একজন লোক কান ধরে উঠ-বস করছেন, পাশে দাঁড়িয়ে একজন লোক সেটা তদারকি করছেন; আর ঘিরে থাকা উৎসুক কিছু লোক “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান দিয়ে নিজেদের বিজয়ী মনোভাবের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। সাদা চোখে দেখা এ দৃশ্যে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে শাস্তি প্রাপ্ত লোকটি কে, উৎসুক লোকজন কারা, কেন এমন হচ্ছে আর তদারকি করা লোকটিই বা কে?
এবার দৃশ্যের সে চরিত্রগুলোর পরিচয় দেওয়া যাক। কান ধরে যিনি উঠ-বস করছিলেন তিনি একটা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। যিনি তদারকি করছিলেন তিনি একজন সংসদ সদস্য, জাতীয় পার্টি (এরশাদ) দলীয় সংসদ সদস্য। আর উৎসুক জনতা, স্লোগানদাতা সকলেই সে সংসদ সদস্যের অনুগত। তবে এখানে আরও এক প্রশ্ন আসতে পারে, এরশাদ নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টির সাংসদ তাহলে সেখানে “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু” স্লোগান দেওয়া হবে কেন? উত্তর সহজ- সারাদেশে জাতীয় পার্টি অনেকটা আওয়ামী লীগের আনুকূল্যেই টিকে আছে, এমনকি জাতীয় সংসদেও। আর সাংসদ সেলিম ওসমান যার অন্য পরিচয় হলো তিনি আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমানের ভাই। শামীম ওসমান নামটি সারাদেশে এতখানি পরিচিত যে তার নামের সঙ্গে আর ভূমিকার প্রয়োজন পড়ে না।
নারায়ণগঞ্জের মদনপুরের পিয়ার সাত্তার লতিফ উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্তের সঙ্গে স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির অনেকের বনিবনা হচ্ছিল না বলে মূল বিবাদের সূত্রপাত বলে গণমাধ্যমের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে ওঠে এসেছে। এ বিবাদ অনেকটা এমন অবস্থায় গিয়ে ঠেকেছিল যে তারা যেকোন ভাবে তাঁকে বিদ্যালয় থেকে সরিয়ে দিতে মরিয়া হয়ে ওঠেছিল। এ পরিস্থিতিতে প্রথমেই তারা ধর্মের আশ্রয় নেয়, কারণ এরা জানে ধর্মের নামে আজকাল অনেক কিছুই ‘হালাল’ হয়ে যাচ্ছে, এমনকি খুনের ঘটনাও। ফলে ধর্ম অনুভূতিতে আঘাতের নামে একটা অভিযোগ তুলে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে তাঁকে শারীরিকভাবে আক্রমণ করা হয়, এবং এরপর সে এলাকার এক সাংসদের তদারকিতে কানধরে উঠ-বস করিয়ে সামাজিক ভাবে হেনস্থা করা হয়। অতঃপর সে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করাও হয়।
বাংলাদেশে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে অনেক জায়গায় অনেককেই এভাবে আক্রমণ করা হয়েছে, এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর। আক্রান্ত প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ায় আগেকার ঘটনাগুলোর সাথে এ ঘটনাকে আলাদা করে দেখার সুযোগ নেই। এবং যারা শারীরিকভাবে আক্রমণ করেছে, মানসিক ও সামাজিকভাবে চূড়ান্ত অপমান করেছে তারা ধর্মের প্রতি অনুরাগ থেকে নয়, অন্য ধর্মের প্রতি হিংসা থেকে উদ্ধুব্ধ হয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের কার্যসিদ্ধি করেছে। এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি ফেসবুকে দেখা একাধিক স্ট্যাটাসের কথা উল্লেখ করা যায় যেখানে অনেকেই লিখেছেন, মসজিদের মাইকে নামাজের আহবান জানানোর কথা, জানানো হয় কিন্তু সে আহবান শোনে যতজন না সাড়া দেয় তার চেয়ে বেশি মাইকে উসকানির কিছু হলে অনেক বেশি সাড়া দেয়। রামুর ঘটনা, নারায়ণগঞ্জের এ ঘটনা এবং কয়েক দিন আগে সিলেটের গোলাপগঞ্জের ঘটনা তার সাক্ষাৎ প্রমাণ।
ঘটনার বিবরণে জানা যায়, শিক্ষক শ্যামল কান্তি ধর্ম সম্পর্কে ‘কটূক্তি’ করেছেন এ অভিযোগে স্থানীয় বাইতুল আতিক জামে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল।
শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে নারায়ণগঞ্জের একটি আসনের সাংসদ সেলিম ওসমান প্রকাশ্যে কান ধরে উঠ-বস করিয়েছিলেন।
এখানে দুইটা বিষয়- ধর্ম নিয়ে কটূক্তি, এবং অন্যটা কান ধরে উঠ-বসে বাধ্য করা। আক্রান্ত শিক্ষক ধর্ম নিয়ে কোনো ধরনের ‘কটূক্তি’ করেন নি এটা স্কুলের দশম শ্রেণী পড়ুয়া সেই ছাত্র রিফাত-এর বয়ানে সবাই জেনেছে। একটি বেসরকারি টেলিভিশনের সাথে এক সাক্ষাতকারে রিফাত বলেছে, স্যার তাকে মারধর করায় সে বিচার চাইতে কমিটির কাছে গিয়েছিল কিন্তু মারধরের সময় ধর্ম নিয়ে কোন মন্তব্য করেননি তিনি। একই মত রিফাতের মায়েরও। শিক্ষক ধর্ম নিয়ে কোন অবমাননা করেছেন বলে তিনিও শোনেন নি। তবে সেলিম ওসমান এমপি সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, শ্যামল কান্তি ধর্ম নিয়ে ‘কটূক্তি’করায় এলাকাবাসীর রোষ থেকে তাঁকে বাঁচাতে গিয়েছিলেন তিনি। তবে ভিডিওতে দেখা যায় সাংসদ সেলিম ওসমান নিজেই শিক্ষককে কান ধরে উঠ-বস করিয়ে শাস্তি দিচ্ছিলেন।
এখন প্রবল ক্ষমতাশালী ওসমান পরিবারের সদস্য সেলিম ওসমান চাইলে ‘কটূক্তি’ নিয়ে সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির করে ফেলতে পারেন। শক্তি, ক্ষমতা, অর্থ, ধর্মান্ধতা এসব দিয়ে সাক্ষী হাজির করা কোন ব্যাপারই না। জেনেছি ইতোমধ্যেই নাকি ফেসবুকে ‘কটূক্তি’ করেছেন এমন এক ভিডিও প্রচার করা হচ্ছে। আর তার চাইতে মারাত্মক ব্যাপার হলো কটূক্তি করেছেন, কি করেন নি সেটা প্রমাণের দরকার পড়ে না। ধর্ম নিয়ে কটূক্তির ব্যাপারটি একটু আলোচনায় নিয়ে আসলেই হয়, তখন ন্যায়-অন্যায়ের ধারে কাছেও কেউ যায় না। ধর্ম নিয়ে কটূক্তি এমন সামান্য অভিযোগ তুললে খুনোখুনি পর্যন্ত বিচারের বাইরে চলে যায়। এক ধরনের জনমত অন্যায়কারীর পক্ষে চলে যায়, সরকার-প্রশাসন তখন অন্যায় না দেখে স্রেফ কথিত অভিযোগ সৃষ্ট অনুভূতিকেই মূল্য দেয়। পুরো বিষয়টি বাংলাদেশে অনেকদিন ধরে চলে আসছে বলে সেলিম ওসমানের পক্ষে কটূক্তি বিষয়টি আলোচনায় নিয়ে আসার চেষ্টা চলছে, এবং এক শ্রেণির লোক সেটার প্রচারও করে চলেছে।
আলোচনার স্বার্থে ধরে নিচ্ছি এটা তদন্ত সাপেক্ষে প্রমাণের অপেক্ষায় আছে। তাই এখন প্রশ্ন হলো ‘কটূক্তি’ করেছেন এমন প্রমাণ ও সিদ্ধান্ত দেবে যেহেতু সেখানকার স্থানীয় প্রশাসন, সেহেতু তারা কী ধরনের ভূমিকা নিতে পারে সেটা এখনও ভবিষ্যৎ বিষয় হলেও এক পুলিশ কমিশনার যখন বলেন, কান ধরে উঠ-বস করানোর মাধ্যমে সেলিম ওসমান ফৌজদারি অপরাধ করেন নি, তাই পুলিশের করার কিছু ছিল না। তখনই আসলে প্রমাণ হয়ে যায় সে সাংসদকে দোষী হিসেবে দেখতে সেখানকার প্রশাসন মোটেও রাজি নয়। যদিও আইনমন্ত্রী নিজেই বলেছেন এটা ফৌজদারি অপরাধ।
নারায়ণগঞ্জের প্রশাসন ওসমান পরিবারের প্রতি সহানুভূতিশীল বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে অনেকদিন ধরে আলোচিত হয়েছে। সেখানে থাকা পুলিশ-র্যাব সকলেই শক্তিমানদের পক্ষ নিয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ে বলে অভিযোগ; তাজা প্রমাণ সাত খুন, যেখানে খোদ র্যাব জড়িয়ে পড়েছিল। সে হিসেবে সাংসদ সেলিম ওসমানের পক্ষে ‘কটূক্তি’র প্রমাণ দেওয়া অসম্ভব কিছু নয়। তাহলে মিথ্যা হলেও এধরনের প্রমাণ কি কান ধরে উঠ-বসকে যৌক্তিক করে দেবে? সুতরাং চূড়ান্ত বিচারে কটূক্তি এখানে মুখ্য নয়, এটা বরং অপরাধীদের বাঁচিয়ে দেখার একটা উপলক্ষ।
তবে কটূক্তি সম্পর্কে যেকোনো আলোচনা হলে অতি অবশ্যই সে মসজিদের ইমাম, মুয়াজ্জিন, মসজিদ কমিটিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো উচিত। কারণ তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন কোন প্রতিষ্ঠান/উপাসনালয় থেকে হিংসা ও উসকানি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। এক্ষেত্রে কটূক্তি ইস্যুতে এককভাবে দায়ী সে মসজিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টজন; শ্যামল কান্তি নন! ধর্ম মতে কোন মসজিদের কাজ উসকানি ছড়ানো নয়, যদিও নিকট অতীতে সারাদেশে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসন সেসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের এক প্রকার দায়মুক্তি দিয়েছে বলে বারবার একই ধরনের ঘটনা ঘটেই চলেছে।
দ্বিতীয় বিষয়, কানধরে উঠ-বস করানোতে বাধ্য করা। আইনমন্ত্রী যেখানে নিজেই বলেছেন এটা ফৌজদারি অপরাধ। এজন্যে সে সাংসদকে শাস্তির মুখোমুখি করা জরুরি। কেবল আইনমন্ত্রীই নন সেতুমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, তথ্যমন্ত্রী, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীসহ অনেকেই একই ধরনের অভিমত প্রকাশ করেছেন। এ ঘটনায় একজন সাংসদ কেবল একজন শিক্ষককেই অপমান করেন নি, এর মাধ্যমে তিনি শিক্ষক নামের একটা বিশাল প্রতিষ্ঠানকে অপমান করেছেন; কান ধরে উঠ-বস করিয়েছেন। এর রেশ পড়েছে সারা দেশে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে শিক্ষক সমাজের একটা অংশ প্রতিবাদী হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, একজন শিক্ষক হতে হলে বহুবিধ যোগ্যতার প্রমাণ শেষে নিজেকে শিক্ষক বলে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। মহান জাতীয় সংসদের যোগ্যতাসম্পন্ন সাংসদদের প্রতি বিনত সম্মান রেখেই বলছি একজন সাংসদ হতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক সে যোগ্যতার প্রয়োজন হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বিনা ভোটেই সাংসদ হওয়া যায়। বিভিন্ন মামলার আসামি থেকে শুরু করে ইয়াবা ব্যবসায়ী হলেও সেক্ষেত্রে সাংসদ হওয়ার পথ রুদ্ধ হয় না। ফলে শিক্ষকের এ অপমান বিশাল ও সমাজে বিভিন্নভাবে প্রভাব বিস্তারকারী, সামাজিক মর্যাদার প্রশ্নও বটে।
মনে রাখা দরকার নারায়ণগঞ্জের অপরিচিত থাকা একজন প্রধান শিক্ষক শ্যামলকান্তি ভক্ত এতদিন নিজের মধ্যে থাকা কানগুলো নিজস্ব হিসেবে রেখেছিলেন, কিন্তু যখন একজন সাংসদ কর্তৃক প্রকাশ্যে কানধরে উঠ-বস করতে বাধ্য হন তখন তার সে কানগুলো আর নিজের কান থাকে না, পুরো বাংলাদেশের কান হয়ে যায়। সে হিসেবে শ্যামলকান্তির কান ধরে উঠ-বসে বাধ্য হওয়া বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের, ছাত্র সমাজের, এমনকি সাধারণ মানুষেরও কান ধরে উঠ-বস হয়ে যায়।
একজন শিক্ষক শ্যামলকান্তি তাঁর সে অপমানের কোন বিচার পাবেন কিনা জানি না, তবে অতীত অভিজ্ঞতার দিকে তাকালে আমাদের হতাশ হতে হবে। কারণ বিচারহীনতা আমাদের সংস্কৃতির কলঙ্কজনক অংশ হয়ে ওঠেছে। আর যেকোনো অন্যায়ে যদি ধর্মের নামে সামান্যতম যোগ থাকে তবে বিচার প্রাপ্তির আশাবাদের পালে বিশাল এক ধাক্কা লাগে, সন্দেহ নেই।
তাই শ্যামলকান্তি ‘কটূক্তি’ করেছেন কি করেন নি সেটা আলোচনার জন্যে মুখ্য কোন বিষয় না। পুরো বিষয়ে প্রধান ও একমাত্র বিষয় শিক্ষক সমাজকে অপমান; কটূক্তি সম্ভাবনা নিয়ে সেখানে আলোচনার কোন সুযোগ নেই!
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল
আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে।)