরুলকে ওপর থেকে দেখে বোঝা যাবে না। ওর অশ্রাব্য শব্দ ব্যবহারের মধ্যে প্রকৃত পরিচয় টের পাওয়া যায় না। আমীরুল খুব মেধাবী লেখক। প্রচুর পড়াশোনা ও খুব ভালো কবিতা বোঝে।
গুণদা দীর্ঘদিন আজিমপুর এলাকায় ছিলেন। ছোট্ট ঘরে খুব সাধারণভাবে বসবাস করতেন। একা মানুষ। লোভ লালসার উর্ধ্বে এক মানুষ। আমি আর শিল্পী ধ্রুব এষ তখন মাঝে মাঝে দাদার বাসায় যেতাম। দাদা শান বাঁধানো মেঝেতে লম্বা হয়ে শুয়ে আছেন।
খুব গরম। ভেজা গামছা তার বুকে। তিনি কবিতা পাঠ করছেন। দার্শনিক ব্যাখ্যা দিচ্ছে ধ্রুব আর আমি তন্ময় হয়ে শুনছি। দাদার কবিতা পাঠের অসাধারণ নিজস্বতা আছে।
চ্যানেল আইতেও দাদাকে দিয়ে অনেক কবিতা পাঠ রেকর্ডিং করেছি। কবি আসলাম সানী দাদার নিত্য সহচর। সানী ভাই একমাত্র দাদাকে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। দাদা বাঁধনছেঁড়া, স্বাধীনচেতা মানুষ। কেউ তাকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। নিজের ঘোরে নিজের খেয়ালে থাকেন তিনি।
গুণদা খুব অভিমানী। খুব জেদী। খুব একরোখা। অনেক কঠিন কথা তিনি সহজে উপেক্ষা করেন। আবার অনেক সহজ কথায় তীব্র রাগ ও উষ্মা প্রকাশ করেন। কাউকে ভালোবাসলে গভীরভাবে ভালোবাসেন। কাউকে অপছন্দ করলে তার ছায়াও মাড়াবেন না।
আমার ফোন না ধরার অভ্যাস আছে। এ নিয়ে গুণদার অনেক বকা খেয়েছি। কখনও ভয়াবহ অভিশাপ দিয়ে এসএমএস লিখে পাঠিয়েছেন।
গুণদার শিশুহৃদয়। অসম্ভব রসিক তিনি। সারাক্ষণ কৌতুক করছেন। খোঁচা দিচ্ছেন। ব্যঙ্গ করছেন।
তার কবিতা অনেক গভীর কিন্তু আড্ডায় গুণদা অনেক সহজ। শিশুদের মতো দুষ্টুমি করছেন। গল্প বলার ক্ষমতা তার অপরিসীম। অসম্ভব স্মৃতিধর ব্যক্তি কবি নির্মলেন্দু গুণ। সব তার মতো থাকে। নৈমিত্তিক দিনের গল্পও তিনি মনে রাখেন।
খুব ধীরে ধীরে মজা করে তিনি গল্প বলেন। গুণদা প্রচণ্ড ক্রিকেট-ভক্ত। টিভিতে খেলা থাকলে গুণদাকে আর পাওয়া যাবে না। তিনি খেলা দেখবেন।
এক আশ্চর্য মানুষ তিনি। আমরা কবি নির্মলেন্দু গুণের প্রচণ্ড ভক্ত। প্রচণ্ড শ্রদ্ধাশীল। দাদা কি তা জানে?