২০ বছর আগে নিজ স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পেয়ে কনডেম সেলে থাকা জাহিদ শেখ দেশের সর্বোচ্চ আদালতের খালাস আদেশে আজ কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
জাহিদের মুক্তির নির্দেশ বাগেরহাট আদালত থেকে খুলনা জেলা কারাগারে এসে পৌঁছানোর পর সোমবার সন্ধ্যায় খুলনা জেলা কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন তিনি। সেসময় স্বজনরা তাকে পেয়ে আবেগ-আপ্লুত হয়ে পড়েন।
মুক্তির পর জেল গেটে জাহিদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘নিজ স্ত্রী ও সন্তানকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডাদেশ নিয়ে কনডেম সেলে থাকার সময় প্রতিনিয়ত নিজের মৃত্যু কামনা করতাম। আমার শ্বশুর-শাশুড়ির দেয়া মিথ্যা মামলায় আমাকে কারাগারে থাকতে হলো। আমি কারাগারে থাকা অবস্থায় আমার মা-বাবা মারা গেছে। শেষবার চোখের দেখাটাও দেখতে পারিনি।’
দুই দশক পর মুক্ত জীবনে পা রাখা জাহিদ আরো বলেন, ‘আমার জীবনের ২০টি বছর তো আর ফেরত পাব না। তাই এখন রাষ্ট্রপক্ষ যদি কোনো সাহায্য-সহযোগীতা বা ক্ষতিপূরণ দেয়; তাহলে হয়ত বাকিটা জীবন চলে খেতে পারব।’
কে বা কারা তার স্ত্রী-সন্তানকে হত্যা করেছেন? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে জাহিদ বলেন, ‘সেটা তো বলতে পারবো না। তবে আমার সন্দেহ হয়, স্ত্রীর আগের স্বামী হত্যা করেছে।’
এই মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, ১৯৯৪ সালে বাগেরহাটের ফকির হাট থানার উত্তর পাড়ার ময়েন উদ্দিনের মেয়ে রহিমার সাথে খুলনার রূপসা থানার নারিকেলি চাঁদপুরের ইলিয়াছ শেখের ছেলে জাহিদ শেখ বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকে ঘরজামাই থাকতেন তিনি।
পরে জাহিদ-রহিমা দম্পতির ঘরে একটি কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। যার নাম ছিল রেশমা খাতুন। বিয়ের তিন বছর পর ১৯৯৭ সাল থেকে রহিমা-জাহিদ দম্পতি রহিমার বাবার বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দূরে একটি পাকা ঘরে বসবাস শুরু করেন।
কিছুদিন পর ১৯৯৭ সালের ১৬ জানুয়ারি বিকাল সাড়ে চারটার দিকে রহিমার মা আনজিরা বেগম মেয়ের বাড়িতে গিয়ে দরজা ভিড়ানো অবস্থায় দেখতে পান। বাইর থেকে ডাকাডাকি করে সাড়া না পেয়ে একপর্যায়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে খাটের ওপর কাঁথা ও লেপের নিচে বাচ্চাসহ রহিমাকে শোয়া অবস্থায় দেখতে পান তিনি।
পরে কাঁথা সরিয়ে রহিমা ও তার ছোট্ট মেয়েকে মৃত অববস্থায় দেখেন। রহিমা ও তার মেয়ের গলায় মাফলার দিয়ে গিট দেওয়া ছিল বলে মামলায় উল্লেখ করেন রহিমার বাবা ময়েন উদ্দিন।
ঘটনার দিন সকাল ৯টার দিকে অনেকেই জাহিদকে টেম্পুতে করে খুলনার দিকে যেতে দেখেছেন বলে মামলায় উল্লেখ করা হয়। রহিমার বাবা ময়েন উদ্দিনের অভিযোগ জাহিদ শেখ তার মেয়ে ও নাতনীকে রাতের যে কোনো সময় হত্যা করে পালিয়ে গেছে জাহিদ।
মেয়ে ও নাতীনের এই মৃত্যুর ঘটনার পরের দিন জাহিদ শেখকে আসামি করে মামলা করেন রহিমার বাবা ময়েন উদ্দিন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, জাহিদ শেখ তার স্ত্রী ও দেড় বছরের মেয়েকে খুন করেছে। তবে এই মামলার ২১ জন সাক্ষীর মধ্যে প্রত্যক্ষ কোনো সাক্ষী ছিল না বলে জানান রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী সারওয়ার আহমেদ।
১৯৯৮ সালের ১৯ নভেম্বর মামলাটির অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। তার আগেই ওই বছরের ১৮ জানুয়ারি আসামি আত্মসমর্পণ করেন। এরপর অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে ১৯৯৯ সালের ২০ জুন আবার জামিনে বেড়িয়ে যান। দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পর পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে।
বিচারিক প্রক্রিয়া শেষে ২০০০ সালের ২৫ জুন বাগেরহাটের জেলা দায়রা জজ আদালত জাহিদ শেখকে মৃত্যুদণ্ড দেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে ওই বছরের ২ সেপ্টেম্বর জেল আপিল করেন জাহিদ। এরপর থেকে কনডেম সেলে ছিলেন জাহিদ।
পরবর্তীতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত জাহিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ডাদেশ অনুমোদনের আবেদন) ও জেল আপিলের শুনানি শেষে ২০০৪ সালের ৩১ জুলাই হাইকোর্ট তার ফাঁসি রায় বহাল রেখে রায় দেন।
ওই বছরেই ২৯ ডিসেম্বর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে জেল আপিল করেন জাহিদ শেখ। সে জেল আপিল গত ২৫ আগস্ট গ্রহণ করে জাহিদকে খালাসের রায় দেন প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন ছয় বিচারপতির ভার্চুয়াল আপিল বেঞ্চ।
কোন যুক্তিতে আপিল বিভাগ জাহিদ শেখকে খালাস দিয়েছে? জানতে চাইলে আইনজীবী সারওয়ার আহমেদ চ্যানেল আই অনলাইনকে বলেন, ‘জাহিদ শেখের সাথে বিয়ের আগেও রহিমার আরেকটি বিয়ে হয়েছিল। সে ঘরে রহিমার একটি মেয়েও আছে। ওই মেয়ে রহিমার বাবার বাড়িতেই থাকতো। তবে প্রেম করে জাহিদ শেখকে বিয়ে করার কারণে রহিমার আগের স্বামী নাজিবুল ক্ষিপ্ত ছিল রহিমার উপর, যা রহিমার বাবা-মা এবং ভাই সাক্ষী দেওয়ার সময় জবানবন্দিতে বলেছে।’
‘‘ওই নাজিবুলই ষড়যন্ত্র করে রহিমা এবং তার মেয়েকে হত্যা করেছে বলে আমরা যুক্তি দেখিয়েছি। তাছাড়া রহিমার মা-বাবা ও ভাই সাক্ষীতে এটা বলেছেন যে, জাহিদ শেখ রহিমাকে ভালবাসত। শ্বশুর-শাশুড়িকে সে সম্মান করতো। কোনো সময় জাহিদ শেখ যৌতুক দাবি করেনি এবং স্ত্রী রহিমার গায়ে কোনো কারণে হাত তোলেননি। এছাড়া মামলার ৯ জন সাক্ষী বলেছেন, জাহিদ শেখ ও রহিমার মধ্যে ভাল সম্পর্ক ছিল। এমন সম্পর্ক থাকা অবস্থায় জাহিদ শেখ স্ত্রী রহিমা ও দেড় বছরের মেয়েকে হত্যা করবে এটা বিশ্বাসযোগ্য না। এসব কারণে বেনিফিট অব ডাউটে (সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ার কারণে) আপিল বিভাগ আসামিকে খালাস দিয়েছে।”