সামন্তীয় জমিদারী যুগের অবসান হয়েছে বহু আগেই। জমিদার, উজির-নাজির, সিপাহ্শালার এই শব্দগুলো ছিল তখনকার প্রজাকূলের আতঙ্ক। তাদের অত্যাচার নিপীড়নে সতত সন্ত্রস্থ থাকতে হত প্রজাদের।
জমিদার, উজির-নাজির ও সিপাহ্শালারদের শ্যান দৃষ্টিতে পড়ে গেলে কারও আর রক্ষে থাকতো না। জীবন, সম্পত্তি, সুন্দরী নারী, ইজ্জত সম্মান সবই থাকতো তাদের নিয়ন্ত্রণে। জমিদার বাড়ির চাকর, বাঁদি, রক্ষিতা প্রভৃতিরও ছিল প্রজাকূলের মধ্যে ব্যাপক দাপট। সে বাড়িতে প্রজাসাধারণের মাথা উঁচু করে প্রবেশ ও গলা উঁচু করে কথা বলার সাহস হতো না।
সেই সামন্ত যুগের জমিদারদের কেউ কেউ যেন প্রেতাত্মা হয়ে আবারও ফিরে আসতে শুরু করেছে। কতিপয় ভোটবিহীন, অনেক ক্ষেত্রে ভোটযুক্ত এমপিদের মাধ্যমও তাদের এই আগমনী প্রকাশ ঘটছে।
তারা সংসদ সদস্য হয়ে সংসদে আইন প্রণয়ন, এলাকার সমস্যা তুলে ধরা প্রভৃতিতে ভূমিকা না রেখে নিজ নিজ সংসদীয় এলাকার সকলকিছুই জমিদারের মতো একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ করে চলেছেন।
তার ইচ্ছা, অনিচ্ছা, হুকুম কায়েমে ব্যস্ত রয়েছেন কতিপয় উজির-নাজির বেশী এপিএস, পিএ ও সুবিধাভোগী সিপাহ্শালার। এলাকার বিল, হাওড়, চাকরির নিয়োগ, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের নিয়োগ ও বদলি সকল কিছুতেই এমপিদের নিয়ন্ত্রণ।
টিআর, কাবিখা, বয়স্কভাতা, উন্নয়ন বরাদ্দ সকলকিছুই এমপির ইচ্ছায় পরিচালিত হয়। সরকারি চাউল গম বিক্রিও করতে হবে এমপির সমর্থনপুষ্ট সিন্ডিকেটের কাছে।
বাজার দরের চেয়ে অনেক কমে তাদের রেট থাকে। বিষয়টা এরকম যে একটা মসজিদ অথবা মন্দির কমিটি একটন চাউল বরাদ্দ পেল। সে বরাদ্দটা বিক্রি করে অর্থটা মসজিদ অথবা মন্দিরের উন্নয়ন কাজে লাগাতে হবে। ন্যায্য বাজারদরে যে কারও কাছে বিক্রি করার তাদের কোনো সুযোগ নেই। এমপির লোকেদের কাছে কমদামে বিক্রি করতে হবে।
তারা অন্যদের কাছে ন্যায্যমূল্যে বেচবে। এককথায় এমপির লোকদের লাভ করার সুযোগ দিতে হবে। জীবনে দল করেনি, দলের জন্য নূন্যতম শ্রম, ঘাম দেয়নি এমন ব্যক্তি এমপির এপিএস হয়ে যাচ্ছে আর দলীয় নিবেদিত প্রাণদের তাকে তোয়াজ করে চলতে হচ্ছে। জনতার এমপির সাথে জনতার যোগাযোগের কোনো সুযোগ নেই। এমপির সাথে দেখা করলেও এপিএসের মাধ্যমে করতে হবে।
বিভিন্ন সভায় এমপির প্রতিনিধি হিসেবে এপিএসগণ ও কতিপয় সুবিধাভোগী অংশগ্রহণ করে থাকে। সুবিধাভোগীরা একেকজন মারাত্মক আক্রমণমুখী সিপাহ্শালার। এমপির বিরুদ্ধে কথা বললেই তারা তেড়ে আসে। সরকারী চাকরীজীবীরা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হলেও প্রজাকূলের প্রতি তাদের কোন দৃষ্টি নেই। তারা সারাক্ষণ এমপিদের মন রক্ষায় ব্যস্ত থাকেন। এমপির এপিএস ফোন দিলেই তারা জ্বী হুজুর জ্বী হুজুর করতে থাকেন। কারণ এমপির রোষানলে পড়লেই বদলি বান্দরবান অথবা খাগড়াছড়ি।
এই আধুনিক গণতন্ত্র শাসিত আমলে কতিপয় এমপিদের সামন্তযুগীয় জমিদার ফলো করা রীতি খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত ও দেশের জন্য অশনি সংকেত।
সত্য রিপোর্ট করলে পত্রিকার হকার মারার হুমকি, খোদ এমপি কর্তৃক শিশুর উদ্দেশ্যে গুলি, ইয়াবা ব্যবসা, সন্ত্রাসী লালন প্রভৃতি এমপি শব্দটাকে জনবান্ধব হতে টেনে নিয়ে ক্রমশ জনবিচ্ছিন্ন জনআতঙ্কে পরিণত করে চলছে।
তাদের এ আচরণ জনমনে সামন্তযুগীয় জমিদারী প্রথাকে দিবালোকিত স্পষ্টতায় বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে।
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)