চ্যানেল আই অনলাইন
হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রবাসেও বাংলাদেশ
Channelionline.nagad-15.03.24

কবিতায় কিছু না হলে দশক দিয়ে কিছু হবে না: শুভ্র সরকার

শুভ্র সরকার। কবি। কবিতায় যার যাপন দুই দশকের বেশি সময় ধরে। তবু প্রকাশ পায়নি কোনো বই। চল্লিশ বছর বয়সে প্রথমবার কবিতার বই নিয়ে এলেন তিনি। বইয়ের নাম ‘বিষণ্নতার স্নায়ুবন’। বইটি বের করেছে প্রকাশনা সংস্থা- পরম্পরা। প্রচ্ছদ করেছেন সারাজাত সৌম। মেলায় বইটি পাওয়া যাবে- গ্রন্থিক প্রকাশনের ২১১ নম্বর স্টলে। তার আগে কবিতার সঙ্গে দীর্ঘযাত্রা নিয়ে কথা বলেছেন চ্যানেল আই অনলাইনের সঙ্গে…

চল্লিশ বছর বয়স অতিক্রম করে প্রথম বই করলেন। এত দেরি কেন?
মূলত কবিতা হলো মানুষের নিজেরই লেখা, নানা রকম অনুষঙ্গের রসায়ন মিশ্রিত লেখা এবং মানুষের জন্যই লেখা। তাই বোধকরি কবিতা সুন্দরের দিকে যায়…! এর আগে যে কবিতাগুলো লেখেছি। তা অনেকটা ছাইপাঁশের মতো। কখনো একটা সময়ে এসে কবিতা মনে হয়নি। পরবর্তীতে যা লিখেছি সেই কবিতাগুলোকে আমার কাছে অন্তত কবিতাপদবাচ্য বলে মনে হয়েছে। এইটুকু কনফিডেন্স আমার আছে। কনফিডেন্স একটা বিরাট বিষয়। তাছাড়া বোধিপ্রাপ্ত হওয়ার জন্য তো চল্লিশ বছর বিশেষ উল্লেখযোগ্য! হা হা হা…!

‘বিষন্ন স্নায়ুবন’ পাঠক কেন পড়বে? কী আছে এতে?
কেন পড়বে বা আদৌ পড়বে কিনা সেটা আমি জানিনা। একজন কবির পক্ষে পাঠক পড়লো কি পড়লো না, সেই বলাটুকুর দায় থাকে না। আমার কাজ লিখে যাওয়া কেবল। তাই আমি নিরবেই লিখে যাচ্ছি। আরেকটা কথা বলি আপনাকে, কবিতা যখন লিখতে বসি তখন হুটহাট করে বসে পরি। জোর করে বা আরোপিত কবিতা আমি লিখতে চাই না। কবিতা যখন লিখি তখন এই কবিতা ছাড়া পৃথিবীর কোন কিছুর প্রতি আকর্ষিত হই না।

কবিতা আপনার কাছে কী? কেন লেখেন?
কবিতা আমার কাছে মনে হয় অনুভব। যেমন আত্মা, হাওয়া বা খিদা এগুলোকে দেখা যায় না শুধু বোঝা যায় কিংবা অনুভব করা যায়। সেই জায়গা থেকে দেখলে কবিতা আমার কাছে তাই। ধরেন ব্যক্তিগতভাবে আমি তাই মনে করি। আমি তো অনুভবের ভেতর দিয়েই দেখি। সেই দেখাটাকেই দৃশ্যের বলয়ে লেখি। আমার কবিতা এর বাইরে আর কিছুই হয় না বোধকরি।

আপনার কবিতার একটা ব্যাপার খেয়াল করছি, আপনি আর্থ সামাজিক ব্যাপারগুলো ডিল করেন না। কেমন একটা দেখে যাওয়া শুধু। এটা কেন?
আমি তো আগেই বললাম অনুভব আমার কাজ। ডিল করা আমার কাজ না। ডিল করবে বুদ্ধিজীবীরা। আর এই যে দেখে যাওয়ার ভেতর দিয়েই আমি পাই আমার চোখের আরাম, আমার অনুভবের আরাম। এই দেখার মধ্যে যে মায়া থাকে, কবিতায় সেই মায়াকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি। আসলে প্রকরণ বিষয়টি কী সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো তার কতটুকু শিল্প হয়েছে।

এই বইয়ে শুধু দীর্ঘ কবিতার স্থান দিলেন। অন্যকবিতা না নিয়ে দীর্ঘ কবিতা কেন? আপনার মুন্সিয়ানা দেখানোর একটা ব্যাপার কি আছে?
আমি কখনো প্রস্তুতি নিয়ে কবিতা লেখি না। আর কবিতায় আমি মুন্সিয়ানা দেখানোর পরিকল্পনা কখনোই করি না। পরিকল্পনা সত্যিই আমার ধাতে নাই। পরিকল্পনা করা হলো গবেষকদের কাজ। যদি বলি ব্যাপারটা এভাবে, বরাবরের মতো একদিন মধুপুর বনের দিকে যাওয়ার পর, ওইখান থেকে ফিরে একটি কবিতা লিখলাম ‘মধুপুর ও অন্যান্য দিন’-এই শিরোনামে। সেদিক থেকে বলতে পারেন এই বইয়ের এটাই প্রথম কবিতা। পরে দেখলাম বেশ বড় হয়েছে এবং পড়তেও ভালো লাগছে। তারপর একটা ফ্লু এর ভেতর থেকে বাকি কবিতাগুলো ধীরে ধীরে লিখেছি। বলতে পারেন এই দীর্ঘকবিতাগুলো আমার সাম্প্রতিক ঘোরের কারসাজি।

দশকওয়ারি যে হিসেবের প্রচলন আমাদের এখানে, সেই হিসেব থেকে তো আপনি রীতিমতো ছিটকে গেছেন! এগুলো নিয়ে কোনো বিষাদ স্মৃতি বা মজার কিছু আছে না কি, বলা যায়?
দশক ধারনাটার সঙ্গে আমি একমত নই। বই বের করলেই যে সেটা দশকের আওতায় আসতে হবে এর কোন মানে দাঁড়ায় না। আমি বই বের করলাম সেক্ষেত্রে আমার দায় শেষ হলো বলে আমি মনে করি। এখন বাকিটা পাঠক আমাকে কীভাবে নেয় সেটা দেখার বিষয় আমারও না। কবিতায় কিছু না হলে দশক দিয়ে কিছু হবে না। দশক আবদ্ধ করা হচ্ছে সংকলনে অন্তভুর্ক্ত হওয়ার একটা পাঁয়তারা। না জামিল, আমার কোন প্রকার বিষাদ স্মৃতি বা মজার কিছু নাই। আমি শূন্য বা দ্বিতীয় দশকের সবাইরে একই জায়গা থেকে দেখতে চাই।

আপনার সময় থেকে, মানে আপনি যখন থেকে লেখা শুরু করেছেন, চর্চার এই যে তিন দশক প্রায়, এই পরিভ্রমণের বাঁকগুলো কেমন? কী কী পরিবর্তন দেখেন?
লেখালেখিটাকে আমি শুরুতে সিরিয়াসভাবে দেখি নাই। সেই দিক থেকে বিচার বিশ্লেষণ করলে আমার পড়াশোনার জায়গাগুলোও ছিলো খুবই সীমিত। জানি পড়াশোনা করেও অনেকের কবিতা হয় না। কিন্তু আমি বলবো পড়াশোনার জরুরত আছে। জামিল, আবার একটু স্মৃতিতে যাই। তো ২০১৩ সালের দিকে আমরা দলবেঁধে মধুপুর বনের মাঝে ঘুরতে গেলাম। দেখলাম বিষণ্ন এক ইটভাটা, তার কারুকাজময় চিমনি দিয়ে যেন পৃথিবীর দিকে ধোঁয়া ছাড়ছে। সেখান থেকে আসার পর আমি লিখলাম ‘ঐ ইটভাটার চিমনি যেন সিগারেট আর পৃথিবী ক্রমাগত সেইটাকেই টানছে’। শুরুটা এভাবে করে একটা কবিতা লিখেছিলাম। পরে সেটা কবি কাজী নাসির মামুন ভাইকে দেখালাম। সে কবিতাটা পড়ে অভিভূত হলেন এবং চোখে মুখে ভালোবাসা মেখে বললেন ‘তুমি পারবা চালিয়ে যাও’। মামুন ভাইয়ের অনুপ্রেরণা ও পরামর্শে সিরিয়াসলি কবিতা লিখতে উদ্বুদ্ধ হই। এরপর থেকে আমরা মুক্তাগাছার আনাচে কানাচে চষে বেড়িয়েছি। কত কত রাস্তার বাঁক দেখেছি, অনেক অনেক গ্রামের বাঁক দেখেছি। কাজেই কবিতার বাঁক নিয়ে ভাববার সময় কই।

কাদের লেখা আপনারে অনুপ্রাণিত করে? বা আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কী?
বলতে হলে তো অনেকের কথাই বলতে। তাই আমি সচেতনভাবেই এড়িয়ে গেলাম। তবে সমসাময়িক অনেক কবির লেখা ভালো লাগে। তাদের একটা নিজস্ব ভাবনা থাকে যা একজন কবিকে অনেক দূর নিয়ে যায়, ইমাজিনেশন- যা একজন কবির জন্যে প্রয়োজন। তাদের কবিতার ভাবুকতার ভেতরই আমি পাই একধরনের পেলবতা।

আপনিতো আড়াল প্রিয় লোক। গ্রামে থাকেন। এই চরম নার্সিসাস সময়ে, এই যাপন কেন? স্বেচ্ছায়?
এই কথাটা আমি আমার প্রথম কবিতার বই ‘বিষণ্ন স্নায়ুবন’-এর ‘ডার্করুম’ নামের কবিতায় সুস্পষ্ট করে বলেছি-

এই যে কাউকে কাউকে বলতে শুনি
আমি ফাউল
অস্ফুট- বলতে না পারা লোক
সবার সাথে মিশতে পারি না বলে
থাকি একার মতোই-

ও বকুল বন্ধু আমার
আমাকে ভেবো প্রাসঙ্গিক
তবু এত যে স্বর সখ্যতার মাঝেও
কেন যে তোমাদের দিকেই
তাক হয়ে থাকে আমার যত অভিমান

আরেকটা প্রশ্ন করা যায় বোধহয়, এই যে কেন্দ্র ঢাকা, আপনি যদি কেন্দ্র ও প্রান্তর ধারণা ধরেন, তো দূর দেশ মুক্তাগাছায় থাকেন, কবিতা লেখেন- পাত্তা পাওয়ার ব্যাপার থাকে। পাওয়া যায় তো যায় না, এমন তো ঘটেই মে বি। সেসব থেকে আপনার মধ্যে কখনো হীনমন্যতা কাজ করে না বা করেনি? বা কেমন ফিল করেন এগুলো?
কবিতায় পাত্তা পাওয়া ও কেন্দ্র বলে কিছু নাই। বরং বলতে পারেন ঢাকারেই পাত্তা দেওয়ার আমাদের কিছু নাই। গ্রাম প্রধান বাংলাদেশকে শহর দিয়ে বিবেচনা করার কী আছে? কাজেই হীনমন্যতার তো প্রশ্নই ওঠে না।

কবিরা অনেক সময়ই নিজেরে আউটসাইডার ভাবেন। সমাজে নিজেরে আনফিট ভেবে পলানোর চেষ্টায় থাকেন। আপনার মধ্যে এই ব্যাপারটা ক্রিয়া করে?
সমাজ আমাকে আনফিট ভাবতেই পারে। কিন্তু আমি সমাজের সেই ভাবনাটারে আমূলে নেই কিনা সেটাই বিষয়। তবে এটা ঠিক সমাজের আমাকে নিয়ে ভাবনায় একটা নেতিবাচক প্রভাব কোনো না কোনোভাবে আমার উপরতো পরেই। আবার ধরেন, সেই প্রভাব কাটিয়ে ওঠবার চেষ্ঠা বা হজম করাটাইতো একজন কবির কাজ। তাই নয় কী?

পলায়ন নয় বলতে পারেন আড়াল। আড়াল ছাড়া সঙ্গবদ্ধভাবে কী আর কবিতা লেখা সম্ভব!

প্রথম বইটা দেরিতে হলেও করলেন। তো সামনের পরিকল্পনা কী আপনার?
বছর খানিক আগে বাবাকে নিয়ে আমি দশটা কবিতা লিখেছিলাম। ছোট কাগজ ‘দেশলাই’-এর জন্যে। ভাবছি ওইটা সিরিজ আকারে লিখবো আরো ১৫ টি কবিতা। টোটাল পঁচিশটা কবিতা দিয়ে একটি দু’ফর্মার বই করা যাবে। আপাতত এই, পরে সামনে কী হবে না হবে এটা বলতে পারছি না…!