পাঠ্যবইতে ও-তে ওড়নাকে আমি সাম্প্রদায়িকতা মনে করিনি। অ-তে অজু ছিল অনেক বইতে বা ঈ-তে ঈদ, র-তে রথযাত্রা, ঋ-তে ঋষি। এ নিয়ে আমাদের আপত্তি ছিল না। এখনো কোন আপত্তি অন্তত আমার নেই। চারটি প্রধান ধর্ম হিসেবে এ তল্লাটের অধিকাংশ মানুষ ইসলাম, সনাতন, খ্রিস্টান এবং বৌদ্ধ ধর্ম পালন করে আসছে। একে অপরের বা নিজের ধর্ম সম্পর্কে পাঠ্যবই থেকে জানছে, একে অপরের ধর্মীয় উৎসবে অংশগ্রহণ করছে, এ নিয়ে কোন আপত্তি সাধারণ মানুষের কোন কালেই ছিল না। তবে উগ্রপন্থীদের কথা আলাদা।
কিন্তু ও-তে ওড়না নিয়ে সাধারণ মানুষ কথা বলছে। লক্ষ্য করুন, আমি লিখছি ‘সাধারণ মানুষ’ সাধারণ হিন্দু, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ নয়। তারা একবারো ভাবছে না যে এই বই পড়ে তাদের সন্তানেরা মুসলিম পোশাক সম্পর্কে ধারণা পাবে।
তবে কেন এই আপত্তি?
গত কিছু বছরে নানা কারণে ইভটিজিং, ধর্ষণ, নারী নির্যাতন বেড়েছে। আগেও ছিল, তবে এতোটা নয়। প্রতিটি ধর্ষণের পর সচেতন মহল এ নিয়ে কথা বলেছে, প্রতিবাদ করেছে, আন্দোলন করেছে।
প্রতিটি আন্দোলনে ধর্ষকের শাস্তি দাবি করা হচ্ছে, নারীর প্রতি পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে বলা হচ্ছে। নারী মানে যে এক খন্ড শরীর নয়, ভোগ্য পণ্য নয় সে কথা বলা হচ্ছে। আমাদের এই দাবির পরিপ্রেক্ষিতে অপর দিক থেকে যে একটি কথা আমরা বারবার শুনেছি তা হোল, ধর্ষনের জন্য টিজিংয়ের জন্য মূলত নারীর পোশাকই দায়ী। নারীর জন্য ধর্ম অনুমোদিত পোশাক না পরার কারণেই এসব হচ্ছে’।
এই বাক্যটিতে এসে একটি জঘন্য অপরাধের সাথে ধর্মকে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে ফেলছে উগ্র ধার্মিকেরা। সে ৬০ বছরের নারীর ক্ষেত্রেও তাদের এই বক্তব্য, ৪ বছরের বা ৪ মাসের শিশুর ক্ষেত্রেও।
বলা পর্যন্তই শেষ না, তারা প্রায়শই এই বক্তব্যের সাথে সিম্বলিক কিছু ছবি জুরে দেয় যেখানে আমরা দেখি একটি ২/৩ বছরের শিশু কন্যা ওড়না দিয়ে মাথা-বুক মুড়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ঠিক এখানে এসে ওড়না হয়ে যায় ধর্মীয় পোশাক।
না হলে বা এর আগ পর্যন্ত ওড়না শাড়ির মতই আমাদের সাংস্কৃতিক পোশাকের অংশ ছিল, আছে। প্রতিবেশী দেশ ভারত যেখানে জনসংখ্যার ৭৯.৮% ভাগ সনাতন ধর্মের মানুষের বাস সেখানেও আপনি দেখবেন সেই সনাতন ধর্মীয় অধিকাংশ নারীরা নির্দ্বিধায় সালোয়ার কামিজের সাথে ওড়না পরিধান করে।
বাংলাদেশে মুসলিম ছাড়াও অন্যান্য ধর্মের মানুসের বাস আছে। যাদের ধর্ম তাদের ৬ বছর বয়সী কন্যা শিশুদের পর্দা করতে বলে না। তারা শিশু বয়স তো বটেই বাকি জীবনেও ওড়না পরবে কি পরবে না সেটা একান্তই তাদের বিষয়। সেখানে একটি সরকারি পাঠ্য পুস্তক যা কিনা সকল ধর্মের শিশুদের পড়া বাধ্যতামূলক সেখানে ও-তে ওড়না চাই বাক্যটি থাকা কতোটা উচিত?
যেখান উগ্রধর্মপন্থীরা বারবার পোশাককেই নারীর শালীনতাহানীর কারণ বলছে, চার বছর থেকে চার মাসের শিশুও এর বাইরে না সেখানে আজকের এই ‘ও-তে ওড়না চাই’ বাক্যটি কি উগ্রপন্থীদের বাক্যে সরকারি মোহর লাগিয়ে দিচ্ছে না?
(এ বিভাগে প্রকাশিত মতামত লেখকের নিজস্ব। চ্যানেল আই অনলাইন এবং চ্যানেল আই-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে প্রকাশিত মতামত সামঞ্জস্যপূর্ণ নাও হতে পারে)